• Uncategorized
  • 0

গল্পে ঔরশীষ ঘোষ

১৯৯০ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর জন্ম। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় 'যাযাবর' পত্রিকার ২০১১ বইমেলা সংখ্যায়। প্রথম কবিতার বই "ক্লাউনের ডার্করুম" প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে আর তার দুই বছর পর ২০১৮ কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতার বই "জন্মদাগ হ্রস্বস্মৃতি"৷ সহ সম্পাদনা করেছেন 'চার্বাক' পত্রিকা, এবং অতিথি সম্পাদক হিসেবে 'জানলা', 'শব্দযান' প্রভৃতি পত্রিকার সাথে যুক্ত থেকেছেন নিয়মিত৷

চীনের ডাক্তার

১।

ফোনকলটা এসেছিল রাত দশটার দিকে। ডিনারের পরে সবে শুতে যাচ্ছিল অরুণাভ। হঠাৎ এমন ফোনকলে প্রথমে বেশ বিরক্তই হয়েছিল সে। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলবার পর সেই বিরক্তি ক্রমশ উৎকন্ঠায় পরিনত হয়৷ সিম্পটম সব অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। ঝটতি রাতের পোষাক ছেড়ে নিজের ওভারকোট, মেডিক্যাল বক্স মুখোশ গ্লাভস ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে নেমে আসে সিঁড়ি বেয়ে। দোতলার ঘরে নক করতেই বসুন্ধরা দরজা খোলে। এত রাতে ওকে আবার বেরোতে দেখে মুখে একটা কালো ছায়া খেলে যায় তার। তবে মুখে কিছু বলে না। বরের এমন রুটিনের সাথে সাত বছর হয়ে গেল সে পরিচিত। এখন অনেকটা অভ্যস্তও বলা চলে। অরুণাভ নিজেই বলে, ‘মনে হচ্ছে আরেকটা কেস এসেছে’, তারপর কথা না বাড়িয়ে গ্যারেজে ঢুকে নিজের স্যান্ট্রো স্টার্ট দেয়৷ গাড়ির শব্দ মিলিয়ে গেলে আনমনেই একবার কপালে হাত ছোঁয়ালো বসুন্ধরা।

২।

তিলজলার এই অঞ্চলে সে আগে কখনো আসেনি৷ বাড়ির ভিতর বাড়ি তার ভিতর গলি তস্য গলি কারো রান্নাঘরের মধ্যে দিয়ে তো কারো স্নানঘরের পাশ দিয়ে অরুণাভকে নিয়ে চলেছেন ভদ্রলোক। মধ্য তিরিশের হবেন, নর্থ ইস্টের। সম্ভবত মণিপুরী। ভাঙা বাংলা বলেন। কাঁচাপাকা চুল আর কুতকুতে চোখের পাশে চামড়ার অসংখ্য ভাঁজ দেখে মনে হয় হাজারো চিন্তা শকুনের মত ভিড় করেছে তার মস্তিষ্কের অন্দরে। তবু ঠোঁটে যেন প্রায় জোর করেই একটা তেরচা হাসি ফুটিয়ে রেখেছেন৷ দেখতে দেখতে একটি পুরোনো ঝরঝরে দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো তারা। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা নর্দমার কালো জল আর তারপাশে বছর বছর ধরে জমতে থাকা আবর্জনার পাহাড়। চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর এই জায়গায় যে মানুষের বসবাস হতে পারে তা সে কল্পনাও করতে পারে না৷ লোকটি দরজায় সন্তর্পণে টোকা দিতেই দরজা ঝটিতে খুলে গিয়ে ওরা ঢোকবার সাথেসাথেই আবার বন্ধ হয়ে গেল৷ ঘরের ভিতর চাপচাপ অন্ধকার আর একটা ভ্যাপসা গন্ধ। অরুণাভর মনে হলো যেন স্বয়ং মৃত্যু আতিথ্য গ্রহণ করেছে এই বাড়িতে।

