গল্পে মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

স্বপনচারিণী

নিজের বিয়ের কার্ডের বয়ান নিজেই লিখেছিল মনামি। জ্যেঠু দেখে বলেছিলেন ভাল লিখেছিস। কার্ডে নীচে নিমন্ত্রণ কর্ত্রী হিসেবে নাম ছাপা হল ঠাকুমায়ের। জ্যেঠু বললেন তোকে ইংরেজিতে এম এ পড়ানো আমাদের সার্থক। মনামি কিছু বলে নি। বিয়ের কার্ড মুসাবিদা করার সাথে এম এ পাশ করার আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি? কয়জন আর নিজেরা মুসাবিদা করেন? কার্ডের দোকানে মডেল বয়ান থাকে। তাই থেকে টুকলি হয়। জীবনটাও। বেশির ভাগের জীবনের মধ্যে কোনো স্পর্ধা থাকে না। গড়পরতা ছকে কেটে যায় অধিকাংশের জীবন। মনামি প্রথম থেকেই ভেবেছিল নিজের জীবনটাকে গড়ে নেবে নিজের শর্তে। বাবা বলেছিলেন মনা, তোর বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে রেখেছি। মনামি সেটা জানত। প্রতি মাসে বাবার একটা একাউন্ট থেকে অন্য একাউন্টে টাকা কিছু কিছু করে ফিক্সড করার ফর্ম সেই ভরে দিত। মা তাকে দেখিয়ে রেখেছেন মেয়ের বিয়ের জন্য একটি একটি করে গয়না তিনি গড়িয়ে রেখেছেন। মনামি এগুলি জানত। আর একটা চাপা অস্বস্তিতে ভুগত। তার নামটা রেখে ছিলেন জ্যেঠু। ফরাসী ভাষার শব্দ। এ কথার মানেটাও তিনিই শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আমার প্রিয়। ক্লাস টুয়ে নতুন স্কুলে গেলে ক্লাসে মাস্টার মশাই রোল কল শেষে জানতে চেয়েছিলেন, মনামি মানে কি? ছাত্রী বলেছিল, আমার প্রিয়। মাস্টার মশাই বলেছিলেন, নামটা প্রণামী হলেই ভালো হত। সারা ক্লাস হেসে উঠেছিল। প্রণামী কথাটা সবার চেনা। শুধু ক্লাসের শেষে নতুন বন্ধু দেবজিৎ কাছে এসে কানে কানে বলেছিল আমার প্রিয়। তা শুনে ছোট্ট মনামির মুখের অবস্থা এমন হয়েছিল যাকে বলে আরক্তকর্ণমূল । বাড়িতে এসে ঠাকুমাকে বলেছিল দেবজিৎ এর কথা। বলেছিল টিফিনের সময় কেক বিস্কুটের ভাগ দেবার কথা। ঠাকুমা হেসে বলেছিলেন, তোদের ক্লাসে ছেলেরাও একসাথে পড়ে? আমাকে তোদের ক্লাসে নিবি?
মাধ্যমিকের পরেই মনামি স্থির করেছিল ফরাসী ভাষা শিখবে। জ্যেঠু বলেছিলেন ইংরেজি পড়ো। পরে ইংরেজির মাধ্যমে ফরাসী শিখে নিও। বাবা বলেছিলেন হাল আমলের ফিজিক্সের প্রথম সারির গবেষণায় ফরাসী ভাষায় জ্ঞান দরকার। ভালোবেসে ইংরেজিতে এম এ পড়তে পড়তেই ফরাসী ভাষায় একটা সার্টিফিকেট কোর্স করে নিয়েছিল সে। জ্যেঠু দুপুর বেলা কাগজ ঘেঁটে বিবাহের বিজ্ঞাপন দেখতেন। তার পর পছন্দসই বিজ্ঞাপন পেলে লাল কালিতে দাগিয়ে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।
মনামির মনে ছিল দেবজিতের কথা। সে ছেলে যে কোথায় হারিয়ে গেল। তার বাবার ছিল বদলির চাকরি। বদলি হতে বাবার হাত ধরে কোন দূরের মফস্বল শহরে দেবজিৎ পাড়ি দিয়েছিল, মনামি কিছুতেই খোঁজ পায় নি। বাবা মেয়েকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন কোচিংয়ে ছেলেদের সাথে পড়তে। এক আধটু বেড়াতে যেতে। সিনেমাতেও। ঠাকুমা একটু উদ্বিগ্ন থাকতেন। বাবা বলতেন আজকাল বিয়ের পরেও মেয়েদের জীবনে নানা রকম দুর্যোগ নেমে আসে। মেয়েকে সাবধান হতে শিখিও। তাহলেই হবে। কিন্তু কলেজে বা বিশ্ব বিদ্যালয়ে কোথাও সহপাঠীদের মধ্যে কাউকে মনে ধরে নি মনামির। মাঝে মাঝেই শিশু দেবজিৎ তার অমল কোমল মুখখানি নিয়ে স্বপনে হাজির হত। স্বপনচারিণীর কানে কানে বলত “হে প্রিয়তমা।” মেয়ে তাকে কত কি যে বলতে চাইত অনেক দূর থেকে কিছুতে শুনতে পাওয়া যেত না। তখন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে ভাব বিনিময় শুরু করলে কোথা থেকে অজস্র কুয়াশা এসে ভীড় করত।
