• Uncategorized
  • 0

গল্পে জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

হাফ গেলাস এথিক্‌স, একটু সোডা আর ডালমুট

– যে যেমন ভাবে সুবিধে করতে পারে, সেই ভাবেই এগোবে… এথিক্‌স-এর ভাই হয়েছে!
– অসুবিধেটা কোথায়? এগোনোতে? সুবিধেতে? না এথিক্‌স-এ?
– ধুস্‌ সালা… ভাঁটাবেন না তো মাইরি!… ভালই বুঝছেন কী বলতে চাইছি!
– বুঝছি বটে… আবার বুঝছি নাও বটে… যেমন পার্সোনা-এ বার্গম্যান…
– এই এই … কী ব্যাপার, অ্যাঁ? ব্যাপারটা কী বলুন তো? এটা কি আর্ট ফিলিম চলছে নাকি?
– আরে আরে… বসো বসো… সব ওলট-পালট হবে যে!… কাম ডাউন! রিল্যাক্স… অ্যাতো এক্সাইটেড হওয়ার কী আছে?
– কী আছে? কিছুই না!… কিছু নেই বলেই তো…
– আচ্ছা আচ্ছা শোনো… দেখো, এই যে টেবিলটা… এতে এই অ্যাশ ট্রে, দেশলাই বাক্স, গেলাস… আর সব কিছু। এই টেবিলটা না থাকলে কী হ’ত?
– কী হ’ত? কী আবার হ’ত? অন্য টেবিলে গিয়ে বসতাম…
– একটাও টেবিল যদি না থাকত?
– মাটিতেই বসে যেতাম সালা!… টেবিলের পরোয়া করি নাকি বাল? ফাক টেবিল… ফাক মাচা!
– মানে, এই সব জিনিসগুলো সব মাটিতেই রাখা হ’তো… তাই তো?
– আলবাৎ!
– আচ্ছা বেশ… তাহ’লে এখন যে এই টেবিলটা আছে, টেবিলের ওপরে সব কিছু রাখা। এতে সুবিধেটা কার হ’ল? টেবিলটার? জিনিসগুলোর? না আমাদের? টেবিলটার কিস্‌সু লাভ নেই, আর জিনিসগুলো মাটিতেই থাকতে পারত… মাঝখান থেকে মাটিতে বসতে হ’ত আমাদের… মানে জিনিসগুলোর মতই, মাটিতে পড়ে থাকতাম, বুঝলে? হা হা হা… মাটিতে!
– এই এই… আবার… আবার ছেনালি শুরু করলেন!… টেবিল, গেলাস… মাটিতে পড়ে থাকতাম…  সব জিবারিশ!
– যাহ্‌! কেসটা বুঝলে না? টেবিলের কি লাভ-লোকশান বোধ আছে? আমরা জিনিসগুলোকে কনজিউম করছি টেবিলের ওপর রেখে, আমাদের সুবিদের জন্য। টেবিলটাও আমাদের কাছে ভোগ্য। ব্লাডি কমোডিটি।
– মানে? মানে… আপনি বলতে চান আমাদের সালা নিজেদেরই লাভ-লোকশানের সেন্স নেই?… সবাই টেবিলে তবলা বাজিয়ে চলে যাচ্ছে?
– এই ‘আমাদের’টা আবার কারা জানি না… তোমাকে ব্রাদার অনেকদিন ধরে দেখছি, তাই শুধু তোমাকে বলি। কাউকে সাপোর্ট করা হয়ত ভাল… তাই বলে কারও জন্য থাম, টেবিল, তক্তপোশ, কোলবালিশ — এ’সব হয়ে থাকা মোটেই কাজের কথা নয়। মনে রেখো, লাভটা তার যে কোলবালিশে কনুই রেখে বসে! বোঝা গেলো?
– হুম!
– তুমি ‘একদা তাহাকে সাপোর্ট করিয়াছিলে’ বলে সে আর তার ব্যালেন্স শিটের দিকে ফিরেও তাকাবে না… যেমন গাণ্ডু আছো, তাই থাকবে… আর ‘হায় এথিক্‌স হায় এথিক্‌স’ করে বুক চাপড়াবে। পাবলিক্‌কে হুলিয়ে সুযোগ নিতে দিলে, তারাও চিরকাল ব্ল্যাক শিপের উল, ব্যা ব্যা করার আগেই কামিয়ে নিয়ে চলে যাবে।
– এটাই ব্যাপার বুঝলেন… ঠিকই বলেছেন… আমি সালা গাণ্ডুই রয়ে গেলাম…
– সে থাকো… কিন্তু তাই বলে এভাবে এথিক্‌স এথিক্‌স করে লোকজন কে ভয় দেখাও কেনো? দু’বেলা ভর পেট খেয়ে-ঘুমিয়ে যারা হাতে একটু ভাবনা চিন্তার সময় পায়… এথিক্‌স তাদের জন্য। আর তাদের জন্য যাদের চোখের চামড়া থাকে… কিংবা অন্ততঃ একটা কান আছে… হাটেবাজারে এসব বলে কী মজা পাও ভাই?
