• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজ সুপ্রতীক চক্রবর্তী

ফারাক

ঝুপ করে সন্ধে নামে গ্রামটায়। ছোট্ট গ্রাম,অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে। বিয়াল্লিশ ঘর বসত করে একসাথে। পাথুরে জমিতে শষ্যের আধিপত্য নেই, তাই পুরুষরা শহরে যায় গতর খাটাতে, কেউ বা ঘরে বসেই মুখোশ তৈরী করে। ছৌনাচের মুখোশ। এ এক সময় সাপেক্ষ কাজ। বুড়ো মোড়ল দুপুরে বলছিলো একসময় পুরো গ্রামটাই নাকি মুখোশ বানাতো, শহরে কাজ পাবার তীব্র তাগিদ তখোনো গ্রামটাতে ঢোকে নি,seasonal migrants তখোনো যে ছিলো না তা নয়,তবে সংখ্যায় কম। তবে এখন কি হোলো?মুখোশের চাহিদা কি কমেছে? এ প্রশ্নের জবাবে অদ্ভুত ভাবে হেসে বললেন “ইতা পয়সা লাই!” বুঝলুম মুখোশ বিক্রীর টাকায় সংসার চলে না ভালো ভাবে। বুড়োও আগে মুখোশ বানাতো,এখন চোখে ছানি পড়েছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি না থাকলে এ কাজ করতে পারা কঠিন নয়, একপ্রকার অসম্ভব। বৃষ্টি হয়নি বহুদিন, এখন গ্রীষ্মের শেষ প্রায়, তবু বাইরে বেরোলে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, একদলা থুতুও জমেনা মুখে। মনে হয় যেনো কোনো রুদ্রদর্শন জটাধারী সন্ন্যাসীর বহুযুগের পুঞ্জীভূত ক্রোধ অভিশাপস্বরুপ নেমে এসেছে গ্রামটার বুকে, তার তেজেই উত্তপ্ত সভ্যতা তৃষ্ণাকাতর। কবিতায় আমার আসক্তি বা অনুরাগ কোনোকালেই নেই। কবিতা পাঠের আসরে আগে যেতাম, তখন অবিশ্যি মনে হোতো যে কবিতার মতো জিনিষ আর দুটি নেই। পাঞ্জাবি আর শান্তিনিকেতনী ঝোলা মাইক্রোফোনের সামনে গলা কাঁপিয়ে স্বরচিত কবিতা পড়লে মোহাবিষ্টের মতো শুনতাম, মানে বোঝার চেষ্টা করতাম। এখন আর করিনা, কারন শুধু উৎসাহই যে কমেছে তা নয়, কিছু সময় অতিরিক্ত আবেগ,অতিরঞ্জিত বিশেষন, ইচ্ছাকৃত দুর্বোধ্য মোহজাল তৈরীর চেষ্টাকে অর্থহীন ও মেকি মনে হয়। মনে হয় এসব কিছু যেনো সেই সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষদের জন্য যাদের রাতের ঘুমটা দিব্যি হয়। এ আমার অশিক্ষা। তবে বিশ্বাস করি এ ব্রহ্মান্ডের সমস্ত কার্যকলাপ ও নিয়মের পেছনে এক অদ্ভুত কাব্যরস খেলা করে যা ভীষন সহজ ও স্বাভাবিক। সেই সহজ সুন্দর কাব্য শিক্ষিত অশিক্ষিতের বিভাজন তৈরী করেনা। সেই কাব্যের উৎসস্থল জিজীবিষা। বেঁচে বর্তে থাকার নিরন্তর সীমাহীন অভিপ্রায়। বেঁচে থাকার দুর্দমনীয় নেশাই আমাদের লড়াকু বানায়।খেজুর গাছটার নীচে হেলান দিয়ে বেশ খানিক্ষন বসেছিলাম, ডায়রী বের করে শিডিউল দেখছিলাম, হঠাত এক তামাকু গন্ধ পেয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই এক বৃদ্ধ কে দেখতে পেলাম। পরনে একটা ছেড়া লুঙ্গী ছাড়া কিছু নয়, বর্ণ তামাটে, হয়তো কৃষক। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, আমিও পাল্টা হাসতে এগিয়ে এলো কাছে। “শশা লাগাইসি, হবেক লাই…” আমার পাশে বসেই প্রথম কথা বললো বৃদ্ধ। বৃদ্ধের হাতের বিড়ি প্রায় শেষের দিকে, মাথার চুল গুলো সব পেকে গেছে, হঠাত আমাকে প্রশ্ন করলো “বিয়া হইসে?” মনে মনে বললুম আমিও আপনার ওই শশা ক্ষেতের মতো। খটখটে, রসহীন কঠিন গদ্যে হানা মনটা কে আর শখ করে নেবে? বিয়ের কথায় মনে পড়লো পাশের গ্রামের মুখিয়ার মেয়ের বিয়ে ছিলো কাল। ছৌনাচের আয়োজন করা হয়েছিলো। জীবনে প্রথম ছৌনাচ দেখেছি কাল রাতে। প্রথম বলাটা ভুল, আগে একবার দেখেছিলাম শিলিগুড়ির এক শপিংমলে। তবে সে জিনিষ আর এ জিনিষ তো এক নয়। খোদ পুরুলিয়ার এক সাওতাল গ্রামে মাঝরাতে ছৌ দেখাটা অন্য ব্যপার। নেশাতুর রাত ছিলো কাল। প্রায় হাজার খানেক লোক গোল হয়ে বসে আছে, আর তার কেন্দ্রে মুখোশধারী শিল্পীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মুলত এটায় পুরুষরাই থাকেন। এখানে বলে রাখা ভালো “ছৌ” কথাটির অর্থ মুখোশ। এর উৎপত্তি মুলত পুর্ব ভারতের গ্রামাঞ্চলে। পুরুলিয়াতে সাড়ম্বরে উদযাপিত হলেও এ জিনিষ সরাইকেল্লা আর ময়ুরভঞ্জেও দেখতে পাওয়া যায়।