প্রবন্ধ – জগন্নাথ চ্যাটার্জ্জী
বিদ্যাসাগর২০০/বিশেষ সংখ্যা
ঈশ্বরের ছেলেবেলা
কালো মেঘে ছেয়ে আছে সারা আকাশ, পাগলা বৃষ্টি শক্তি যোগাচ্ছে উন্মত্ত দামোদর কে।নাগিন স্রোত বারেবারে তার বিজয় পতাকা গেঁথে যাচ্ছে, তীব্র অট্টহাস্যে। নিরীহ হরিণ শাবকের মত কম্পমান ভূমির বুকে হঠাৎ ই বর্জ্রের মত আগমন দৃঢ় দুটি পায়ের। অহংকারি দামোদরের দর্প চূণ করে,পানাপুকুরের মত অবলীলায় তাকে হারিয়ে সাঁতরে ওপারে পৌঁছাল এক যুবক। শুধুমাত্র মাকে দেওয়া কথা রাখতে…
নিজ কর্মে অবিচল, একজেদী আপোসহীন, ধনুক ভাঙা পণে বিশ্বাসী এই মানুষটিই, ঈশ্বর চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় – আমাদের সকলের ‘বিদ্যাসাগর’।
মেদিনীপুরের বীরসিংহপুর গ্রাম, সালটা ১৮২০,সেপ্টম্বরের ২৬ তারিখ ঠাকুরদাস বাড়ুজ্জের বাড়িতে হট্টগোল, ভগবতী দেবী সন্তান প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে, চাপা উত্তেজনা সবার চোখে মুখে, শেষে এল সেই ক্ষণ, আর্বিভূত হল বাংলা মায়ের দামাল ছেলে।
ঠাকুরদা এক নজরেই বলে উঠলেন -“ছেলে তো নয়,এঁড়ে বাছুর হয়েছে”। সত্যিই এত প্রবল সাহস, এত অসীম শক্তি এত জিগীষা খুব কমই দেখা যায়।
ছেলেবেলা থেকেই প্রচন্ড মেধাবী, গ্রামের পাঠশালার গুরুমশায়ের অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য ছিলেন, “যশোরের কই” থুরি “কশোরের জৈ”… আসলে ‘দয়াসাগর’ বিদ্যসাগরের মাথাটা এত বড় ছিল যে তাঁর সহপাঠিরা তাঁকে ওই নামেই ডেকে খ্যাপাত। বিদ্যালয় যাওয়ার তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিল প্রকান্ড এক ছাতা.. দুর থেকে দেখলে মনে হত অশরীরী এক ছাতা হেঁটে যাচ্ছে। এই নিয়েও তাকে অনেক মজা সহ্য করতে হয়েছে।
শৈশববেলা খুব একটা স্বচ্ছলতার মধ্যে কাটে নি, দানসাগরের। মাত্র আট বছর বয়সে বাবার সাথে চলে আসতে হয় কলকতায়। পথে যেতে মাইলপোস্টে লেখা দেখে দেখে আত্মস্ত করে নেন ইংরাজি সংখ্যামেলা। তাঁর এই অদ্ভূত প্রতিভা দেখে সবাই চমকিত। যদিও প্রথম নজরে বিদ্যাসাগর মাইল ফলক কে মশলাবাঁটার শীলই ভেবে ছিলেন।
মাত্র নয় বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে ভরতি হন,জন্মসুত্রে লাভ করেন দারিদ্রতা।কিন্তু এই মৌরসী সম্পত্তির প্রাচীর এতও উঁচু ছিল না যে তাঁর প্রতিভা, মেধা, ইচ্ছাকে আটক রাখবে।তাঁর জেদের কাছে খান খান হয়ে যেত সমস্ত বাধা। প্রতি পরীক্ষাতে কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি প্রথম হতেন পেতেন বৃত্তিও।
সংস্কৃত, বাংলা বিষয়ে ব্যুৎপত্তিগত জ্ঞান অর্জনই নয়, ইংরেজি ভাষাতেও গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এজন্য তাকে খুব কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়। দিনের বেলায় বাড়ির সমস্ত কাজ যেমন, বাটনা বাঁটা, কাপড় কাচা, উনুন ধরানো করতে হত, ফলে পড়ার সময় বলতে শুধু রাত। … অক্লান্ত পরিশ্রম করে পাছে ঘুমিয়ে পড়ে সেই জন্য ব্রাহ্মণের টিকি বাঁধা থাকত দেওয়ালের গজালে। তারপর সারারাত রাস্তার আলোয় চলত গভীর অধ্যায়ণ।
মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৮৪০ সালে, তাঁর অসামান্য বিদ্যচর্চার জন্য পান ” বিদ্যাসাগর উপাধি।
হাঁটুর উপরে ধুতি পড়া মানুষটি ছিল কোমল হৃদয়ের কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর ইস্পাত। পরাধীন দেশে জন্মালেও তিনি কোনোদিন ইংরেজকে প্রভু মানেন নি, হেলায় ছেড়েছেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ। আবার মধুসূদন কে বিপদ থেকে বাঁচাতে ধার করেও সাহায্য করে গেছেন।
দয়ারসাগর প্রতিশ্রুতি পালনে করুকূলভূষণ ভীষ্মের সাথে তুলনীয়। শৈশবে মাকে অলঙ্কার গড়িয়ে দেওয়ার কথা দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। বাল্যবিবাহ রোধ, স্ত্রী শিক্ষাবিস্তারে জন্য বালিকা বিদ্যালয়, বিধবা বিবাহ প্রচলন করে অসংখ্য অগনিত কচি ফুলের মত বালিকাদের দুঃখ ঘুচিয়ে, পুনছন্দময়তা করে মহিয়সী মাকে অমূল্য অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করেন।
প্রবল জেদি, সূর্যসম তেজী মানুষটি, শেষে জীবনটা কারমাটারে আদিবাসী পাড়াতেও, সিংহের মত বিচরণ করেন ।
কবির ভাষায়….
“সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়।
তোমায় দেখে বিশ্ববাসীর হয়েছে প্রত্যয়।”