– তাই বলে কেউ…
– কেউ কিসসু পরোয়া করবে না। এস্ক্যালেটর সামনে পেলে কেউ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠে না।
– কিন্তু আমি… আমার মত অনেকে তো উঠতে চেয়েছিল দাদা। সিঁড়ি বানিয়ে নিতে চেয়েছিলাম আমরা। বা… টু বি অনেস্ট সিঁড়ি, মই কিচ্ছু চাইনি… হেঁটে যেতে চেয়েছিলাম, যতটা পারি।
– ওসব আমাদেরও মনে হ’ত একসময়। কী সব সময় গেল… হাংরি, নক্সালবাড়ি, এমার্জেন্সি, ঋত্বিক, মৃণাল। তারপরেও যাদের গদিতে বসার, তারাই থাকে। সবই তো জানো। হয় তোমার খরিদ্দার আছে, নাহ’লে নেই। হয় তোমার মাল দোকানে বিক্রী হয়, নাহ’লে হয় না। আমি তো দোকানদার… আয়কর দিয়ে খাই!
– তাহ’লে আমি…
– তুমি আমি… আমরা সবাই ভাড়াটে। শুধু কিছু মনিব, মালিক আর বাড়িওয়ালা আছে। বাকি সবাই ভাড়া দিয়ে থাকছি। ইচ্ছে হ’লে জলের পাম্প বন্ধ করে দেবে। ইচ্ছে হ’লে ইলেকট্রিকের মিটারে কল-কাটি নেড়ে রাখবে। ঝামেলা করবে? করো কদ্দিন করবে… করো…
– তাহ’লে আমি…
– কারও টেবিল-চেয়ার জুটে গেলে সে খামোখা মাটিতে পড়ে থাকতে যাবে কেনো বলো তো?
–  খামোখা মাটিতে পড়ে থাকব না। রেস্তোরাঁ বাইরে কুত্তার মত লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব… কখন দুটো চেয়ার খালি হবে আর আমার পালা আসবে! লাইন এগোতে দেখব খিদে আর থুতু গিলতে গিলতে।
– দেখো, ব্রাদার… তোমার দোকান কীভাবে ভাল চলবে, কোন জিনিস কোথায় সাপ্লাই দিতে হবে… এইসব নিয়ে জানার থাকলে বলো, দু-তিনজনের কনট্যাক্ট দিয়ে দেবো, ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দেবো… তারপর একটু তো নিজেকেও করে-কম্মে খেতে হবে… তাই না?
–  ও… তাহ’লে এবার এসকোর্ট সেজে…
– আহ! এসব আবার কী কথা? এসকোর্ট-ফেসকোর্ট আবার কোথা থেকে আসছে? মানুষের পরিচিতি থাকবে না? যোগাযোগ থাকবে না? ব্যবসায় আদান-প্রদান হবে না? আপদে-বিপদে, দরকারে-অদরকারে কেউ কারও কাজে আসবে না? ধন্যি বাবা! নাও নাও… মাথা ঠাণ্ডা করে গেলাসটা শেষ করো… আমি আর একটা অর্ডার দিই।

দু’জনেই একমুঠো করে ডালমুট মুখে চালান দিয়ে দিলো।

একজন পেছনে হেলে গেল চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে, সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে। আর একজন সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়ার বলয় ভাসিয়ে চলল পাশের টেবিলে বসে থাকা এক মহিলার আদুরে পিঠ লক্ষ করে।
মাথার ওপর পুরনো দিনের সিলিং ফ্যানটা নিজের মনেই ঘুড়ে যাচ্ছে। তার নীচে একটা মাঝারি মাপের চৌকো টেবিল। টেবিলের ওপরে দু’টো গেলাস… হুইস্কি।
বলা যায় দু’টোই অর্ধেক খালি, অথবা… দু’টোই অর্ধেক ভর্তি।
দু পক্ষের সব ক’টা তাসই পিঠ দেখাচ্ছে। কেবল জোকারের হাসি আর থামে না… সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে হেসেই চলেছে… হেসেই চলেছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।