• Uncategorized
  • 0

গল্পসল্পে সোমা চট্টোপাধ্যায় রূপম

ড্রেসিংটেবিল

__ আরে না রে বাবা, পুরো মেঝে ওষধি কাঁচ থাকবে, যাতে শাড়ির কুঁচির নিচ ওবধি দেখা যায়। আর দুপাশে ছোট ছোট তাক করা থাকবে, জিনিস পত্র রাখার জন্য অবশ্য ওগুলোতেও কাঁচের দরজা থাকবে।
আর সাথে কয়েকটি ড্রয়ার থাকবে।
টানা বিয়াল্লিস মিনিট ধরে আর্য কে বুঝিয়ে থামলো পারো, মানে পারমিতা।ওরা গত ছমাস ধরে চূড়ান্ত প্রেম করে এবার বাঁধা পড়তে চলছে সাত জন্মের জন্য। এসব তারই পরিকল্পনা। হেয়ার স্টাইল থেকে কসমেটিকসের তত্ত্ব সব প্ল্যান করে চলেছে দুজনে। অবশ্য বেশিরভাগ সময় পারো বলে আর আর্য শোনে। এই হল দুজনের রোজকার রুটিন।
ওদের দ্যাখা হয়না মাসে একবার ও। এই ছমাসে মোট দ্যাখা হয়তো চারবার কি পাঁচবার হবে তাও ওরা একে অন্যকে ছেড়ে থাকতে পারে না। গানে-গল্পে-তত্ত্বে ভরে থাকে ওদের সকালগুলো আর রাতগুলো আরও গভীর হয়ে ওঠে ওদের ভালোবাসা মাখানো অপেক্ষায়। এভাবেই গড়ে উঠেছে একটা অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, যা ওদের চালনা করে প্রত্যেক মুহুর্তে। দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও দুটো মাস। বসন্ত ফিরে গ্যাছে নিজের সংসারে। গরম নিজের ডানাপালা বিছিয়ে কৃষ্ণচূড়ার পাপরি আশ্রয় নিয়েছে। ২৫শে এপ্রিল।ওদের বিয়ের দিন। একসাথে একাত্ম হতে চলেছে ওদের দুটো আত্মা।
দুই বাড়িতেই প্রচন্ড ব্যস্ততা। উঠোনের ঝাড়বাতিটা ঠিক সময়ে জ্বলে উঠে জানালো এই বাড়িতে এই শেষ ভাত পারমিতার। আজকের পর ও আর দাসগুপ্ত বাড়ির মেয়ে নয়, ও হবে আর্য ভট্টাচার্যের স্ত্রী পারমিতা ভট্টাচার্য। বাড়ি ভর্তি বড়রা একচামচ করে খাবার তুলে দিলেন ওর মুখে। কোথায় যেন কিছু নেই মনে হল পারমিতার,মেয়েজন্ম যে।
সকাল সকাল সেজেগুজে তৈরি পারমিতা হলদেটে শাড়ি আর ফুলের গহনাতে অপূর্ব লাগছে ওকে। ফোনটা বেজে ওঠে নিয়ম মাফিক সকাল ৮:২০ তে। আর্য। আজ আর কোনো গুড মর্নিং না ” সমুর থেকে মনে করে নিয়ে নিও। আর এত নিয়ম না মেনে একটু কিছু খেয়ে নিও, সমু কে সব বলা আছে। ও থাকবে তোমার কাছে। ” ফোনটা কেটে যায়।
এই এক স্বভাব ছেলেটার, না বলেই ফোন রেখে দেয়। সমু হল আর্যের বন্ধু, বয়েসে একটু ছোটোই। ওকে দিয়ে আর্য কয়েকটা চকলেট আর বিস্কিট পাঠিয়েছে পারোর জন্য। গায়ে হলুদের পর একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই, পারো ও। সাজগোজ করে বউ সাজতেই সন্ধ্যে হয়ে যায়। শুরু হয় বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা।
বেনারসি থেকে ধুতির কোঁচা সবটা পরিকল্পনা মাফিক করেই বিয়েটা সেরে ফেলল দুজনে সন্ধেলগ্নে বিধি নিয়ম মেনে।
ঋণ শোধ করে পারমিতা চলল নতুন সংসারের দিকে আর্যর হাত ধরে।
