নতুন মা-কে প্রথম দেখি আমার যখন সাত বছর বয়স। বৈশাখ মাসের আমকাঁঠাল পাকা এক গরমের দিনে, প্রায় আধসিদ্ধ হতে হতে, এক গা গয়না আর কুঁচকে জড়ো হয়ে আসা লালসবুজ চেলি পরে, ভয়ে ভয়ে যে অষ্টাদশী জীবটি পালকি থেকে নেমে আমাদের চওড়া রোয়াকে এসে দাঁড়িয়েছিল, বলা বাহুল্য তাকে দেখে আমার ভয়, ভাললাগা অথবা সম্ভ্রম কোনোটাই জাগে নি। বরং রাগ হয়েছিল খুব। রাতে বাবার বিছানায় শুতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেছিলাম সারা খাটে ফুল ছড়ানো। মা’কে যখন নিয়ে গেল চিরকালের মতো, সেদিনও দেখেছিলাম এরকম ফুলের মেলা। কিন্তু সেদিনের ফুল আর আজকের ফুলের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক আছে, তা সেই বয়সেই বুঝেছিলাম বেশ। কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে শোবার ঘর থেকে ছোট পিসিমা যখন হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নতুন বৌরানীর সামনে দিয়েই আমাকে টেনে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন, “মুকুর আজ থেকে আমার কাছেই শোবে” বলে পিসিমার হাত থেকে আমার পাখির মত শরীরটাকে নিজের বুকে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন আমার নতুন মা। শুধু কি শরীর? আত্মার কিছু অংশও সেদিন মিশে গিয়েছিল নতুন মা-র সাথে। মনে হচ্ছিল আমি যেন ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি গভীরে..আরও গভীর এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।
পিসিমা অবাক হয়ে গালে হাত দিয়েছিল। —
“এ কী গা বড় বৌ? সতীনের ছেলেকে পেত্থম রাত থেকেই নিজের কাছে শোয়াতে হবে, এমন অনাছিষ্টি কাণ্ডি কেন বাপু? আর ফুল শয্যে? তার কী হবে?”
–“ফুল শয্যা? সে পরেও হতে পারবে’খন।”
সেই শেষ। তারপর থেকে বাবাকে আর অন্দরের ছায়া মাড়াতে দেখিনি কখনও। পালিয়ে বেঁচেছিলেন হয়ত। আমার নতুন মা জবাব চান নি কোনোদিন। এ বাড়ির বড় বৌ চেয়ে থাকতে পারে হয়ত। উত্তরটা জানা হয় নি। প্রয়োজনই হয় নি বোধহয়।
“বাব্বা, ঢং দেখে আর বাঁচি নে। সতীনপোর ওপর এত দরদ? বলি শেষ পজ্জন্ত টিকবে তো? বট্ ঠাকুরের জেবনখানা একবারে বেথা গেল গো ঠাকুরঝি।”
বিষ ঝাল কাঁচামরিচের আচারে বেশ অনেকটা পরিমাণে সরষের তেল ঢেলে দিয়ে ঝাঁঝটা এদিকে ছুঁড়ে দিতেন মেজকাকী। চোখ তুলে ঝগড়া করতে কোনোদিন দেখিনি নতুন মা-কে। ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি দিয়ে যেন বলত–
” দরদ না হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, কী বলো ভাই, তাই না?”
মেজকাকী কটমট করে তাকাত আমার দিকে। আমি ভয়ে বেশি করে সেঁধিয়ে যেতাম নতুন মা-র আঁচলের তলায়।
দিনের বেলা ভাতের হেঁসেলের ভার ছিল নতুন মায়ের উপর। রাশীকৃত কাটা আনাজের আড়ালে নতুন মায়ের ছোটখাটো শরীরটা ঢাকা পড়ে গেলেই, পড়া ফেলে এক ছুটে রান্নাঘরে পৌঁছে যেতাম আমি। ভয় হত, এই বুঝি মায়ের মত নতুন মা-ও দূর আকাশের তারা হয়ে গেল!