বিবাহের বিজ্ঞাপন সূত্রে যে ছেলেটি মনামির পাণিপ্রার্থী হয়ে দেখা করতে এল সে অত্যন্ত সুপুরুষ চেহারার ব্যক্তি। বাবা ও জ্যেঠু তার সম্বন্ধে ভালো করে খোঁজ নেবেন বলেছিলেন। ঠাকুমা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন রক্ত পরীক্ষার কথা। মেয়ে গোঁ ধরল যে এই ছেলেকেই তার খুব পছন্দ। জ্যেঠু বললেন, এখুনি পাকা কথার প্রয়োজন নেই। আগে একটু মিশে হাল চাল বোঝার চেষ্টা করো। কেমন ফ্যামিলি, কেমন ডিম্যান্ড। বাবা বললেন ঠিক কি কাজ করেন ভদ্রলোক, ভালো ভাবে জানতে হবে। বাড়িটা নিজেদের কি না। খরচের হাত কেমন, আয় বুঝে ব্যয় করেন কি না, বাজারে দেনা আছে কি না।
মা বললেন ভালো করে রক্ত পরীক্ষা না করিয়ে আমি যার তার হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারব না। জ্যেঠু উঠে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মা রে, বিয়েটা একটা ছেলে খেলা নয়। এটা একদিন সিনেমা কি সার্কাস দেখে আসার সম্পর্ক নয়। অনেক ভেবে চিন্তে দেখতে হয়। মেয়ে মুখ গোঁজ করে বসে রইল। ঠাকুমা বললেন, শুধু চেহারা দেখে মজে গেলি ভাই? বাইরের চেহারা খানার সাথে আসল মানুষের মিল কতটা, তা জানতে চাইবি না?
মেয়ে জোর দিয়ে বলল দেবজিৎ কেই আমি বিয়ে করব। বাড়ির কেউ ভেবে পেল না বাড়ির সকলের আদরের অমন শান্ত সরল মেয়েটা এমন খেপে গেল কি করে!
বাবা বললেন, আমি কোনদিন তোমার ওপর কোনো সম্পর্ক চাপিয়ে দিই নি। কিন্তু আশা করেছিলাম তুমি বিয়ে স্থির হবার আগে যুক্তিসঙ্গত সাবধানতা নেবে। এখনো কিছুই হয় নি। তুমি আবার ভেবে দেখো। ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে মনামি বললো দেবজিৎকে না পেলে আমি বাঁচব না।
ঠাকুমার জেদে বিয়ের আগে মনামি পাত্রের সাথে একান্তে কথা বলে নিতে রাজি হল। দেবজিৎকে মনামি প্রশ্ন করল আপনি বিয়ে বাবদে পণ চাইবেন না তো? বিয়ের পর আমায় গানের ক্লাসে যেতে দেবেন তো? পাত্রের মুখ দেখে সবাই বুঝল সে যত তাড়াতাড়ি পারে বিয়ে করতে চায়।
বিয়ে হয়েও গেল ঝপ করে।
বর কন্যাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছলে সকলের আশীর্বাদ করার কথা। নানা রকমের স্ত্রী আচারের জন্যও মেয়েরা প্রস্তুত। বাড়ির সবাইকে হতচকিত করে নব বিবাহিতা কন্যাকে নিয়ে বাড়িতে এসেই নিজের ঘরে ঢুকিয়ে দোর দিল সে। তার পরে ত্বরিত হাতে মেয়ের অধোবাসটুকু খুলে উপর্যুপরি ভোগ করল সে। বিহ্বল মনামি পেশিবহুল বলিষ্ঠ চেহারার দেবজিৎকে ভাল করে বাধাই দিতে পারল না। নিঃসীম কান্না তার কণ্ঠরোধ করে রইল। মেয়ে যেন বার বার বলতে চাইল ছি ছি , এ আপনি কি করলেন? আমাকে একটু প্রস্তুত হবার সুযোগটুকু দিলেন না? বাইরে আত্মীয়রা আমাদের কি রকম ভাববেন?