ফারাক শুধু মুখোশের ব্যবহারে। শোনা যায় ময়ুরভঞ্জের ছৌ মুখোশে কাদার প্রলেপ ব্যবহার করা হয় না। অবাক হয়ে দেখছিলাম মানুষ গুলোকে। অপলকে চেয়ে আছে সবাই। ধুলোয় চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়, উচ্চগ্রামে গান আর বাজনা বাজে (মুলত সানাই, কাসর আর বিগুল), রাত বাড়ে, মানুষ গুলোর চোখে আমোদ ঘনায়, ওরা ভুলে যায় পাকস্থলীর কথা, ভুলে যায় আগুনে আকাশের কথা,ভুলে যায় মুল্যবৃদ্ধির কথা, ভুলে যায় দেনাশোধের কথা!! রুপোলী রুক্ষতার আবেশে ওরা ভেসে যায়, নিশিডাকের মতো ওরা তার পিছু পিছু চলে যায় সব পেয়েছির দেশে। অবাক হয়ে দেখছিলাম শিল্পীদের শরীর গুলো। অদ্ভুত ক্ষমতায় শরীরটাকে বেকিয়ে চুরিয়ে ডিগবাজি খাচ্ছে!!কোনো পালায় রামায়ন বা কোনো পালায় মহিষাসুরমর্দিনী! কখন যে আকাশটায় আলো ফুটলো টেরই পাইনি। আলো ফুটলে স্বপ্ন ভাঙে, মোহ কাটে,বাজনা থামে। ওরা মুখোশ খুলে আমাদের মতো মানুষ হয়ে যায়!!বহু পুরনো এ লোকসংস্কৃতি কে বাঁচিয়ে রাখার দায় যারা কাধে নিয়ে বইছে,তাদের কুর্নিশ জানাই। তারপর থেকেই কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। মাঝেমাঝে এমন একটা সময় আসে যখন মাথাটা পুরো খালি হয়ে যায়। মা,বাবা, প্রেমিকা, বন্ধু কারোর কথা মনে পড়ে না! বোবা দর্শকের মতো বায়োস্কোপ দেখতে থাকি তখন। দৃশ্যের পর দৃশ্য!!ফুর্তির দৃশ্য,আমোদের দৃশ্য,বঞ্চনার দৃশ্য, একের পর এক!!!কোথায় একটা পড়েছিলাম,গ্রামে যাওয়ার সময় শহুরে মলাট ছেড়ে রেখে যেতে হয়!!কিন্তু আমার প্রশ্ন দিনের শেষে সত্যিই কি আমরা – ওরার বিভাজন অস্বীকার করা সম্ভব??? জানিনা। তাই লিখি। আমার কয়েকজন বন্ধু ঠাট্টা করে আমাকে “সাহিত্যিক” নামে ডাকে। আমি জানি আমার লেখা কোনোভাবেই সাহিত্যগুনে সমৃদ্ধ নয়। কারন ভাষার উৎকর্ষতা বা বিশেষনের নান্দনিকতায় আমার উৎসাহ নেই, শুধু যেটুকু দেখি সেটুকুই লিখি। স্বভাবে লিখি,ঠিক যেভাবে ছেলেবেলায় স্ট্যাম্প জমাতাম কিংবা মাঠে খেলতে যেতাম। এখন যেখানে বসে আছি সেখান থেকে পাহাড়ের চুড়াটা দেখা যায়, তবে এখন আধার ঘনাচ্ছে, অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে গোটা গ্রাম। ছাগল গুলো নিয়ে দেহাতি মেয়ে ঘরে ফিরছে, চঞ্চল বাছুর অনিচ্ছা সত্ত্বেও গোয়ালে সেধিয়ে গেল!ঠিক যেনো বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পোয়েটিক ফ্রেম!!একখানি স্কুল আছে গ্রামে। সন্ধেবেলা ক্লাস হয়। কচিকাচা গুলো জমা হয় সেখানে, কারোর খালি গা, ছেড়া প্যান্ট! সারিবদ্ধ ভাবে বেসুরো জাতীয় সঙ্গীত গায়!তারপর ক্লাস শুরু হয়!! আজও হচ্ছে!! শিক্ষক মশায় একটা ছড়ি হাতে পায়চারি করছেন,আর ওরা খাতার সাদা পৃষ্ঠায় “দেশ” দিয়ে বাক্যরচনা করছে। ভোতা পেনসিল, উপড়ে যাওয়া শিষ, থুতু দিয়ে ভুল মুছে ওরা লেখে “আমার দেশের নাম ভারতবর্ষ”, কেউবা লেখে ” আমি আমার দেশ কে ভালোবাসি”। এ লেখা বেরিয়ে আসে ওদের অন্তর থেকে, এতে একফোঁটা খাদ নেই। মাস্টারমশায়!!শুনছেন??ওদের ভালো করে মানুষ করুন!!আর কিছুদিন পর ওদের “দেশ” আর “দ্বেষ” য়ের ফারাকটা বুঝিয়ে দেবেন প্লিজ!নাহলে ওরা কোনোদিন বড় হতে পারবে না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।