দিন কেটে যাচ্ছিল এমনি করেই। নতুন মা-র আশ্রয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে পনেরোয় পা দিলাম আমি। এর মধ্যে ছোট পিসিমা সাদা থান পরে, চুল কেটে পাকাপাকি ভাবে এসে উঠেছেন এ বাড়িতে। নির্বিকার বাবা আমার তাঁর এই ভগিনীটির বিষদন্ত অধবা, সধবা এবং বিধবা কোনো অবস্থাতেই ভাঙতে পারেন নি।
তবুও দিন কাটছিল। ভালো মন্দ মিশিয়ে, তরতর করে। আমার একটা ভীষণ পছন্দের খেলা ছিল নতুন মা-র শাড়ি, সেমিজ, ওড়না, গয়না পরে মেয়ে সাজা। নতুন মার শোবার ঘরের বিরাট আয়নাটায় নিজেকে নগ্ন করে দেখতে ভীষণ ভালো লাগত আমার। তারপর শুরু হত একটি একটি করে শাড়ি গয়না পরে মেয়ে হয়ে ওঠার খেলা। লোকচক্ষুর অন্তরালে।
স্কুলে যত মেয়েদের সাথে ছিল আমার ভাব। তাদের চালচলন, কথাবার্তা অনুকরণ করতে মন চাইত। আর নিজের শরীর-মনে অনুভব করতাম এক তীব্র পরিবর্তন।
সুজন আমার ক্লাসমেট ছিল। প্রথম প্রেমপত্রটি তার হাতে দিতে প্রথমে সে থমকে গেলেও, পরে হো হো করে হেসে বলল–
আমাকে সজোরে ধাক্কা মেরে ছুটতে ছুটতে পালিয়ে গিয়েছিল সুজন। অকালের প্রবল বর্ষণে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল আমার শরীর। ধুম জ্বর এসেছিল সেই রাতে। নতুন মা সারারাত ধরে গামছা দিয়ে চেপে চেপে গা মুছিয়ে দিচ্ছিল আমার। না, আমি কিচ্ছু ভুলিনি।
এ বাড়িতে আমার ঘর ছিল দোতলায়, দক্ষিণমুখী, বাগানের দিকে। উথাল পাথাল খোলা হাওয়া এসে ভিজিয়ে দিয়ে যেত আমার আঠারো বছরের দেহকে। আমাদের মালী ছিল আজমল। পশ্চিমের ছেলে। নামের মতই কে যেন বহু যত্নে তাকে গড়েছিল। নির্মেদ টানটান চাবুকের মত পেশীবহুল কঠিন শরীরটাকে দু চোখ ভরে দেখেও আশ মিটত না যেন আমার। একটা অদ্ভুত ভাললাগা, অদ্ভুত আবেশ ঘিরে থাকত আমায় সারাদিন, নেশার মত। আমার অবস্থা ঠিক বুঝতে পেরেছিল নতুন মা।
–“সংসারের নিয়মের বাইরে যাস না মুকুর। এ সংসার তোকে ছিঁড়ে ফেলবে।”
এর অর্থ আমি বুঝিনি। কাউকে ভাল লাগলে কেন সংসার আমাকে ছিঁড়ে ফেলবে, এর অতি স্পষ্ট কারণটি অধরাই থেকে গেছিল আমার কাছে।
সেদিন আষাঢ়ের দ্বিপ্রহর। ঝমঝম শব্দে আকাশ ভেঙে পড়েছে তৃষিত মাটির শরীরে। মিলনের শীৎকার আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল আমার শিরায় শিরায়। হঠাৎ দেখলাম আজমলকে। বাগানের শেষ প্রান্তে ছোট্ট চালাঘরে উনুন জ্বেলে কী যেন একটা রান্না করছে। চকচকে কালো পাথরের ভাস্কর্যের মত শরীরটা আমাকে যেন টানছিল বাঁধ ভাঙ্গার আকুতি নিয়ে।
–“দাদা বাবু, আপনি এখেনে? কিছু দরকার ছিল আপনার?”
এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি আমি ওর দিকে।
–“আমাকে তোর ভালো লাগে না আজমল?”
–“এএসব কককি কইছেন দাদা বাবু?”
পাগলের মত ঠোঁট ঘষছি আমি আজমলের গালে-গলায়-বুকে। নখ বিঁধিয়ে দিচ্ছি ওর চওড়া পিঠে।
–“দাদাবাবু কেন রে? আমায় দিদিমনি বলতে পারিস না? আয় না আজমল.. একবার ছুঁয়ে দেখ আমাকে। আমাকে পেতে ইচ্ছে করছে না তোর? কী রে বল..”
