• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় তপোব্রত মুখোপাধ্যায়

তারপর

ট্রামটা বেরিয়ে যেতেই আর বসে থাকা গেলো না। শেষমেশ উঠে পড়তেই হল। যাবার যে একটা তাড়া ছিল তা কিন্তু নয়, তবু না বেরোলে সেই অস্বস্তিটা নিশ্চিত ঘিরে ধরত আবার। তাই কতকটা বলা যায় সেই ভয়েই আবার রাস্তায় নেমে পড়া।
এই এক জ্বালাতন। এই বয়েসে খুব যে একটা সবকিছু পোষায় তা তো আর নয়, তাই মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ভালো লাগে। দিনরাত ছেলে-বউ-নাতি-নাতনির ক্যাঁচর ম্যাচর কাঁহাতক ভালো লাগে আর? সনাতন তাই সনাতন গৃহকোণ ছেড়ে সন্ধ্যের গোড়ায় এসে বসেন পার্কের ধারের বেঞ্চটাতে।
অন্ততঃ এতদিন তাই করছিলেন। এতদিন বলতে বেশ বছর তিনেক যাবৎ। ইদানীং তার মধ্যে এক গেরো উপস্থিত হয়েছে। সে কথা সনাতন বুঝতে পারেন, কিন্তু বোঝাতে পারেন না কাউকে। এতদিন মাঝে মাঝে কেউ এলে কথা বলতেন। মিনিট পাঁচেক বা ওই রকম, তারপর না কেউ থাকতো সনাতনের পাশে বসে, না সনাতন আর বলতেন কিছু। তবে এই মাস তিনেক ধরে এক অসোয়াস্তি হচ্ছে তাঁর, সে কথা মনে হচ্ছে কাউকে খুলে বলা দরকার, কিন্তু সে আর পারছেন কই।
সেদিনও এমন বসেছিলেন, মানে ওই গোটা মাস তিন আগে। খুব যে একটা ভিড় ছিল রাস্তায় বা পার্কে তা নয়, তবু লোক ছিল কিছু। আসলে সনাতন মাঝে মাঝে এমন অনেক সময় চুপ করে বসে থাকেন যখন চারদিকে নেহাত কেউই নেই। বউ ও মাঝে মাঝে রেগে বলে, বুড়ো মরে পড়ে থাকবে কোথায় কোনদিন, পচার আগে লোকে খবর পাবে না। সে সনাতন শোনেন, আবার শোনেনও না। যাক সে কথা। সনাতনের পাশে সেদিন লোক-টোক ছিল না কেউ। কোত্থেকে একটা নেড়ি কুকুর শুধু ঘুরতে ঘুরতে এসে অতি সঙ্কোচে সনাতনের পাজামার ধারটা শুঁকে ওইখানেই লেজটেজ গুটিয়ে বসল। সনাতন ওকেই ভালো করে দেখবেন বলে মুখ ঘুরিয়েছেন সবে, হঠাৎ কুকুরটা কেমন পরিত্রাহি চিৎকার ছেড়ে দৌড়ে পালাল। সনাতন বেশ চমকে গেছিলেন। ঘুরে তাকিয়ে দেখতে গেলেন হঠাৎ কোথায় গেলো জন্তুটা, দেখতে পেলেন না। অথচ ওটার ডাকটা বেশ অনেকটা দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলেন।
কি যে দেখল কুকুরটা সেটাও বুঝলেন না সনাতন ঠিক। কিন্তু কেমন একটা খটকা লাগলো মনে। ওনাকে দেখে কুকুরটা পালালো? ওনার ধারে কাছে খুব একটা যে কেউ ঘেঁষে না সেতো অন্য কারণ, মানুষের খুঁতখুঁতুনি স্বভাবের জন্যে উনি কাউকে পছন্দ করেন না তেমন বলে। তা বলে জন্তুও?