৩।

মাত্র দুটো ঘর, তারমধ্যে তিনজন বাসিন্দা। মনে মনে শিউরে উঠলো অরুণাভ। যদি তার ধারণা সত্যি হয় এরা সকলেই এখন আক্রান্ত। নিজেকে মানসিক ভাবে শক্ত করার চেষ্টা করে সে। ধীর পায়ে প্রবেশ করে পাশের ঘরটায়।
ড্যাম্প ধরা দেওয়াল, টিমটিমে বাল্ব, চতুর্দিকে কাপড় জামার স্থুপ, ফাঁকা ওষুধের রাংতা আর শিশি বোতলের মাঝে ষোলো সতেরো বছরের একটি কংকালসার মেয়ে শুয়ে আছে। চোখদুটি একসময় প্রাঞ্জল ছিলো হয়তো, এখন দেখলে শক্তি চাটুজ্যের একটি লাইন মনে পড়ে যায়, ‘অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে’৷ মুখে মাস্ক চাপিয়ে সে মেয়েটির কাছে যায়। বেশ কিছুক্ষণ নানান পরিক্ষা চালিয়ে যা বুঝতে পারে তা সুবিধের নয়৷ একবার ওষুধের শিশি বোতলের দিকে তাকায় সে, লোকাল ডিসপেনসারি থেকে নিয়ে আসা লোকাল ওষুধ সব। অবশ্য সাধারণ ফ্লু জাতীয় রোগ এতেই নিরাময় হয় যায়৷ কথা বলে জানতে পারে ঘুষঘুষে জ্বর আর খুসখুসে কাশিতে প্রায় হপ্তাখানেকের বেশি সময় ধরে ভুগছে সে। সাথে গলা ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট। প্রাথমিক দাওয়াই দিয়েছে কয়েকদিন কিন্তু কাজ তো দেয়ই নি, বরং বারবার জ্বর ফিরে আসায় এবং গত পরশু থেকে প্রলাপ বকা শুরু হওয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাড়ার এক বৃদ্ধ ডক্টরের কাছে। সেই ডক্টর হাতুড়ে গোছের হলেও অভিজ্ঞতার বশে খারাপ কিছু টের পেয়েছিল৷ কিছুদিন আগে সে অরুণাভকে দেখেছিল একটি টিভি শো-তে নতুন ভাইরাল জ্বরের সম্পর্কে কথা বলতে। সেই কথা মনে হওয়ায় ভদ্রলোককে তার সাথে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।
নানানভাবে চেক করে নিজের আশঙ্কা সত্যি মনে হয় তার। উঠে পড়ে সে। সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে হয়তো। তবু দৃঢ় কন্ঠে বলে, কাল সকাল দশটায় যেন সপরিবারে তারা তার নার্সিংহোমে ভিজিট করে। শুনে ভদ্রলোকের মুখে অন্ধকার নেমে আসছে দেখে, এবার একটু হাল্কা সুরে আশ্বাস দেয় পয়সা কড়ির কথা চিন্তা না করতে। অবশ্য এর পিছনে একটি উদ্দেশ্য যে ছিল না তা নয়। এতদিন ধরে এই ভাইরাসের গতিবিধি সম্পর্কে পড়াশোনা করলেও জলজ্যান্ত কোনও কেস সে হাতে পায়নি এখনো। সামনে তিনটে গিনিপিগ দেখলে কোন সায়েন্টিস্টের না লোভ হয়৷
ফেরার পথে এক অদ্ভুত দৃশ্য খেয়াল করলো অরুণাভ। গলির ভিতর দিয়ে আসবার সময়ে নানান মানুষজন ঘুরে ঘুরে তাদের দিকে তাকাচ্ছে। পাড়ার রকে বসে কয়েকটি ছেলে ছোকরা তাস পেটাচ্ছিল, তারা হঠাৎ খেলা থামিয়ে একবার তার দিকে তারপর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থেকে অরুণাভর হ্যান্ডব্যাগের দিকে চেয়ে রইলো সন্দেহজনক ভাবে। অরুণাভ নিজে নর্মাল পোষাকে থাকলেও তার ব্যাগে লাগানো লাল ক্রশ দেখে  জীবিকা চিনতে সময় লাগে না।

