ভেলমুরুগন আজ দেশে ফিরছে। ওরা অরিজিনালি তামিলনাড়ুর লোক হলেও বিগত কয়েক পুরুষ ধরে কর্ণাটকে স্থায়ীভাবে রয়েছে। চিকমাগালুরের কাছে একটা ছোট গ্রামে ওদের বাড়ী। ওর বাবা কফি চাষ করেন। কিন্তু অপরাপর চাষীদের মতো ওদের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। কাজে কাজেই কয়েক বছর কফি চাষের মন্দা যেতে না যেতেই ওদের জমি বিক্রী হয়ে গেল। তাই জীবিকার সন্ধানে ভেল চলে এল মুম্বাই মহানগরীতে। কিছু একটা কাজ জুটে যাবে আশা করেছিল, কিন্তু তেমন একটা সুবিধা হল না। লোকের মুখে শুনেছে যে মুম্বাই নগরী নাকি ঘুমায় না। এখানে নাকি টাকা ওড়ে। সেই উড়ুক্কু টাকার আশায় হয়ত মাঝে মাঝে সমুদ্রের পাড়ে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতো ভেল। সে ভালো ধোসা বানাতে পারে। ভেবে নিল এটাই ওর জীবিকা হোক। একটা ঠেলাগাড়ীতে ধোসা বানানোর সরঞ্জাম জোগাড় করে একদিন সে শুরু করল ফাস্টফুডের ব্যবসা। যেরকম লাভ হবে ভেবেছিল সেরকম হল না। শহরের রাস্তায় ফাস্টফুডের ব্যবসা চালাতে গেলে তোলাবাজ থেকে পুলিশ সবাইকেই টাকা খাওয়াতে হয়, এই নিয়ম তার জানা ছিল না। কী জানি এভাবেই হয়ত তাকে ব্যবসা করার ট্যাক্স দিতে হবে।
ব্যবসাটা মোটামুটি যখন চলতে শুরু করল, ভেল দেশ থেকে তার বউ আর মেয়েকে নিজের কাছে এনে রাখল। কাছের মানুষদের চোখের সামনে দেখেও আনন্দ আছে। যদিও তার বাবা-মা, ভাইকে আনতে পারেনি। ওর আশা আছে আরও ভালো ব্যবসা হলে ওদের মুম্বাইতে আনার ব্যবস্থা করবে। এখন সকাল সাতটা থেকে রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত ওর স্টল খোলা থাকে। সত্যি, মুম্বাই নগরী ঘুমায় না। এখানে টাকা ওড়ে।
একদিন দুপুর নাগাদ কিছু পুলিশ এসে ওর দোকানের আশেপাশে লাঠিচার্জ শুরু করল। ভেল বুঝল না কী হচ্ছে, কেনই বা হচ্ছে! একজন উর্দিধারী তার লাঠির ধাক্কায় স্টলের উপরে থাকা সম্বরের ড্রামটা উল্টে দিয়ে বলল, “শুনা নেহী কেয়া মাদারচোদ, আজ সে লকডাউন হে পুরা দেশমে।” ভেল সত্যিই জানতো না কেন এই লকডাউন। ও শুধু জানলো ওর দোকানটা তছনছ করা হল। ওর ব্যবসার ইতি হল সেদিন। বস্তিতে ফিরে সে অবশ্য শুনেছে কী এক মহামারীর কারণে দেশে এই লকডাউন চলছে।
দুদিন চলার মতো চাল ওর ঘরে আছে। কিন্তু তারপর কী হবে সে জানে না। সে অবশ্য দেখতে পেল সরকার থেকে রেশন দিচ্ছে। অনেকেই তাতে চাল, ডাল, আলু আরও নানা প্রয়োজনীয় খাবার পাচ্ছে। কিন্তু ভেলের কাছে তো রেশনকার্ড নেই; সেগুলো তো দেশের বাড়ীতে পড়ে আছে। কী করবে ও? দুদিন পর খুব সাবধানে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা বুথ থেকে তার গ্রামে ফোন করল। ওদের গ্রামে একজনের ফোন আছে, ওর প্রিয় বন্ধু পরমেশের। পরমেশকে ব্যপারটা খুলে বলাতে সে বলল, “যেভাবে পারো চলে এসো ভাই। এখানে ফিরলে অন্ততঃ একবেলা খাবারের বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।” ভেল সবই বুঝল, কিন্তু কীভাবে দেশে ফিরবে বুঝতে পারল না। বাস-ট্রেন সবই তো বন্ধ। কীভাবে ফিরবে সে?
সেদিন বাড়ী ফিরে দেখল ওর স্ত্রী, আট বছরের মেয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছে ভেলের ফেরার অপেক্ষায়।
“চাল এনেছ?”
