• Uncategorized
  • 0

গল্পবৈঠক ৩৪ এর গল্পে ভজন দত্ত

কানাঘুঘু

বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। আর এদিকে ভেতরে এসি চলছে। দ্রুতগতিতে টাটা সাফারির ওয়াইপার মুছে দিচ্ছে উইন্ডস্ক্রিনের জল। পাশ দিয়ে হুসহাস শব্দে মালবাহী ট্রাক গাড়িটাকে চুমু খাবো কি খাবো না, ভাবতে ভাবতে কে জানে কেন শেষ পর্যন্ত পাশ কাটিয়ে যায়।
এখন রাত প্রায় দশটা। অথচ, বাড়ি ফেরার কথা ছিল সন্ধ্যা আটটাতেই। মনে মনে উশখুশ করে আকাশ। বাড়ি ফিরে প্রতিদিনের মত আজও বউয়ের ঝাড় আছে কপালে!
সাফারির স্টিয়ারিং অনমিত্রের হাতে।বন্ধ গাড়ির ভেতরেও ওর ঠোঁটে ঝুলছে বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট।
আকাশ সিগারেট খায় না। খুব অস্বস্তি হচ্ছে ওর। কিন্তু নাকে রুমালও চাপতে পারছে না আবার অস্বস্তির কথা বলতেও পারছে না কিংবা এইরকম বৃষ্টির রাতে গাড়ি থেকে নেমে যেতেও পারছে না। খুব বমি পাচ্ছে ওর তবুও মুখ কেলিয়ে ওকে শুনতে হচ্ছে অনমিত্র-র বলা গল্প। সেই সঙ্গে হুঁ,হ্যাঁ -ও দিয়ে যেতে হচ্ছে।
গাড়ি চালাতে চালাতেই অনমিত্র আকাশকে বলে যাচ্ছে, পাখি শিকারের কথা। ওর নিজের কতগুলি কানাঘুঘু পোষা আছে সেকথাও শুনছে আকাশ।উপায় নেই। অনমিত্র রায়ের গাড়িতে যেদিন থেকে চেপেছে আকাশ, তখনই ও জানে শত বিরক্তিতেও ওর গুণাবলি শুনতে হবে, এবং হুঁ-হ্যাঁ দিতেই হবে।

অনমিত্র আকাশের কলিগ।ওরা দুজনেই এক অফিসের কর্মী। বয়সও কাছাকাছি। তবুও অনমিত্র আকাশকে ‘আকাশদা’ বলে ডাকে।আর রীপাকে, আকাশের স্ত্রীকে বলে বৌদি। পদমর্যাদায় অনমিত্র আকাশের থেকে নীচে হলেও ঠাটেবাটে,গাড়িতে-বাড়িতে,দুজনের মধ্যে বিস্তর ফারাক।তবুও স্বার্থে বা প্রয়োজনেই কাছাকাছি থাকতে হয়।দুজনেরই বাড়ি একই শহরে আর পোস্টিংও একজায়গায়। বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব প্রায় চল্লিশ কিমি দূরে সময়েই অফিস আসতে-যেতে হয়।আকাশের পোস্টিং এর আগে ছিল অন্য এক ব্লকে। সেটা ছিলো ওর বাড়ির অনেক কাছাকাছি। তখন ও চিনতো না এই অনমিত্রকে। এখনকার ব্লকটা বাসস্ট্যান্ডের থেকে আরো তিন কিমি দূরে। প্রথম প্রথম কদিন বাসে এলেও সে বুঝেছিলো, এখানে তাকে যদি ঠিকঠাক ডিউটি করতে হয় তবে দুটো বাইক লাগবে। পরপর দু-দিন দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য বিডিও সাহেব সতর্কও করে দিয়েছেন।ঠিক এমন সময়ে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় অনমিত্র। সে বলে, ‘আরে দাদা,কী দরকার অত কষ্ট করার! আমি তো আপনার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই আসি!আপনাকে বাড়ি থেকে তুলে নেবো।মাঝে মাঝে বৌদির হাতে চা-টাও খাওয়া হবে আমার।’ হাতে যেন চাঁদ পায় আকাশ! সেই থেকে আজ একবছর মত হতে চললো আকাশ অনমিত্র-র গাড়িতেই যাতায়াত করছে।
অফিসের কলিগরা অনমিত্র-র আড়ালে বলে নানান কথা। ওর স্বভাব-চরিত্রের কথা। উপরি আয়ের কথা।চাকরির পাশাপাশি জমির দালালি করা। নামে বেনামে জমি কেনাবেচা করা,প্রমোটারি ব্যবসা করা এবং নারী আসক্তির কথা।
গত একবছরে আকাশ নিজেও কিছু কম দেখেনি! রমা নামের সদ্য বিবাহিতা যে মহিলাটি মাঝে মাঝে সামনের সিটে বসে ওর গাড়িতে আসে,অনেকবার আকাশ পিছনের সিটে বসে ঘুমোবার ভান করে লক্ষ্য করেছে , অনমিত্র ওর গায়ে হাত দেয়।এই হাত দেওয়াটা যেন খুব স্বাভাবিক। আবার কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে গিফটও দেয়,ছোট বা বড় প্যাকেটে।
একদিন কৌতুহলবশত আকাশ জিজ্ঞেস করে ফেলে,’ঐ মহিলাটির সঙ্গে তোমার কেমন সম্পর্ক?’
অনমিত্র গলা খুলে হাসতে হাসতে বলে, ‘ জানেন আকাশদা,একদিন ওর বাড়ি গিয়ে আমার বউ ওকে যে অপমান করেছে, তাতে অন্য কেউ হলে গাড়িতে চাপা তো দূরের কথা, আমার সঙ্গে জীবনেও কথা বলতো না।’
আকাশ বলে, ‘হ্যাঁ,আমিও লক্ষ্য করেছি তুমি মাঝে মাঝেই ওকে এটা সেটা গিফট-টিফট করো। ‘
আবারও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অনমিত্র।বলে, ‘কী বলছেন দাদা,উপহার আমি ওকে যা যা দিয়েছি, সেসব আমি যদি খুলে নিই, তবে রমা পুরো ন্যাকেড হয়ে যাবে। ব্রা,প্যান্টি,শাড়ি, ব্লাউজ, সব গয়না- এমনকি ওর হাতে যে ছাতা ও ব্যাগটা দেখলেন, ওটাও আমারই কিনে দেওয়া।আকাশদা প্লিজ,আপনি আবার এসব কথা আমার বাড়িতে উচ্চারণও করবেন না একদম।তাহলে কিন্তু মারাত্মক অশান্তি হয়ে যাবে।
আকাশ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,’আরে না না। বিশ্বাস করতে পারো আমাকে।

