বর্ধমান স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকতেই প্রত্যেকের মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল,কে আগে নামবে।আমি এই কম্পিটিশনে কোনোদিনই থাকি না।চুপচাপ কামরার এক কোনে দাঁড়িয়ে রইলাম।
সবাই নামতেই এবার কে আগে উঠবে সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ এনজয় করছিলাম।
“দাদা নামুন… ” একজন বলে উঠতেই তাকে হেসে উত্তর দিলাম “নামছি ভাই, এইতো সুযোগ পেলাম….”
ট্রেন থেকে নেমে সামনেই সিঁড়িতে পা দিয়েছি, পিছন থেকে শুনলাম একজন তারস্বরে চিৎকার করছে “দাদা, ..ও দাদা…”
পিছনে তাকাতেই দেখি ভিড়ের মধ্যে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে আর ‘দাদা’ সম্মোধন করে ডেকেই চলেছে।আমি থামতেই কাছে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে।
“আমি পল্টু।দাদা, চিনতে পারছেন না?অবশ্য না পারারই কথা।”
আমি সত্যি চিনতে পারিনি পল্টুকে। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
“কি করে চিনবেন?অনেকদিন সাহেবপাড়া ছেড়েছি।দিন তিনেক হলো গুজরাট থেকে ফিরেছি। বাড়িতে তো থাকাই হয় না।সারাদিন..”
এতক্ষনে চিনলাম তোতলা পল্টুকে।এখন একটু শুধরেছে.. আগে তো কথা বললে মনে হতো, এই বুঝি বমি করে ফেলবে কথা বলতে গিয়ে।
“বুঝেছি পল্টু..ভালো আছিস তো?এখন চলি বুঝলি, পরে কথা হবে।”
পল্টুর সঙ্গে কথা বললে আমার কাজটা পণ্ড হবে। তাই ওকে ‘টা টা’ বলে দ্রুত পা চালালাম।
কাজ শেষ হতেই ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ফেরার ট্রেন ধরে ফেললাম।শর্টকাটে কোয়ার্টারের গলিটা ধরেছি, হঠাৎ কানাইয়ের সঙ্গে দেখা।মুখটা দেখে একটু বিমর্ষই মনে হলো।
“কি ব্যাপার?শরীর খারাপ নাকি?”জিজ্ঞাসা করতেই ও বলে উঠলো, “না দাদা দুপুরে পল্টুর খবরটা শুনে…”
“পল্টুর খবর?মানে?কি ভুলভাল বকছিস কানাই?”
“শোনো নি?”
আমি মাথা নাড়তেই ও উত্তেজিত হয়ে বলে চললো,”পল্টু মারা গেছে তুমি জানো না?”
শুনে আমার মাথা কাজ করছিল না।কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে স্টেশনে পল্টুর সঙ্গে কথোপকথন চোখের সামনে ভাসতে লাগলো।এটা কি করে সম্ভব? আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
বিকেলে ক্যাবলার চায়ের দোকানে চা খেতে গেছি।কাশ্মীর, পাকিস্তান, নাগরিকপঞ্জি নিয়ে দেখি জোর আলোচনা চলছে।হঠাৎ সমীরদা আমায় বললো, “শুনেছ ভাই, সাহেবপাড়ার পল্টু মারা গেছে।”
শুনেই বিস্কুটের গুঁড়ো গলায় আটকে গেলো।পড়িমরি করে জল খেয়ে সমীরদাকে বললাম, “কি বলছো আজেবাজে? আমার সঙ্গে তো আজকেই…”
“না গো, খবরটা কানে যেতে আমিও বিশ্বাস করিনি। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে ছেলে ও।গুজরাটে সামান্য কাজ পেয়েছিল একটা।পোষায়নি বলে ছেড়েছুড়ে দিন তিনেক হলো বাড়িতে ফিরেছে..”
মাথাটা ঘুরছে বুঝতে পারলাম।বসে পড়লাম আমি।তাহলে স্টেশনে ছেলেটা কে? পল্টুই তো?
আমার পাশেই বসে চা খাচ্ছিল লস’দা।চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে বললো, “কাজকম্ম পাচ্ছিল না, হয়তো হতাশ হয়ে কিছু করে ফেলেছে…”
আমি চা ফেলে রেখে উঠে পড়লাম।মাথাটা যন্ত্রনায় মনে হচ্ছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই ফেটে যাবে।কষ্ট করেই জিজ্ঞাসা করলাম সমীরদাকে, “খবরটা কখন পেলে দাদা?”
“আজ দুপুরে…”
“দুপুরে কখন?”
“পৌনে একটা নাগাদ হবে….”
