• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে কৃতিকণা

ভুল
গেটটা পার করে নীলেশ গাড়িটা উঠোনে দাঁড় করাতেই গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল নীপা। বিয়েবাড়ির ঘরভর্তি লোকের চোখ তখন নীপায় আটকে গেছে।
— “ও কে রে অপু? তোর ননদ? ফিল্মস্টার নাকি রে?”
অপরাজিতার তখন গর্বে বুক ফুলে উঠেছে। একে নীলেশকে পেয়েই তার মাটিতে পা পড়ে না, তার উপর আবার নীপা।
নীপা অপুর ননদ, নীলেশের আদরের মামাতো বোন। নীলেশ আর অপরাজিতার প্রেমের একমাত্র সাপোর্টার। আজ থেকে পনেরো বছর আগে নীপা একাই পুরো পরিবারের সঙ্গে লড়ে গিয়েছিল ওদের জন্য। কালো, প্রায় ছেলেদের মত লম্বা, অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত এবং কম বিত্তবান ঘরের গ্রামের মেয়ে অপু কোনো দিক দিয়েই নীলেশের সমকক্ষ ছিল না। সেই মুহূর্তে নীপা পরীর মত ওর জাদুকাঠি ছুঁইয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল।
কিন্তু নিজের জীবনের লড়াইটা লড়তে গিয়ে কর্পূরের মত উবে গিয়েছিল যেন। নীলেশ বা অপরাজিতা কোনোরকম সহযোগিতা করার সুযোগই পায়নি। সেই নীপা আজ এতকাল পরে চোখের সামনে!
নীপা আসার পর থেকে বিয়েবাড়ির চেহারাটাই বদলে গেছে যেন। সবকিছুতেই নীপার সাগ্রহে অংশগ্রহণ মুগ্ধ করছে সবাইকে। একমাত্র শ‍্যালকের বিয়েতে নিজের প্রিয় বন্ধুকে ফিরে পেয়ে যেন হাওয়ায় উড়ছে নীলেশ। নীপাও থেকে থেকেই নীল নীল করে ডেকে ডেকে বাড়ি মাথায় করছে।
এতক্ষণ বিয়েবাড়ির প্রায় সমস্ত দায়িত্বই ছিল নীলেশের কাঁধে। নীপা আসাতে টাকা পয়সার সমস্ত দায়িত্ব নীপার উপর চাপিয়ে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হল। ছোটবেলা থেকেই নীপার দায়িত্বশীলতার  উপর অগাধ বিশ্বাস নীলেশের। সেই দিক থেকে অপুর কাজকর্ম অনেক হালছাড়া, দায়সারা।
নীলেশের অন্ধ অনুসরণকারী এ বাড়ির সবাই। জামাই অন্ত প্রাণ। বোঝাই যায়, নীলেশের অবদান এ বাড়িতে প্রচুর। তাই নীলেশের দেখাদেখি চাবির ব‍্যাগ থেকে গয়নার বাক্স— সবই নীপার দায়িত্বে নিশ্চিন্তে জমা রাখা হল একে একে। সারা বাড়ির সবার মুখে শুধু নীপা নীপা আর নীপা। যেন বহুকালের পরিচিত কোনো প্রিয়জন। আড়ালে মেয়ে মহলে শুধু নীপাকে নিয়েই আলোচনা। ওর সৌন্দর্যে আর ব‍্যবহারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে সবাই।
বিয়ের দিন বিকেলে বরযাত্রী যাবার আগে সমস্ত টাকাপয়সা গয়নাগাটি অপুর হাতে দিয়ে পইপই করে সেগুলোকে আলমারিতে তুলে রাখতে বলে সাজগোজে ব‍্যস্ত হয়ে পড়ল নীপা। শুধু শুনতে পেল অপু গলা তুলে চেঁচাচ্ছে, “ও মা, মা, কোথায় তুমি? এসব ব‍্যাগপত্তর আলমারিতে তোলো। আরে তাড়াতাড়ি এসো না। আমার চুলটাই তো এখনও পর্যন্ত বাঁধা হয়নি। ও নীপা, আমার চুল বেঁধে দিয়ে তবে তুমি সাজতে বসবে। একি, বাবা? তুমি এখনও বেরোওনি? কি খুঁজছো? তোমার কালো সোয়েটারটা? তুমি এখন শালটা কাঁধে চাপিয়ে চলে যাও। কনের আশির্বাদটা সেরে রাখো। না হলে বিয়েতে বসতে দেরি হয়ে যাবে। আমি তোমার সোয়েটারটা খুঁজে নিয়ে যাব ‘খন। ও মা, কোথায় গেলে? ওদিকে ভাইয়ের ধুতিটা যে কে পরাবে, তার ঠিক নেই। ধ‍্যাত, যত চিন্তা যেন আমার।”
গান গেয়ে নীপা সারারাত বাসরঘর মাতিয়ে রাখল। অপু ততক্ষণে নীপার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমের দেশে। নীপা সারারাত অপুর মাথায় হাত বুলোলো।