তো, যে কারণেই হোক। একটা অসোয়াস্তির বীজ মনে গেঁথে গেলো সেই থেকে। ট্রামে-বাসে উঠলে মানুষ পাশ থেকে উঠে গেলে, ঘুমন্ত বাচ্চা কেঁদে উঠলে উনি চেয়ে দেখেন। যে নামার সে নেমে যায় চট করে, মা বাচ্চার মুখ সরিয়ে নেয় আঁচল টেনে। সনাতন বোঝেন না, কেন। ভাবেন, এ বুঝি স্বাভাবিক, কিন্তু ওই মনের খুঁত আর সামলে উঠতে দেয় না।
সন্ধ্যে বেলায় লোকের ফেরার তাড়া থাকে বেশী। সনাতন পছন্দ করতেন না কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে এমনি এমনি চেয়ে চেয়ে তাঁকে দেখুক। কেমন বিচ্ছিরি লাগে। কিন্তু আজ, অন্তত এখন যখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নামছে, এই ফাঁকা একলা পার্কে বসে থাকা তাঁকে লোকে দেখুক এবং সামনে আসুক, এইটুকু অন্ততঃ চাইছিলেন। লোকে পা চালিয়ে চলে যাচ্ছে। ফিরে না দেখলে তেমন অসুবিধে নেই, কিন্তু যারা দেখল বলে মনে হল তারা কেমন যেন হঠাৎ ঘুরে অন্য রাস্তায় চলে গেলো, সনাতন রাস্তায় নেমেও আর দেখতে পেলেন না।
হাঁটার সময় সেই বিপদ নেই। কে যাচ্ছে আর কে না যাচ্ছে, সনাতন না দেখে থাকারই চেষ্টা করেন। কিন্তু অভ্যাসবশে পানের দোকানে দাঁড়ালে আজকাল দোকানিও দেরী না করে আগে আগে পান বাড়িয়ে দেয়। আজকাল সনাতন যে খুব একটা পান খান তাও একেবারেই নয়। তবু সনাতন দেখেছেন, কেমন একটা সঙ্কোচ-দৃষ্টি তার চোখে। যেন তাকিয়ে নেই, অথচ কি একটা ভয়ে যেন সিঁটিয়ে গেছে সে। বুঝে পান না সনাতন। সবাই ভয় পাচ্ছে? সনাতনকে ভয়? কেন? সনাতন ঘরে ঢোকার আগে অব্দি এটাই ভাবতে থাকেন। অনেকটা রাস্তা যেন সেই ভয়েই পেরিয়ে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায় বোবা মনটুকু।
কর্মফল, রাশিফল এসব কিছু সনাতন মানতেন না। কোথায় একটা বাধত। এখন প্রতিদিন কাগজ খুঁজে বেড়ান শুধু ওই ব্যাপারগুলো মিলিয়ে দেখবেন বলে। তাঁকে না দেখে সারা পৃথিবী বেশ ভালো চলছে। কিন্তু তাঁর দিকে তাকালেই কি সংকেত পাচ্ছে তারা যে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? সনাতন যা বোঝেন তা মানতে চান না। তাঁর নিজের এক ব্যাখ্যা ছিল এই যে, এতদিন সকলকে উপেক্ষা করে চলতে চাওয়া তাঁর ইচ্ছে আজ টেলিপ্যাথির জোরে সত্যি হয়ে বুমেরাং হয়ে উঠেছে। অবশ্য, এই টেলিপ্যাথি জিনিষটা এই তিনমাস হল তাঁকে ভাবিয়েছে। এর আগে এসব নিয়ে ফালতু সময় নষ্টের মতো সময় ছিল না বলেই তাঁর মনে হতো।
বাড়িতে আবার সে অন্য এক যন্ত্রণা। রাশভারী স্ত্রী তাঁকে পাত্তা দেন না খুব একটা, সংসারের সমস্ত দায় নিয়ে থাকেন। সনাতনের যেন কিছুই বলার, শোনার নেই তাঁর থেকে। গোটা তিনটে মাস ধরে একটা শব্দও বিনিময় হয়নি। অন্যদিকে ছেলের বউ, ছেলে সকলেই চারপাশে ঘোরে, বহু কথা বলে, কিন্তু সনাতনের একটু ভেবে তাদের কিছু বলবার সময়টুকু অব্দি ধৈর্য ধরে দাঁড়াবার বিষয়টা ভেবে দেখে বলে মনে হয় না। নাতিনাতনিরা চারদিকে খেলে বেড়ায়, যথেচ্ছ যা খুশি করে বেড়ায় চারদিকে। সনাতনের শব্দস্ফূর্তি হয় না যেন।