স্ত্রীর প্রশ্নের কোন উত্তর ছিল না ওর কাছে। কোথা থেকেই বা আনবে? দোকান খোলা নেই, সঙ্গে তেমন টাকা নেই, রেশন কার্ড নেই — কোথা থেকেই বা আনতে পারবে সে? কীভাবে পারবে? সেদিন রাতে জল খেয়ে ঘুমিয়ে থাকার পর ভেল স্থির করল ও দেশে ফিরবে, সে যেভাবেই হোক। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখল ওর মতো আরও কিছু মানুষ একত্র হয়েছেন। দেখে মনে হল একই উদ্দেশ্য। কিন্তু সেখানে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে ও সাহস করল না, কারণ বাস স্ট্যান্ডের অন্যদিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেল এক ভ্যান পুলিশ লাঠিচার্জের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই সেখানে না দাঁড়িয়ে ও হাঁটতে শুরু করল। হাইওয়ের পথ ধরে হাঁটছে ভেল, তার স্ত্রী ও তাদের মেয়ে। পথে পুলিশের ভ্যান বা সেরকম কিছু চোখে পড়লে চট্ করে কোন ঝোপে বা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে ওরা। দুদিন এভাবেই হেঁটে, পথে বিশ্রাম নিয়ে চলতে চলতে সে অবসন্ন হয়ে পড়ল। নিজের খিদের জ্বালা তাও সহ্য হয়, কিন্তু ওর বউ-মেয়ের দিকে চাইতে পারে না ও। ওদের কষ্ট দেখার মতো শক্তি ঈশ্বর ওকে দেননি।
একদিন পথে আসতে আসতে একটা মন্দির চোখে পড়ল ভেলের। মনে হয় কোন এক পুরোহিত লুকিয়ে পুজো করছেন। মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখল সেখানে ঐ পুরোহিত ছাড়া আর কেউই নেই। তিনি সভয়ে পুজো করছেন, নীচু স্বরে মন্ত্র পড়ছেন, যাতে ওর উপস্থিতি কারোর চোখে না পড়ে। ওদের দেখে পুরোহিতের মনে দয়া হল। ঠাকুরের জন্য আনা ফল ওদের প্রসাদ হিসেবে দিলেন। সেদিনটা কোনভাবে বেঁচে গেল ওরা। কিন্তু এখনো যে ঘরে ফিরতে অনেকখানি রাস্তা বাকী!
“চিকমাগালুর আর কত দূর?”
প্রশ্নের উত্তরে পুরোহিত আর কিছুই বললেন না। ভেল জানে না ওরা আর কতটা পথ হাঁটবে! আর কতদূর গেলে সে তার বাবা-মা, ভাই, ওর গ্রামের মানুষদের, ওর প্রিয়জনদের দেখতে পাবে। সে একটা অসম্ভব চেষ্টা করে চলেছে মাত্র!
পরের দিন সে একটা মফঃস্বলে পা রাখল। দেখল, একটা লাইনে একটু দূরে দূরে অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন নেতা গোছের কেউ বড় বড় প্যাকেটে চাল, ডাল, আলু বিতরণ করছেন। একটা অদ্ভুত ব্যাপার ভেল খেয়াল করল, বস্তাটা গ্রহীতার হাতে দেওয়ার সময় নেতটি অনেকক্ষণ দুই হাত দিয়ে তা ধরে আছেন, এবং আশেপাশের অনেক ক্যামেরাম্যান সঙ্গে সঙ্গে ফটো তুলে রাখছেন। ফটো তোলা না হলে বস্তাটা গ্রহীতার কাছে সম্পূর্ণরূপে পৌঁছচ্ছে না। এমন সময় পাশ থেকে কেউ একজন নেতাটির কানে কানে বলল, “বস্, প্যাকেট কম হে।” কথাটা শোনবার পর অবশ্য চিত্রটা একটু পাল্টাল। ক্যামেরাম্যান ছবি তোলার পর বস্তাটা গ্রহীতার কাছে না পৌঁছে দাতার গাড়ীতে চালান হল। যাইহোক, সেই সময় ভেল এসে পড়ল ওদের এই কাণ্ডকারখানার মাঝে। যদিও সেই নেতার গাড়ী কিছু সময়ের মধ্যেই উধাও হল। পাড়ার একজন মানুষ দয়াপরবশ হয়ে ভেলকে একটা খাবারের বস্তা, কিছু টাকা, আর একটা পাঁচ লিটারের জলের বোতল দিলেন। ভগবানের আশীর্বাদ মনে করে সেগুলো ভেল আর তার স্ত্রী বয়ে নিয়ে চলতে লাগলো তাদের দেশের দিকে, তার গ্রামের দিকে।
দুদিন পর ভেলের স্ত্রীর শরীর একেবারে ভেঙে পড়ল। ভেল খাবারের বস্তা, আর জলের বোতলটা হাতে নিয়ে আরেক হাতে তার স্ত্রীর হাত ধরল। মেয়েকে চাপিয়ে নিল নিজের কাঁধে। এই সুদীর্ঘ পথ ওদের যে অতিক্রম করতেই হবে।
চিকমাগালুরের কাছাকাছি এসে ভেল দেখল তার স্ত্রী পথশ্রমে নির্জীব হয়ে গেছে। ভেলের হাত ধরে সে বসে পড়ল রাস্তার ধারে। পায়ের চামড়ার খানিকটা সরে গেছে পথশ্রমে। কী যে করবে ও, ভেবেই পাচ্ছে না ভেল। এমন সময় তার খেয়াল হল, ওর মেয়ে অনেকক্ষণ কথা বলছে না। পীঠ থেকে মেয়েকে নামিয়ে মুখে জল ছিটিয়েও সে কোন সাড়া পেল না। এক অজানা ভয়ে ভেলের বুক কেঁপে উঠল। মেয়ের বুকে কান পেতে শুনল—- নাহ, কিছুই শুনতে পেল না ও। ভেল অনেকক্ষণ ধরে একটা শবদেহ বহন করে এনেছে। বউয়ের দিকে চেয়ে দেখল সে স্থির চোখে পাথর হয়ে গেছে। হয়ত সে আগেই আন্দাজ করেছিল এই ঘটনার। রাগে-দুঃখে পকেটের টাকাগুলো বের করে ভেল আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিল। চিৎকার করে উঠল, “দেখো, মুম্বাই নগরীর টাকা উড়ছে।”