৪।

সকাল সকাল নার্সিংহোম খুলে সদ্য বিদেশ থেকে ইমপোর্ট করা মেডিক্যাল কিটগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলো অরুণাভ। মন আজ বেশ উৎফুল্ল তার৷ সর্বক্ষণের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেফি তা টের পেয়ে এসে হপ্তাখানেকের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে গেছে। বেশ পাকাপোক্ত মেয়ে স্টেফি, পুরো ব্যবস্থা প্রায় একা হাতে ম্যানেজ করে। সে নিজে আর কতটুকু সময় পায়! আজ সেমিনার তো কাল টক শো এই করেই সময় পেরোয় তার৷ নিজে ট্রিটমেন্ট করা দুবছর হল বন্ধ করেছে। খুব ঘোড়েল অপারেশন ছাড়া আজকাল আর ইনভলব হয় না৷ সদ্য মেডিক্যাল পাশ করা বেশ কিছু ইয়ং ডক্টর বহাল করেছে, সাথে পুরোনো কলিগরা তো আছেনই। তাদের ওপর পূর্ণ ভরসা আছে তার। তার এই রাজত্ব তো একদিনে তৈরী হয়নি। চারা রোপণের মত মাত্র একটি ছয় বাই আট ফুটের কার্ডবোর্ড ঘেরা কামরার ভিতর সত্তর টাকা ভিজিট নিয়ে রুগী দেখা শুরু হয়েছিল এগারো বছর আগে। তবে সে জানতো তার লক্ষ কী এবং সে যথেষ্ট সুচারু ও সফলভাবে এখনো এগিয়ে চলেছে সেইদিকে।
বেলা সাড়ে এগারোটার আশেপাশে সে তার কেবিনের কাচ দিয়ে দিয়ে দেখলো সেই ভদ্রলোক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে বেশ ভয়ভয় প্রবেশ করছে। স্টেফিকে জানানো ছিল। সে সুরক্ষাজনিত দূরত্ব বজায় রেখে বেশ হাসিখুশি মুখে আপ্যায়ন করে তাদের নিয়ে গিয়ে একটি কেবিনে বসালো। ইচ্ছাকৃত প্রায় মিনিট পঁচিশের কাছাকাছি তাদের ওভাবে বসিয়ে রাখার পরে ঘরে ঢুকলো অরুণাভ। তাকে দেখে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু আলগাভাবে হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিল সে।

 ৫।

সেদিনের পর প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। চীনের উহান নগর থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া এই ভাইরাস এখন সকলের পরিচিত। প্রাথমিকভাবে নিউজ চ্যানেলে নানান খবরের মাঝে চীনের ফুটেজ দেখানো হত, এখন সেসব চ্যানেল সর্বক্ষণ দেখিয়ে চলেছে নানান দেশের এমনকি ভারতে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস আক্রান্তের তালিকা। বাদ নেই ইটালি বা আমেরিকার মত প্রথম সারির দেশগুলো৷ ভারতে দেখা মিলেছে মোট সতেরোজন ভিক্টিমের। তবে এই সংখ্যা যে আর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই কয়েকশো গুন বেড়ে যেতে পারে সেই আশঙ্কা অমূলক নয়৷
অরুণাভ নিজের চেম্বারে বসে খবর দেখছিল, এমন সময়ে স্টেফির প্রবেশ। টিভি স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে চোখে প্রশ্ন নিয়ে স্টেফির দিকে তাকালো সে। স্টেফি একটু অস্বস্তির সাথে জানালো ‘জ্বর আবার বাড়ছে মহিলার’।
এইখানে বলে রাখা ভালো অরুণাভ সেদিন ওই পরিবারের তিনজনকে নানানরকম পরিক্ষা করে, এমনকি থার্মাল টেস্টিং করে যা বুঝতে পারে, ভদ্রলোক  আক্রান্ত না হলেও তার বউ এবং কন্যা দুজনেই এই রোগের শিকার৷ সঙ্গেসঙ্গে তাদের অ্যাডমিট করে নিয়ে যাওয়া হয় আইসোলেশন ওয়ার্ডে। দু সপ্তাহ ধরে তাদের ওপর নানান চেনা অচেনা ওষুধের ব্যবহার করেছেন তিনি৷ কথা বলেছেন দেশি-বিদেশি নানান বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। ওষুধ যে কাজ দেয়নি একদম তা নয়। মেয়েটি ধীরে ধীরে সেরে উঠছে বলেই তার বিশ্বাস৷ শ্বাসকষ্ট কমেছে কিছুটা, জ্বরও আর বারবার ফিরে আসছে না, বা এলেও তা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে যাচ্ছে না। কাশি রয়েছে এবং শরীর ও মাথার যন্ত্রণাও যে কমেনি তা পরিষ্কার, তবে সবমিলিয়ে ইম্প্রুভমেন্ট হচ্ছে বলা চলে।
অন্যদিকে মহিলার পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রলাপ বকা, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ডায়রিয়া, দমকা শুকনো কাশি ও শ্বাসকষ্টের প্রোকপ বেড়ে চলেছে উত্তরোত্তর৷ কোনওরকম ওষুধই যে কাজ দিচ্ছে না তা তিনি ভালোই বুঝতে পারছেন৷ কিন্তু কিছু করার নেই তার৷ নিয়তি যাকে ডাকে তাকে কে বাঁচাতে পারে!
স্টেফির কথা শুনে সিট ছেড়ে উঠলো অরুণাভ। গিয়ে সে কিছুই করতে পারবে না জানে। বড়জোর সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে মহিলাকে। ইদানিং সিডেটিভেও যে খুব কাজ হচ্ছে তা নয়। কড়া ডোজ দেওয়া সত্বেও বেশ কিছু সময় ধরে জেগে থাকছেন মহিলা। তবু একবার দেখে আসা দরকার। তার মুখ দেখলে হয়তো কিছুটা মনের জোর পেলেও পেতে পারে।