তবে উপায় হয়তো আছে কিছু মনে করে শেষে মনের ডাক্তারের কাছে যাবেন ঠিক করলেন সনাতন। তিনি ছোট থেকেই নিজেকে নিয়ে আলাদা ভাবে ভাবিত নন, তাই বুড়ো বয়েসে নেহাত ভীমরতি হলে যে সেটি সামলানোর দাওয়াই খোঁজারও এক ঠিকানা হতে পারে, তা তাঁর জানা।
কিন্তু বিপদ বাধল ডাক্তারের কাছে এসে। সনাতন স্পষ্ট বুঝলেন যে তাঁর ইচ্ছা সত্বেও ডাক্তার তাঁকে তেমন যেন পরীক্ষা করতে রাজি নন। সনাতন জানতেন এইসব মনের ডাক্তাররা এমন কিছু রোগী পেতে ভালবাসেন যারা নিজেদের অসুবিধা নিজে স্পষ্ট করে বলতে পিছপা নয়। আসলে, এইসব রোগীদের সঙ্গে একটা আলাদা বোঝাপড়া হয়ে যায় ডাক্তারের– তাতে রোগীও তুষ্ট আর পকেটও। অথচ বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকার পরেও সনাতন ডাক না পেয়ে শেষ অব্দি উঠে এলেন। একটা রাগ, বিতৃষ্ণা আর ক্লান্তি মিলেমিশে প্রবল এক অস্বস্তি লাগছিল যেন।
রাস্তায় তিনি একা। সনাতনের জানা ছিল এ রাস্তায় এমনিতে লোক চলাচল বেশিই থাকে অন্যান্য দিনে, তবে আজ কেন নেই তা বোঝা গেলো না। সনাতন ঘড়িও ভুলে এসেছেন। দোকানগুলো বন্ধ নয়, কিন্তু বাইরে তার লোক দেখা যায় না। সনাতন চলতে চলতে থামলেন একবার। কেউ কোথাও নেই। কেউ কোথাও নেই? সত্যি? তাঁকে দেখেই সবাই মুখ ঘোরায়? কেন? সনাতনের মনে হল রাস্তা থেকে পাথর তুলে ছুঁড়ে মারেন কোথাও, কাঁচ ভাঙ্গুক। তখনও কেউ আসবে না? তাঁকে ঘিরে ধরবে না? জিজ্ঞেস করবে না, কেন? জানতে চাইবে না কিছু? খিস্তি দেবে না? মারতেও তো পারে। বাইরের আর পাঁচটা লোক, তারা ভালো না হোক, এই খারাপ নিয়ে তাঁর কাছে পরিচিত তো হবে! তবে? মারবেন তিনি?
সনাতন নিচু হলেন। পাথরটায় হাত ঠেকল। কিন্তু…
সেদিন একটু রাত হল ফিরতে। দরজা খোলা ছিল। চুপচাপ ঘোরে ঢুকে এসে শান্তভাবে বিছানায় বসলেন ঘরে এসে। কোন প্রশ্ন এলো না। আর যে আসবেও না, সনাতন জানতেন। ঘরের মধ্যে টেবিলে কাঁচের গ্লাস, ফুলদানি। পাশাপাশি, অথচ দূরে। যেন ধাক্কা না লাগে। সনাতন ঘরের দিকে চাইলেন। ঘর পেরিয়ে বারান্দার দিকে। একান্নবর্তী পরিবারের সমস্ত ঘরজুড়ে তাঁর সংসার একটা একটা দেওয়ালের গণ্ডি দিয়ে আলাদা। দেওয়াল মিশে যায় না। শুধু কোণের সূক্ষ্মতম দুরত্বে থেমে থাকে। তাঁরও ভয় এই দূরত্বটুকু। এটাই স্বাভাবিক বুঝি। ভেঙ্গে দিলে সহজ মিশে যাবার চেয়ে অনেক জটিল ধুলো উড়ে আসে। সনাতনের একলাটি নয়, সেই ভাঙ্গনকে ভয় বড়ো।
চোখের সামনে আলো নিভিয়ে দিলে কি কিছুটা সহজ মনে হবে সেইসব ফেলে যাওয়ার কথা? একলা যাওয়া, একলা চলা কিংবা একলা হয়ে যাবার শূন্যতা? সময় হয়েছে? পাশের টেবিলে সনাতনের নিজের ছবি, টাটকা ফুলে ভরা ফুলদানির পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা। একা। দুচারটে ফুল ছড়িয়ে আছে ছবির সামনে।
জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে। স্ট্রিটলাইটের আলো। বিছানা ছুঁয়ে সনাতনের ছবির কাছাকাছি অব্দি। কত কাছে, তবু দূরত্ব যেন মোছার নয়।
সনাতন হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে থাকেন…।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।