গত তিনটে দেন খুব ব্যস্ততার মধ্যেই কেটেছে দুজনের। আইবুড়ো ভাত থেকে কনে বিদায় আর তারপর আজ সকালের বৌভাত চলছিল খুব ভালোই, কিন্তু বিপত্তিটা হল দুপুর তিনটে নাগাদ হবে। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন আঁজলা ভরে পান করেই চলেছে আর আকাশও কসুর করেনি বারিধারা উজার করে দিতে ঠিক যেমন আর্য কখনও কসুর করে নি কোনো কিছুর খামতি রাখতে পারো জীবনে তেমনই।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শেষ হলো পুরুষ ও প্রকৃতির প্রেম পর্ব, বৃষ্টি থামলো।
পারমিতা তখন পরিণীতা হবার প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ। নামি মেকাপ আর্টিস্ট নিখুঁত ভাবে এঁকে চলেছেন মাসকারা আর পারো দিয়ে চলেছে ওর আর্যর স্বপ্নের বিবরণ।যেমনটা আর্য চাইতো ঠিক সেরকমই লাগছে পারো কে, লালচে মেরুণ রাজস্থানি পোশাকে ভীষন সুন্দর হয়ে উঠেছে ওদের সন্ধেটা।
বৃষ্টি টা ভ্যাপসা গরমটা কমিয়ে একটা সুন্দর আবহাওয়া তৈরি করেছে। আর্যর বাবা মা ভীষণ ব্যস্ত আজ নববধূর সাথে সবার আলাপ করানো, খাওয়াদাওয়া সবটাই তো একা হাতে। আর্য এখনও একবারও পারো কে ফাঁকা পায়নি, একটু সময় ও পায়নি ওকে চোখ ভরে দেখার।
রাত প্রায় ১টা হবে, সবাই খাওয়া শেষ করে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার ব্যস্ততায় রয়েছেন। যতরকম আচার অনুষ্ঠান শেষ করে আর্যর মা ওদের ঘুমোনোর অনুমতি দিলেন। সলজ্জ মুখেই দুজনে ঘুমানোর উপক্রম করছে কিন্তু ভাইবোনেরা ছাড়বে কেন! সবাই বেশ কিছুক্ষন ধরে ওদের নিয়ে হাসিমজা করছে, তখন একরকম প্রায় জোর করেই ওদের বিদায় করল আর্য।
এতক্ষনে একটু একা পাওয়া গেছে ওর পারো কে। পারমিতা তখন গায়ের গহনা গুলো খুলছে। আর্য আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে পারো কে জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে। ড্রেসিংটেবিলের নতুন কাচটায় পারো দেখলো ওরা দুজন মিশে যাচ্ছে সেই স্বপ্নের দেশটায় যেটা কল্পনায় ওরা দেখেছে বহুবার। পারো আর তাকাতে পারছে না নিজের দিকে, এমনকি ড্রেসিংটেবিলটার দিকেও নয়। জুঁই ফুল আর গোলাপের গন্ধটা ভীষণ প্রকট হয়ে উঠছে, রাতটা এগোচ্ছে ভোরের দিকে খুব তাড়াতাড়ি।
এখন প্রায় ভোর, সবাই ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। পারো ঘুমতে পারেনি সারারাত। আর্যর ঘুমন্ত মুখটা ওর খুব নিজের বা হয়তো শুধু ওরই। কত পরিকল্পনা করতো ওরা দুজন একে অন্যকে নিয়ে। সেই স্বপ্ন গুলোই একে একে পূর্ণ হয়েছে ওদের, এমনকি ড্রেসিং টেবিলের ডিজাইনটাও।আবার বৃষ্টি এল।আর্যর মাথাটা ওর কোল থেকে সরিয়ে বালিসটা দিয়ে ও উঠে গেল জানালাটা খুলতে। একপশলা বৃষ্টি এসে ওকে আবার নিয়ে গেল ওর প্রেমবেলার দিনগুলোতে। কীভাবে যেন প্রেমটা হয়ে গেছিলো!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।