সকালের ঘটনাটা বেমালুম চেপে গেলাম আমি। বিশ্বাস তো এরা করবেই না, উল্টে আমাকে ‘পাগল’ বা ‘মাতাল’ ভাববে।
সন্ধ্যা নামছে। দু চারটে দোকান আলোও জ্বালিয়ে দিয়েছে।পথচারীদের মুখগুলো একটু অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।
ক্যাবলাকে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বাইকে স্টার্ট দিলাম।এই রহস্যের সমাধান করতেই হবে।
পল্টুর বাড়িতে গেলেই জানা যাবে ‘আসল সত্য’টা।
সাহেবপাড়ার এই গলিটা খুব অন্ধকার।একটা স্ট্রিট লাইট নেই।তার উপর হঠাৎ লোডশেডিং পরিবেশটাকে একেবারে গা ছমছমে করে তুলেছে।মোবাইলে টর্চটা জ্বালালাম।গলির একেবারে শেষ প্রান্তে পল্টুদের বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা একতলা ছোট বাড়ি।চারিদিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা।শুধু নিজের হাঁটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।এক পা এক পা করে গিয়ে পল্টুর বাড়ির গেটটা খুলে একটা হাঁক দিলাম… “পল্টু…. বাড়ি আছিস?”
কোনো সাড়া শব্দ নেই। তাহলে কি সত্যি পল্টুর কিছু হলো নাকি? চারিদিকের পরিবেশ দেখে আশঙ্কাটা উড়িয়ে দিতে পারছি না।
মনে হচ্ছে, ভুল সময় ভুল জায়গায় এসে পড়েছি।
আবার একবার তারস্বরে ডাকলাম, “পল্টু…”
এবার ভয়টা আমার ভিতরে ঢুকলো, টের পেলাম। গা’টা কাঁটা দিয়ে উঠলো..
হঠাৎ কানে এলো শব্দ টা… পুরোনো লোহার গেট খোলার শব্দ।অনেকদিন না খুললে এমন শব্দই হয়। কানের ভিতর দিয়ে একদম হৃদয়ে আতঙ্কের ঘরটায় যেন ধাক্কা মারলো।চোখটা বন্ধ করে ফেলেছি এবার।হার্টবিট একশোর উপরে চলে গেছে বুঝতে পারছি।
“দাদা…..”
একটা গম্ভীর স্বর কানে এলো।চোখ খুললাম।দেখি পল্টু সামনে দাঁড়িয়ে।
এবার ওর তোতলামি রোগটা আমায় ধরলো।
“প…প..ল.. টু.. উ… উ..”
“ব..ব..লো দাদা..”
“ভ..ভা ই….”
“তুমি তোতলাচ্ছো কেন? কি হয়েছে তো..মার?”
এবার আমার সম্বিৎ ফিরে এলো।বুঝলাম, অকারণেই ভয় খাচ্ছি।
“একটু বসি, চ’ পল্টু.. কথা আছে।”
“এসো দাদা, ঘরে এসো।”
ঘরে পুরোনো একটা চেয়ারে বসলাম।পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে সব ঘটনা পল্টুকে বললাম।
পল্টু তো হেসেই অস্থির।
“কি হলো, হাসছিস কেন?”
“আর বলো না, আমার বন্ধুরা আজ বর্ধমান থেকে আসার পথে গাংপুরে আমাকে নিয়ে নামলো।বললো, ‘পুজোর আগে একটু মজা করবো।”
“তারপর?”
“তারপর আর কি দাদা… রেললাইনে আমায় শুইয়ে নাকে তুলো গুঁজে একটা ছবি তুলে বললো, ফেসবুকে পোস্ট করবো পাঁচ মিনিটের জন্য। বন্ধুদের এই সামান্য অনুরোধ ফেলতে পারলাম না বুঝলে..। ওঃ.. লোকে ভালোই খেয়েছে বলো?”
পল্টুর অট্টহাসিতে ঘরটা গমগম করে উঠলো।
“আসি পল্টু, কাল দেখা হবে..”
পল্টুকে বিদায় জানিয়ে ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ফিরছি।ওঃ, এই ফেসবুক কি না করতে পারে?শালা.. একটা জলজ্যান্ত লোককে একেবারে মেরে ফেললো? জগৎটা সত্যি দিনদিন ‘ভার্চুয়াল’ হয়ে যাচ্ছে।
স্টেশন থেকে আমার বাড়ি হাঁটা পথে দু মিনিটের পথ।স্টেশন রোড ধরে বাড়ি ঢুকতে যাচ্ছি…. দেখি টিকিট কাউন্টারের কাছে একটা জটলা।লোক থিক থিক করছে।একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
ক্যাবলাকে বললাম, “গাড়িটা দেখিস তো ভাই….”
দ্রুত পা চালিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম।ভিড় সরিয়ে দেখি, একটা স্ট্রেচারে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা ডেডবডি।
“গাড়িতে তোলো..”
একটা পুলিশ নির্দেশ দিতেই দুটো লোক স্ট্রেচারটা তুলে ধরলো।
“বেরিয়ে পড়লো পল্টুর রক্তমাখা মুখটা…!!”