৬।

নদীর যেমন এক পার ভাঙলে অন্যপার গড়ে ওঠে, পৃথিবীর যেমন একদিক আলোকিত হলে অন্য পিঠ হয়ে ওঠে অন্ধকারাচ্ছন্ন, টসে যেমন একজন জিতলে অন্যজনকে হেরে যেতে হয়, শিল্পে যেমন চূড়ান্ত আনন্দের সহাবস্থানে রয়েছে অফুরন্ত বিষাদ, সেভাবেই অরুণাভ দেখে যায় কিভাবে মা ও মেয়ের স্বাস্থ্য পরিবর্তন ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। যতবেশি ঘড়িকাঁটা এগিয়ে চলেছে মহিলার স্বাস্থ্যের অবনতি লক্ষ্য করার মত। সারাক্ষণ অক্সিজেন দিতে হচ্ছে তাকে, সঙ্গে স্যালাইন কারণ খেতে গেলেই কাশির দমকে বমি হয়ে যায় সমস্ত খাওয়ার, শরীরের তাপমাত্রা চড়ে যাচ্ছে একশো পাঁচ ছয় ডিগ্রীর কাছাকাছি… মনে মনে প্রমাদ গোনেন ডক্টর। আর বড়জোর কয়েকদিন, তার বেশি লড়তে পারবেন না মহিলা।
অন্যদিকে প্রায় সম্পূর্ণ সেরে উঠেছে মেয়েটি৷ ফ্যাকাশে শরীরে এসেছে গোলাপি আভা। নিস্তেজ কোটরাগত চোখে ঝলমল করছে যেন ভোরের শিশির। কাশি আর জ্বর প্রায় নেই বললেই চলে, শ্বাসকষ্ট আর মাথার যন্ত্রণা কয়েকদিন হল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ৷ কৈশোরের স্বাভাবিক চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে তার মধ্যে। দুদিন আগে একটি থরো চেকাপ হয়ে গেছে তার এবং রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। মৃত্যুকে কিস্তিমাৎ করেছে মেয়েটি। হপ্তাখানেক পর তাকে আরেকবার চেক করে ক্লিনচিট দেওয়া যেতে পারে। ভাবতেই মন তার আনন্দে ভরে ওঠে। ভারতের প্রথম সাক্সেসফুল কেসটি যে তার নার্সিংহোম থেকে বেরোবে এতটা সে কখনো আশা করেনি। এবার তার জীবনের দ্বিতীয় ধাপ আসতে চলেছে যখন সে শুধু দেশে নয় বিদেশেও সম্মান ও অভ্যর্থনা কুড়োবে এবং সেই সঙ্গে জমে উঠবে টাকার পাহাড়। এত টাকা যে সে আর বসুন্ধরা দুজন মিলে সারা জীবন ধরে গুনলেও শেষ হবে না!