এসব প্রশ্ন কিছুই মনামি করে উঠতে পারল না। রক্তাক্ত উরুসন্ধি কোনোমতে চেপে সে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে রইল। হিসহিস স্বরে দেবজিৎ বললে সিন ক্রিয়েট করো না। এটাচড বাথ আছে সাফ সুতরো হয়ে নাও।
তবু মনামি গ্যাট হয়ে বসে আছে দেখে দেবজিৎ ফোনে তার এক পিসিকে ঘরে আসতে হুকুম করল। মনামি প্রায় দৌড়ে বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে দেখল বিছানার নূতন চাদরে তার কাঁচা রক্তের দাগ। অমনি মনে পড়ল প্রাচীন গ্রিস দেশে নব বিবাহিতা বধূকে সঙ্গমের সময় সাদা চাদর পেতে রাখা হত। সঙ্গমের পর চাদরে রক্তের দাগ না পাওয়া গেলে মেয়েটিকে অসতী মনে করা হত। মনে পড়ে গেল স্ত্রী অঙ্গের অভ্যন্তরে হাইমেন নামে সামান্য একটি পর্দার কথা। সঙ্গম ছাড়াই অন্যন্য নানা কারণেই যা ছিঁড়ে যেতে পারে। দেশীয় ভাষায় তার নাম দেওয়া আছে সতীচ্ছদ। স্ত্রী শরীরকে কি চোখে দেখেছে এরা ভেবে বিশ্রী ঘেন্না পেল মনামির।
পিসি তাকে আবার সাজিয়ে গুছিয়ে তুলল। কিন্তু যে তাকে দেখল সেই বুঝতে পারল বরের হাত ধরে বাড়িতে ঢুকে ছিল যে সলজ্জ মেয়েটি, আর ঘর থেকে কান্না কাজল মেখে যে বেরিয়ে এল, তারা কখনোই এক মেয়ে নয়।
আশীর্বাদ ও অন্যান্য স্ত্রী আচারে একবারের জন্যও তার হাসি মুখটি ক্যামেরায় ধরতে পারল না চিত্র গ্রাহকেরা। তারা হাল ছেড়ে দিল। নববধূ কোনো প্রবীণ আত্মীয়েরই পদ স্পর্শ করে প্রণাম করল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। তার সিঁথির লাল ডগডগে সিঁদুর কেবলই তাকে সেই রক্তাক্ত চাদরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। তার মুখের পেশি কঠিন হয়ে উঠতে চাইছিল। তার গলায় থুতু উঠে আসছিল। খাবার সময় তার খিদে পেল না। তার তেষ্টা পেল না। তার চোখে যেন মরুভূমির ঝড় চলছিল। পাড়া প্রতিবেশী যারাই বউ দেখতে এল, কারো দিকে চেয়ে বউ হাসল না। সবাই কানে কানে বললো মেয়েটার কি এমন চমৎকার বরকেও পছন্দ হয় নি?
ফুলশয্যার রাতে বিছানায় যাবার আগে বধূকে পোশাক খুলতে হুকুম করল মালিক। একবগগা ঘোড়ার মতো অন্য দিকে চেয়ে থেকে স্বামীর আদেশ উপেক্ষা করল মেয়ে। দেবজিৎ আলো না নিবিয়েই জোর করে তার অধোবাস খুলে নিল। লজ্জাহারার সজ্জায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মনামি বলল, এভাবে জোর করে কান মুচড়ে ভালবাসা আদায় করা যায় না। আপনি যেটা করছেন, তাকে রেপ বলে। ম্যারিটাল রেপ।
দেবজিতের কঠিন হাতের চড়ে বিছানায় ছিটকে পড়ল মেয়ে। বাইরে থেকে যে মেয়েরা আড়ি পেতেছিল, তারা চড়ের শব্দে অবাক হয়ে গেল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।