নীল আর নীপা প্রায় সমবয়সী। তাই ছোটবেলা থেকেই বন্ধুত্বটা জমজমাট। মাতৃহারা নীপা সৎমায়ের দেওয়া যন্ত্রণা ভুলতে ছোটবেলা থেকেই পিসতুতো ভাই নীলকে আঁকড়ে ধরেছিল। পরিবর্তে নীলেশকে খাঁটি বন্ধুত্ব উপহার দিয়েছিল।
অপুও খুব ভাল মেয়ে। প্রথম আলাপেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল নীপার। অমন দিঘল চোখ যেন এমন কালো মুখেই মানায়। নীপাকে প্রথমবার দেখেই এমন জড়িয়ে ধরেছিল অপু, যেন হারিয়ে যাওয়া প্রিয় সখিকে ফিরে পেয়েছে সে।
এই কদিন আনন্দের জোয়ারে ভেসে আছে নীপা। তার দৈহিক সৌন্দর্যের আড়ালে থাকা জীবনের গ্লানিগুলো যেন মুখ লুকিয়েছে অন‍্য কোথাও। নীল আর অপু ভালবাসা আর বিশ্বাস দিয়ে সর্বক্ষণ ঘিরে রেখেছে তাকে।
নীপার দুধে আলতা রঙে গা ঘসেছে অপু। হাসতে হাসতে আদুরে গলায় বলেছে, “আমার রঙটা তুমি নাও, আর তোমার রঙটা আমায় দাও।”
রঙের বদলে আদরে ভরিয়ে দিয়েছে নীপা অপুকে। বারেবারে মনে মনে বলেছে, “ভাল থাকো তোমরা।”
নীল আর অপুর তখন সবে সবে বিয়ে হয়েছে। একদিন ন‍্যাশনাল লাইব্রেরীতে পল এর সাথে হঠাৎই পরিচয় হয় নীপার। বই থেকে মুখ তুলে দেখে, প্রেমে ভরা দুটো গভীর নীল চোখ একদৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীপা ওই নীল সাগরে ডুবে গেল।
ফরাসি পল এদেশে এসেছিল হিন্দু সংস্কৃতির উপর রিসার্চ করতে। নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে পল এর রিসার্চের কাজে সাহায্য করেছিল নীপা।
ফ্রেঞ্চটা না জানা থাকলে ভাবটা এত তাড়াতাড়ি জমতো কিনা বলা যায় না। কাউকে কিছু না জানিয়েই পল এর সাথে দিল্লী চলে গিয়েছিল নীপা। দিল্লী কালীবাড়িতে বিয়ে করেছিল ওরা।
তারপর সেই নীল স্রোতে ভেসে যেতে যেতে যখন ঢেউয়ের ধাক্কায় আছাড় খেয়ে মুখ থুবড়ে তীরে এসে পড়ল নীপা, ততক্ষণে পল সেন্ট-ডেনিস পৌঁছে গেছে।
নীপা তারপর আর কলকাতায় ফেরেনি। দিল্লীতেই দোভাষীর চাকরি নিয়ে থেকে যায়। মনের কোণে পল এর ফিরে আসার একটা ক্ষীণ আশা জেগে থাকে।
এত বছর পরেও পল কে ঠিক প্রতারক ভেবে উঠতে পারেনি নীপা। আজও একতরফা জেনেও পাগলের মত ভালবাসে ওই নীল চোখের মানুষটাকে।
কয়েকদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় নীলেশ খুঁজে পায় নীপাকে। তারপর এই দেখা।
বৌভাতের দিন সকালে নীপা সবে স্নান করে বেরিয়েছে। নীপার ওই ভিজে রূপ দেখে হাঁ বন্ধ হচ্ছে না বাড়ির মহিলাদের। এক মহিলা তো বলেই ফেললেন, “কি মাখলে গো স্নানের সময়?”
ভীষন স্মার্ট হলেও, রূপের প্রশংসা শুনলে বরাবরই কেমন কুঁকড়ে যায় নীপা। পল যখন থুতনিটা আঙ্গুল দিয়ে তুলে ধরে ওর রূপের প্রশংসা করত, নীপা মুখ লুকোতো পলের বুকের মধ্যে। জন্মাবধি মা হারা মেয়ে, বাবার ভালবাসাও পায়নি কখনো তেমন ভাবে। তাই পলের ভালবাসায় পরিপূর্ণ হয়েছিল সে। উজাড় করে দিয়েছিল নিজের সবটুকু।
কেন যে আজ ভোর থেকে কেবল পলের কথা মনে পড়ছে নীপার! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভিজে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে পলকে দেখতে পাচ্ছিল নীপা। ঘোর কাটল অপুর ডাকে।
— “নীপা, বাবার কালো ব‍্যাগটা দাও।”
একটা হিম স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে নীপার। কোন ব‍্যাগ? নীপার কাছে তো শুধু নীলেশের টাকার ব‍্যাগ ছাড়া আর কোনো ব‍্যাগ নেই। সব ব‍্যাগই তো সেদিন বিকেলে অপুকে দিয়ে দিয়েছে নীপা!