এতকিছুর মাঝেও শুধু একটাই দুশ্চিন্তা বারবার বিরক্ত করছে অরুণাভকে। মেয়েটির বাবা আজ প্রায় দিন দশেক হল আসেনি নার্সিংহোমে। বিষয়টি খাপছাড়া কারণ এতদিন প্রত্যহ এসেছেন ভদ্রলোক। কাচের দেওয়ালের ওপাশ থেকে মেয়ে এবং স্ত্রীর দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন নিষ্পলক চোখে। তারপর প্রায় প্রতিদিন চলে যেতেন চুপচাপ। কখনো তিনি স্টেফিকে অনুরোধ করতো অরুণাভের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। অরুণাভ বিরক্ত হত না। ভদ্রলোক তার লটারির টিকিট। নিজের ভাগ্যকে তোয়াজ না করলে ভাগ্য মানুষকে দেখভাল করতে যাবেই বা কেন! তাকে এনে বসাতেন কেবিনে, চায়ের বন্দোবস্ত করে স্ত্রী ও কন্যার স্বাস্থ্য ছাড়াও আরো নানান কথা বলতেন। ভদ্রলোক এক লোকাল গ্যারাজে সিনিয়র মেক্যানিক। আয় ওই তিনটে পেট টেনেটুনে চলে যাওয়ার মত। আবাস মণিপুর হলেও বারো বছর বয়সে রুটির ধান্ধায় পাড়ি দিয়েছিল কলকাতা। সেসময় ভোরবেলা কাগজ ফিরির কাজ পায়, ঠিকানা ছিল ঢাকুরিয়া স্টেশন৷ নিজের গরজেই গাড়ি সারাইয়ের কাজ শেখে মদের ঠেকে দেখা হওয়া আফরোজ বলে এক বন্ধুর থেকে। সেই আফরোজের দয়ায় জুটে যায় এই গ্যারেজের চাকরি। ভদ্রলোকের নিজের মেয়ের প্রতি অপত্য স্নেহ দেখে মন নরম হয়ে যেত অরুণাভর। নিঃসন্তান সে। বসুন্ধরা কোনওদিনই মা হতে পারবে না। সেকথা অবশ্য বসুন্ধরা জানে না। অরুণাভ অত্যন্ত সুচারুভাবে এই সংবাদ শেষ চার বছর ধরে গোপন করে এসেছে বসুন্ধরার থেকে। যে কোনও মেয়ের কাছেই এমন সংবাদ মৃত্যুর নামান্তর। এই দুঃখটা সে কখনোই দিতে চায় না তাকে। অত্যন্ত ভালবাসে সে বসুন্ধরাকে। সন্তানের ইচ্ছে যে তার বুকেও আঘাত হানে না তা নয়। তবে সেই দুঃখের থেকে বসুন্ধরার আনন্দকেই সে চিরকাল প্রাধান্য দিয়ে এসেছে।
ভদ্রলোকের হঠাৎ নিরুদ্দেশ বেশ চিন্তায় ফেলেছে তাকে। এমন এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস তারপর এই ভাইরাসের প্রকোপ শহরে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। প্রতিদিনই এক বা একাধিক আক্রান্তের খবর ছড়িয়ে দিচ্ছে মিডিয়া। মানুষের মনের গোপনে নিজের অজান্তেই কালো হচ্ছে আকাশ। দিন দুই আগে এক অফিসবয়কে সে পাঠিয়েছিল ভদ্রলোকের সন্ধানে। সে ঠিকানা চিনতে না পেরে ফিরে আসায় খুব একটা অবাক হয়নি সে। বরং ছেলেটি যে ওই গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায়নি সেইজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছিল।

