খগেন মুদির বন্ধ দোকানের সামনে মেয়েকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছে দুলালী। মেয়ের কান্নায় সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। শুকনো বোঁটা টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলার জোগাড়। বুক শুকিয়ে গেছে, দুবেলা দু’মুঠো অন্ন ঠিকমত জোটেনা তো দুধ হবে কোত্থেকে!
সকাল হতে না হতেই মোড় মাথায় গাঁক গাকঁ করে মাইক বাজছে,”উঠ গো ভারত লক্ষ্মী, উঠ আদি জগতজন পুজ্যা…!” ক্ষিদেতে মাথার ভেতরটা কেমন যেন ভোঁ ভোঁ করছে তার, জোরালো গান আর সইনা যেন! বিরক্তিতে চেঁচিয়ে উঠল মেয়ের উপর,”আজ যে কি তা কে জানে, যে দেশে ক্ষিদের জ্বালায় লক্ষ্মী মরে, সেথায় লক্ষ্মীদের দুরাবস্থার শেষ নেই গো!”
তেতো গেলা মুখ করে বন্ধ দোকানের তালাটার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকে সে, “কখন যে ফটক খুলবে…!”
ঝাঁঝিয়ে উঠে সে বললে,”সবে পাল্লা খুলছি, এখনও বউনি হল না,দিলিতো…দিলিতো… সকালটা মাটি করে!”
কাঁচুমাচু মুখে নিঃশব্দে দাড়িয়ে থাকে সে। অথচ যখন গতর ছিল তখন এই মুদি কতো না পিরীত করে কথা কইতো তার সাথে। সে সব দিন গেছে। মেয়েটা কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করেই চলেছে। বিশেষ সুবিধা না হওয়াতে সরে পড়ল সে।
মোড়ের দিকে এগিয়ে গেল। দেখে শহীদ বেদী গন্ধে পুস্পে সুসজ্জিত। এবার উৎসবের হেতুটা বুঝল সে! একপাশে অনুষ্ঠান পরবর্তী ভোগ বিলানোর ব্যবস্থা চলছে। এক মুহূর্তও দেরি না করে মেয়েকে নিয়ে লাইনে দাড়িয়ে পড়ল। ক্ষিদে আর সহ্য হয় না যে!
মনে পড়ে গেল বছর তিনেক আগের এমনই এক দিনের কথা। তার বুড়ো বাপ এক মোদো মাতাল হাড় হাভাতের হাতে তাকে তুলে দিয়ে, কন্যাঋণ থেকে মুক্তি পেয়েছিল!
বছর ঘুরতে না ঘুরতে পেটে এসে ঢোকে এই মরণ! তারপর থেকে জীবনটা তার কাছে আরও অসহনীয়! জঠরের জ্বালা গেল বেড়ে। আর আজ সে একমুঠো খাবারের জন্য ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো হন্যে হয়ে ঘুরছে!
দুলালী মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্না ভেজা চোখে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তেরঙ্গা পতাকার দিকে, মুক্তির আনন্দে ভাসছে সে! আজ সে মুক্তির নিশানকেই মনের কথাটি শুধোয়,”ঘরে-বাইরে আমার মতো দুলালীরা যে আজও বড় অসহায়, তারা যে মরে বাঁচে, তাদের কি মুক্তি নেই গো?”