কিন্তু পুরো আলমারি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সে ব‍্যাগ কোত্থাও পাওয়া গেল না। অপু এবং তার মা কিছুতেই মনে করতে পারল না ব‍্যাগটা নীপা আদৌ দিয়েছিল কিনা।
মুখে কেউ কিছু না বললেও, বিয়েবাড়ির অতগুলো লোকের মুগ্ধ দৃষ্টি ঘোর সন্দেহের মেঘে ছেয়ে গেল নিমিষে। শুধুমাত্র নীল অপুকে ক্রমাগত ধমকাচ্ছে আর বলছে, “মনে করো, মনে করো। তোমারই কোথাও ভুল হচ্ছে। নীপার ভুল হয় না।”
সত্যিই কি ভুল করে না নীপা? পলকে ভালবাসা কি নীপার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল নয়?
চোখ তুলে তাকাতে পারছে না নীপা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মাঘ মাসের ঠান্ডাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে মুখে। এত অপমানিত সে আগে কখনো হয়নি। পল ছেড়ে চলে যাওয়াতে সে চরম অবসাদে আর অসহায়তায় ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু সে ছিল তার একান্ত নিজস্ব অনুভূতি। শুধুমাত্র ঈশ্বর ছাড়া এ ঘটনার সাক্ষী কেউ ছিল না। অন‍্য কারো কাছে সে কখনো তার উঁচু মাথা নিচু করেনি।
কাঁদছে না, কাঁপছে নীপা— ঝড়ে উড়ে যাওয়া শুকনো বাঁশপাতার মত। এই মুহূর্তে সে কোথা থেকে এক লাখ টাকা এনে দেবে? আর তার সম্মান? কেন ভাবনা চিন্তা না করেই এতবড় দায়িত্বটা কাঁধে নিতে গেল? কেন আবার বোকার মত এতবড় ভুলটা করলো নীপা? জীবনের প্রতিটি পাতাই কি ভুলের কালিতে লিখবে সে?
হঠাৎ বুকের কাছে কি একটা সুড়সুড় করায় অন‍্যমনস্ক ভাবে হাত দিয়ে দেখতে গিয়ে গলার লকেটটায় হাত ঠেকল। পল এর লকেট। এত্তবড় একটা হীরে। বিয়ের দিন নিজের গলা থেকে খুলে পরিয়ে দিয়েছিল নীপাকে। এটাই পল এর একমাত্র স্মৃতি। লকেটটাকে শক্ত করে চেপে ধরল নীপা। ঝড় বৃষ্টির রাতে বাজ পড়লে পল যেমন নীপাকে শক্ত করে ধরে রাখতো বুকের মাঝে, ঠিক তেমনি করে। আজও এই বিনা মেঘে বজ্রপাতের দিনে পলই তার রক্ষাকর্তা। একলাখ টাকার অনেক বেশিই হয়তো দাম হবে হীরেটার।
সবেই গলা থেকে চেনটা খুলে লকেটটা বের করতে যাবে, নীলেশের ড্রাইভার ছুটতে ছুটতে এসে অপুর একটা বড় সাইড ব‍্যাগ নীলেশের হাতে দিয়ে জিভ কেটে বলল, “বউদি বরযাত্রী যাবার সময় এটা আমাকে গাড়ির ডিকিতে রাখতে দিয়েছিলেন। আমি একদম ভুলে গেছি দাদা।”
ব‍্যাগটা দেখেই অপু ছানাবড়া চোখ করে নীলের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ব‍্যাগের চেনটা খুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিল। তারপর কালো সোয়েটার সমেত বাবার কালো টাকার ব‍্যাগটা বার করে আনল। প্রয়োজন পড়তে পারে ভেবে অপু সেদিন সন্ধ্যায় বাবার সোয়েটারের সাথে টাকার ব‍্যাগটাও নিজের সাইড ব‍্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। তারপর নিজের স্বভাব বশতঃ ভাইয়ের বিয়ে দেখার আনন্দে এক্কেবারে ভুলে গেছে সে কথা।
ব‍্যাগটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নীপার গলা জড়িয়ে ধরল অপু। চোখদুটো খুব জ্বালা করছে নীপার। কিন্তু প্রকাশ‍্যে কান্না তার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই প্রাণপণে কন্ট্রোল করছে নিজেকে। পল এর দেওয়া লকেটটা তখনও সে মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে।
বাঁ হাতে ধরা মোবাইলটা বেজেই চলেছে। খেয়ালই নেই নীপার। নীল বলল, “ফোনটা ধর। অনেকক্ষণ ধরে বাজছে।”
যন্ত্র মানবের মত ফোনটা কানে ধরতেই, ওপাশ থেকে উত্তর এল, “নিইইইই?”
পল! নীপাকে এমন করেই আদর করে ডাকতো, “নিইইইই..।”
বুকের ভিতর সহস্র ঘোড়া দৌড়চ্ছে নীপার। ভুল শুনছে না তো সে? গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে। শুধু কাঁপা কাঁপা হাতে নীলের দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিতে দিতে উচ্চারণ করল, “পল।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।