৭।

আরো হপ্তা দুয়েক কেটে গেল।
মেয়েটি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
সারাদিন বাবা ও মায়ের কথা জানতে চায়৷  স্টেফি ও অন্যান্য নার্সরা যথাসম্ভব ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে বটে কিন্তু সে আর কতক্ষণ!
এরই মাঝে অরুণাভকে একবার লন্ডন ঘুরে আসতে হয়েছে। ফিরে খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে ভদ্রলোক আসেনি এতদিনেও। বারংবার ফোন করা হয়েছে কিন্তু সেই নম্বর সুইচড্ অফ।  এবার বেশ চিন্তা হয় তার।
মহিলাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে দুদিন হল। আর চব্বিশ ঘন্টাও নেই বোধহয় হাতে। অক্সিজেন পাম্প করেও কাজ হচ্ছে না, সাথে নানান অর্গান ফেল করছে একে একে৷ হার্টবিট প্রায় তিনগুণ বেশি দ্রুত।
অরুণাভ ঠিক করলো আজ সন্ধ্যায় সে মেয়েটিকে নিয়ে যাবে ভদ্রলোকের খোঁজ করতে।
সন্ধে ছটা নাগাদ গাড়িতে মেয়েটিকে বসিয়ে রওনা দিলো অরুণাভ। অফুরন্ত কথা বলতে বটে মেয়েটি৷ তার সাথে বেশ খোশমেজাজে আড্ডা শুরু করে দিয়েছে চাকা গড়ানোর পরেই। বলে যাচ্ছে তার স্কুলের কথা, বান্ধবীদের গল্প, দুবছর আগে তারা মণিপুরে দেশের বাড়ি গিয়েছিল, সেই প্রথম তার দূরপাল্লার রেল যাত্রা, প্রথমবার পাহাড় দেখা। তার ঠাকুমা কেমন একা থাকে সেখানে, কী অসাধারণ শুয়োরের মাংস রান্না করতে পারে তার মা, বাবা তাকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেবে বলেছে, ঠিক যেমন ফোন তার বান্ধবীর কাছে আছে। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল তার। অজস্র গল্পের সুতোর বুনোটে কখন যে তারা তিলজলায় পৌঁছে গেছে সে খেয়ালই ছিল না কারো।
গাড়িটা পার্ক করে আবার সেই গলির ভিতর প্রবেশ করলো তারা। মেয়েটি অত্যন্ত খুশিমনে তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললো সেই অজগরের পেটের মধ্যে দিয়ে। একা এলে কখনোই সে রাস্তা চিনতে পারতো না। মেয়েটি এখনো গল্প করে যাচ্ছে আর সে তা মশগুল হয়ে শুনছে। হয়তো সে কারণেই দুজনের কেউ খেয়াল করলো না পিছনে দূরত্ব বজায় রেখে ক্রমশ একটি জটলা তাদের পিছু নিয়েছে। প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পর তারা এসে উপস্থিত হল ওরা তার বাড়ির দরজায়৷ অরুণাভ দরজায় নক করার আগেই মেয়েটি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে ধাক্কা দিয়েছে পাল্লায়। পাল্লা বন্ধ ছিল না। বহুকালের পুরোনো কাঠ বেশ কর্কশ শব্দ করে ধীরে অল্প ফাঁক হয়েছে।  ভিতরে থইথই করছে অন্ধকার। মেয়েটি প্রবেশ করলো সেই অন্ধকারের পেটে। পিছনে অরুণাভ কয়েক সেকেন্ড দ্বিধা করে ঢুকে পড়লো তাকে অনুসরণ করে। এই প্রথম তার মন একটি কু ডাক দিল। কে যেন ভিতর থেকে বলে উঠলো এক্ষুণি পালাও এখান থেকে। ঘরের ভিতর আরেকটি ঘর, সেটাও পাল্লা বন্ধ করা ঠেসে। দরজা খুলতেই একটি অসহ্য দুর্গন্ধ ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের ওপর। অরুণাভ এই গন্ধের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত। সমস্ত ডক্টরকেই এই গন্ধ সহ্য করে শিখে নিতে হয় মানব শরীরের অন্ধিসন্ধি। গন্ধটি মাংস পচার। এতদিন এই বন্ধ ঘরের ভিতর আটকা ছিলো। বাইরে খোলা নর্দমা ও আবর্জনার স্থুপ থাকায় রাস্তা