আকাশ ভাবে, ঐ ভদ্রমহিলা রমাকেই।উনি চাকরি করেন।স্বাবলম্বী। ওর হ্যাজব্যান্ডও ভালো পোস্টে কাজ করেন।বাচ্চা-কাচ্চাও নেই!তবুও!কেন?কেন?
মনসমুদ্রে কেন-র উত্তর কেন হয়েই ফিরে আসে। একি শুধুই লোভ! ভোগবাসনা! না কি কোথাও একটু ভালোবাসা!
মনের মধ্যে ভুড়ভুড়ি কাটা প্রশ্নগুলোর উত্তর একদিন জানতে চায় অনমিত্র-র কাছে। ও বলে, ‘সে প্রায় বছর চার আগের কথা।এখানেই রমা তখন সদ্য চাকরিতে জয়েন করেছে। আমি তো তার আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করি।তখন ছিলো ছোট গাড়িটা।তাই নিয়ে আসাযাওয়া করতাম।তো,রমাকে দেখে আমার বেশ ভালো লাগলো। আর,জমি-ব্যবসার দৌলতে আমার হাতে তখন প্রচুর কাঁচা টাকা। রমার অফিসের কণিকাদি আবার আমার পূর্ব পরিচিত। আমি ওনার প্রচুর উপকার করেছি। জমি কেনা,বাড়ির প্ল্যান পাশ করানো,ওর ছেলের প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা — এরকম প্রচুর কাজে আমি ওকে যে সাহায্য করেছি, তাতে উনি যে আমার কথা ফেলতে পারবেন না,সেটা জানতাম। অ্যাকচুয়ালি রমা নামের এই পাখিটিকে ধরার জন্য আমি কণিকাদিকে করি ‘কানাঘুঘু’।
আকাশ বলে, ‘কানাঘুঘু! কা না ঘু ঘু আবার কী?’
‘আরে কানাঘুঘু জানেন না? — কানাঘুঘু ব্যবহার করা হয় পাখি শিকারের বা ধরার জন্য। শিকারিরা প্রথমে একটি পাখিকে পোষ মানায়, তারপর সেই পাখিটির চোখ কোনো কোনো শিকারি আবার অন্ধ করে দেয়।যেখানে পাখি ধরার ফাঁদ পাতে, সেখানে ঐ পাখিটিকে পায়ে বেঁধে তার চারপাশে খাবার ছড়িয়ে দেয়। পাখিটা খায় আর ডাকে।তার ডাক শুনে অন্য পাখিরা এসে শিকারির ফাঁদে পড়ে।তারপর শিকারি ইচ্ছেমত পাখিগুলিকে জবাই করে।তো, কণিকাদিকে আমি আমার মোবাইল নংটি দিতে বলি। বলি,বলুন, অত কষ্ট না করে আমার সঙ্গে আসতে ও যেতে।’
তার দিন পনেরো পরই, সেদিন আমি আবার আরেক জায়গায় যাবো এক কলিগের সঙ্গে। ইনফ্যাক্ট আমরা যাচ্ছি, রাস্তায়।তখনই মোবাইলে এক আননোন নং। আমার মন বললো,এ আমার নতুন পাখির ফোন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে? ওদিক থেকে ও বলছে ‘আমি রমা’।বলতে বলতে গাড়ি চালাতে চালাতেই স্টিয়ারিং ধরে হেসে উল্টে যায় অনমিত্র। হাসি থামিয়ে বলে, ‘আমি বুঝলাম, পাখি ফাঁদে পড়বো পড়বো করছে।’
রমা ফোনে বললো,’আমার শরীরটা খুব খারাপ আমাকে আজ যদি একটু পিক-আপ করে নিতেন…’ ব্যাস।সেই শুরু। তারপর… আর থামা নেই, মাকু চলছে এখনো।দেখছেন তো, বিয়ে হয়ে গেছে তাও…’
আকাশ জিজ্ঞেস করে,’ কেন,বিয়ের পরও কেন, এখনো…?
অনমিত্র বলে,’কেন মানে! জানেন আমি ওর বিয়েতে তিনলাখেরও বেশি টাকার গয়না কিনে দিয়েছি। তাও ওর আশ মেটে নি। আরও একটা নেকলেস চায় আমার কাছে। আমি বলেছি দেব,দেব।বলেই সেই খ্যাক খ্যাক করে হাসিতে গাড়িটা ভরিয়ে তোলে।