বলতে বলতে আমি এক এক করে খুলে ফেলছি আমার পরনের পোশাক। আজমলের হাত ঘুরছে আমার সর্বাঙ্গে। গভীর, আরও গভীর, আরও আরও আরও গভীরে,অতলে ঢুকে যেতে চাইছে ক্রমশ..তীক্ষ্ণ সুখের ধাক্কায় মরে যাচ্ছি আমি..
আচ্ছা, আমি কি স্বপ্ন দেখছি?…স্বপ্নোওওওও..হারিয়ে যেতে যেতে…যেন জলছবি..আহ্ আহ্!… মানুষের শরীরে এত সুখ থাকে কেই বা জানত!
এ কী? দড়াম দড়াম করে এ কীসের আওয়াজ? চালাঘরের দরজায় এমন করে লাথিই বা মারছে কারা? পিসিমা, বাবা, মেজকাকী, ছোটকাকু সবাই মিলে আজমলকে এমন করে মারছে কেন? আমি চিৎকার করে বলতে গেলাম —
–“ও কে মেরোনা। ওর দোষ নেই। আমিই আসলে ওকে..”
কথা শেষ হল না। প্রথমে একটা, তারপর আরও একটা, তারপর চড়ের ওপর চড় এসে পড়তে লাগল আমার গালে। কষ ফেটে গড়াল কাঁচা রক্ত। কোত্থেকে নতুন মা এসে পড়ল আমার উপর, আড়াল করে রাখল আমাকে দু হাত দিয়ে, সেই ছোট্টবেলার মত।
সজোরে লাথি চালাল বাবা। নতুন মার পিঠে। পিসিমা ধরল চুলের মুঠি। মেঘের মত কালো চুলের গোছা উঠে এল পিসিমার হাতে। মারের নেশায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল–
–“আমি আগেই জানতুম, এ মাগীর চালচলন ভালো না। সতীনের ছেলে নিয়ে ন্যাকাপানা.. মা-র চেয়ে মাসির দরদ বেশি। নাই দিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে একেবারে উচ্ছনে দিলে গা।”
নতুন মা নির্বিকার। আজমল রক্তাক্ত। আমিও। শুধু ক্ষরণটা আভ্যন্তরীণ এই যা। বাবা এগোলো। এবার লাথিটা লাগল বুকে। নতুন মা ছিটকে গেল একদিকে। মাথা ঠুকে গেল পাথরে। রক্ত নামছে সিঁথি বেয়ে, গাল বেয়ে, ঠিক যেন সিঁদুরখেলা!
আবার এগিয়ে আসছে পিসিমা। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চুলের মুঠি ধরবে বলে.. ধরে ফেলল প্রায়.. টানতে টানতে আনছে নতুন মা-কে। বাবা পা তুলেছে। আবার একবার মারবে..
আমার বাঁধ ভাঙল। পাশে পড়ে থাকা পাকা বাঁশের লাঠিটা তুলে সজোরে লম্বালম্বি বসিয়ে দিলাম পিসিমার মাথায়। অত লম্বা চওড়া মানুষটা কাটা কলাগাছের মত উল্টে পড়ল বাগানের মাঝ বরাবর। দুর্বা ঘাসে লালের আলপনা। মেজকাকী অজ্ঞান। বাবা হতবুদ্ধি।
নতুন মা চিৎকার করে উঠল-
“পালা মুকুর…পালিয়ে যাআআআ…”
আমি দৌড় দিলাম। প্রাণপণ দৌড়। সেই প্রথম। আমার মা-র স্মৃতি পেরিয়ে, আমার নতুন মা-র আঁচলের তল ছাড়িয়ে, পুরোনো দীঘির মাঠ পেরিয়ে, বুড়ো পীরতলার পাশ দিয়ে, তালবনের ভিতর দিয়ে, সুজনদের বাড়িকে পিছনে ফেলে, আঠারো বছরের সবক’টি মুহূর্তকে সুতীব্র অনিশ্চয়তায় ছুঁড়ে ফেলে, পাকা সড়ানের ধার বরাবর দৌড়..দৌড়.. দৌড়…। যে দৌড় থামার নয় ; যে দৌড় আসলে নিয়ে যায় অসীমের দিকে। সেই অনন্ত ভবিতব্যের টানে কোনো একদিন, ঠিক কোনোভাবে আমি পৌঁছে যাবো আমার নতুন মা-র গড়ে দেওয়া বিশ্বে ; এ জগতের সমস্ত সুস্থ সম্পর্কের লৌকিক হিসেব নিকেশ থেকে আলাদা, এক বিজাতীয় অলৌকিক তৃতীয় বিশ্বে..।।