থেকে সেটি আলাদা করে পাওয়া না গেলেও, এখন দরজা খোলার পর প্রায় চার হপ্তা বাসি পচাগলা মানুষের মাংসের গন্ধে পেট থেকে দুপুরের খাওয়ার উঠে এলো তার। সঙ্গেসঙ্গে পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপা দিয়ে নিজের মোবাইলের আলো জ্বাললো সে। সমস্ত ঘরে যেন কালবৈশাখী বয়ে গেছে। সামান্য যা আসবাব ছিল তা ভাঙাচুর করা হয়েছে অত্যন্ত নির্মমভাবে। এক কোনায় চালের হাঁড়ি থেকে ভাত ছড়িয়ে রয়েছে মেঝেময়। আরো অনেককিছুই হয়তো সে দেখতো কিন্তু তার আগে চোখ আটকে গেলো ঘরের মধ্যিখানে। ফ্যানের ব্লেডের সাথে ঝুলে আছে ভদ্রলোক। মুখটি পচে গলে কালো একটা বেলুনের মত হয়ে গেছে। শুধু শার্টটা চিনতে পারলো অরুণাভ৷ চেকচেক এই শার্ট পরে বেশ কয়েকবার তার কেবিনে এসেছিল সে। সমস্ত শরীরে প্রহারের ছাপ স্পষ্ট। বুঝতে বাকি রইলো না একাধিক লোক মিলিয়ে তাকে পিটিয়ে খুন করে এভাবে ঝুলিয়ে রেখে গেছে। মেয়েটিও একদৃষ্টে দেখছে সেই দৃশ্য। তার চোখ বিস্ফারিত। উচ্চারণ করার মত শব্দ ও শক্তি যেন দুই খুইয়ে বসেছে মেয়েটি৷ অরুণাভ আর তিলমাত্র দেরী না করে প্রায় তাকে কোলে তুলে নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো বাড়ির বাইরে।
বাইরে তখন প্রায় জনা কুড়ি ষন্ডাগোছের ছেলে জমা হয়েছে। বয়স সতেরো থেকে সাতাশের কাছাকাছি।
তাদের মধ্যে থেকে মুরুব্বি গোছের প্রায় ছয় ফুট লম্বা দশাশই চেহারার একজন এগিয়ে এসে অরুণাভর কলার চেপে ধরলো। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোয়াল কাঁপিয়ে নেমে এলো এক চড়। ককিয়ে উঠলো অরুণাভ। তারই মাঝে পাশ থেকে লুঙ্গি পরা বেঁটেখাটো চেহারার একজন বলে উঠলো, ‘শুয়োরের বাচ্চা ডাক্তার, নিজের ডাক্তারি চীনে গিয়ে ফলাস, এপাড়ায় যদি আবার রোগ ছড়াতে এসেছিস তো ওর বাপের মত তোকেও লাশ করে দেবো।’
আর একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে বলে উঠলো, ‘ বোকাচোদা চীনের ডাক্তার, মেরে বেটাকে গোর দিয়ে দে আজই।’ সঙ্গেসঙ্গে ভিড়ের মধ্যে থেকে উড়ে এলো আরো কয়েকটি চড়চাপড়। অসহ্য যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠলো অরুণাভ। এরই মাঝে কে একজন বললো, ‘মেয়েটাকে তোল, আজ রাতে জুলুস হবে’  হাসির ছররা ছুটলো সাথেসাথে ভিড়ের ভিতর। প্রবল এক ভয়ে রক্ত হিম হয়ে যায় তার মুহূর্তের মধ্যে। কিন্তু বোদ্ধা গোছের একজন বললো, ‘ ওকে ছুঁসনি। রোগে পরেছিল। এক্ষুনি দূর কর পাড়া থেকে’।  এটা শোনার পরে যেন এক চাপা সন্ত্রাস কাজ করলো ভিড়ের মধ্যে। ছেলেটিও তার টুঁটি ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ালো। এক লহমা বিলম্ব না করে মেয়েটির হাত ধরে ছুট লাগালো সে। পিছনে তাড়া করে আসছে অনেক মানুষ, এদিক সেদিক থেকে ছুটে আসছে নুড়ি আর পাথরের টুকরো। আর তারই সাথে একটি শব্দ পিছু নিচ্ছে তাদের.. চীনের ডাক্তার!  চীনের ডাক্তার!’
(কোরোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পরার পর ভারতের নানান অঞ্চলে নর্থ-ইস্টের মানুষদের ওপর নেমে আসা অকারণ  অত্যাচারের বিরুদ্ধে এই গল্প। গল্পটি সম্পূর্ণরূপে একটি ফিকশন, যার সাথে বাস্তব কোনও চরিত্র বা ঘটনার প্রত্যক্ষ মিল নেই।)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।