উফ! ঝড়বাদলের এমনদিনে শেষ অব্দি আকাশ সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাড়ি ঢুকলো যখন, তখন বৃষ্টি অনেকটাই থেমে গেছে।কলিংবেল না বাজিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলো ওদের বছর পনেরোর একমাত্র মেয়েটা পড়ার টেবিলে ঘুমিয়ে পড়েছে।ওর স্ত্রী রীপা বেডরুমে মোবাইলে মগ্ন। আকাশ শব্দ না করে জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে যাবে…, হঠাৎ রীপার কথায় টনক নড়লো। ও আজ ওর কেনা একটা সুন্দর হাউসকোট পরেছে।খুব মিষ্টি লাগছে রীপাকে। মনে মনে আকাশের রোমান্স এলো।
রীপা বললো,’কী গো,এত দেরি?’ আকাশের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আরো বললো,’যাও আমি আর পারছি না,ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।ঘুমও পাচ্ছে খুব। খাবার মাইক্রোওয়েভে রাখা আছে গরম করে খেয়ে নিও। আমি আবার দেখি মেয়েটাকে,সে আবার ঘুমিয়ে গেল না কি! শুইয়ে দিই তবে তাকে।’

কথা কটা যন্ত্রের মত বলে রীপা ওদের মেয়ের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আকাশও বাথরুমে ঢুকে। স্নান সেরে, খাবার গরম করে খেতে খেতে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখল, রীপা অনলাইন। আরো কত কতজন অনলাইন। অনমিত্র ও অনলাইন।
খাবার খেয়ে একটা পত্রিকা টেনে একটু উল্টেপাল্টে দেখে যখন বেডরুমে ঢুকলো, দেখলো রীপা এখন শুয়ে। আগে না দেখা নতুন একটা দামি স্লিভলেস নাইটি পরে আছে।ওর ফর্সা পায়ের হাঁটুর ওপর উঠে আছে নাইটি।খুব সুন্দর লাগছে রীপাকে। ওকে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু, এই নাইটি রীপা কোথায় পেল? ও তো নিজে একা কিছুই কেনে না! তবে! সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে অনমিত্র ওদের বাড়িতে এসেছিলো।হ্যাঁ, মনে পড়ছে, ওর হাতে সেদিন কাগজে মোড়া একটা ছোট্ট প্যাকেটও ছিলো। আকাশ রীপার দিকে তাকিয়ে ভাবে, তবে!
তবে, সেও কি কানাঘুঘু হয়ে যাচ্ছে!
বেডসাইড টেবলের আলো নিভিয়েও আকাশ স্পষ্ট দেখতে পেল,অনমিত্রর চকচকে লোভী দুটো চোখ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।