ভাল মানুষের সন্ধানে বের হয়েছি। যদি পথে কোথাও এমন কারো সাথে দেখা হয়ে যায়, তবে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে দেখবো। এই পৃথিবীতে মোহ সৃষ্টি করার মতন অনেক কিছুই আছে, তবে ভাল মানুষ দেখার ভেতর যে মুগ্ধতা এমন মুগ্ধতা আর কোন কিছুতেই হয়না।
ভাল মানুষ খুঁজবার জন্য আমি প্রথমত একজন খারাপ মানুষ অনুসন্ধান করতে বের হলাম। সবচেয়ে যে জঘন্য সে’ও নিজেকে সবসময় ভাল মানুষ প্রমাণে ব্যস্ত থাকে। রাজনৈতিক নেতারা হলো এদের মধ্যে অন্যতম। নামের আগে জনদরদী লেখা থাকলেও, এরা মূলত জনবিরোধী চরিত্র প্লে করে। ভাল মানুষ খুঁজতে বের হয়ে ভাল মানুষ গুলোকে এড়িয়ে খারাপ মানুষ খুঁজছি।
এই শহরে খারাপ মানুষ খুঁজতে গেলে প্রথমেই যেতে হবে ছিচকা চোর অথবা ছিনতাইকারিদের কাছে। ছিনতাইকারিরাও এক ধরনের ভাল মানুষ। প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে মোবাইল টান দিয়ে নিয়ে যাওয়া লোকটা তার সন্তানের কাছে হয়তো একজন ভাল বাবা। আমি এমন ভাল এবং খারাপ মানুষদের মিশ্রণ এড়িয়ে যাচ্ছি। এরা খারাপ মানুষও না আবার ভাল মানুষও না; এরা হলো খালো মানুষ। মানে- ভালো ও খারাপের ক্রশ জাত।
ভাল মানুষ অনুসন্ধানের জন্য একজন চায়ের দোকানদারকে সিলেক্ট করা যেতে পারে। সাধারন জীবনযাপন করা মানুষরা কখনো কখনো ভাল মানুষ হয়ে থাকে। রাস্তার ধারের টং দোকানে এক চাওয়ালাকে এক কাপ চা দিতে বললাম। চা মুখে দিয়েই বুঝা গেলো, কোথাও একটু ঝামেলা আছে।
চা থেকে ভুকভুক করে কর্পূরের গন্ধ বের হচ্ছে। এই চায়ে ব্যবহার করা পাতির দাম কম। কারন এই চা পাতি মূলত একবার লাশের শরীরে ব্যবহার করা হয়েছে। লাশের শরীরে ব্যবহার করা চা পাতিতেই কেবল কর্পূরের গন্ধ থাকে।
একজন রিক্সাওয়ালাকে কি ভাল মানুষ বলা যায়? যে মানুষ ঘামের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে, তার ভাল হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম নয়। রিক্সাওয়ালাকে বললাম- ওই মামা, সাইন্সল্যাব যাইবা?
রিক্সাওয়ালা প্রথমে না সূচক সিগন্যাল দিলেও, পরে আশেপাশে তাকিয়ে যখন দেখলো আর কোন রিক্সা নাই, তখন বললো ভাড়া ১০০ টাকা পড়বো। আমি বললাম- এখানে ভাড়া তো মাত্র ৪০ টাকা। সে জবাব দিল- গেলে চলেন, না গেলে নাই।
আমি বুঝলাম, সে মূলত সুযোগ সন্ধানী একজন মানুষ। যার নৈতিকতার উপর তার নিজেরই আস্থা নাই। এ ভাল মানুষ হতে পারেনা।
রাস্তার ধারে পাজারো গাড়ি থামিয়ে একজন ত্রাণ দিচ্ছে। আমি সামনে এগিয়ে দেখলাম, একজন একটা ত্রাণের বস্তা নিয়ে আবারও গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে। তার পাশের অভুক্ত মানুষটিকে নিয়ে তার কোন আগ্রহ নাই।
আমি ত্রাণ দাতার দিকে তাঁকালাম। যে দান করে, তার মন হয় উদার। অথচ, ত্রান দাতা প্রতিটি ত্রাণ দেওয়ার সময় ক্যামেরার দিকে পোজ দিচ্ছে। খুব সম্ভবত উনি তার পারসোনাল ফটোগ্রাফার হবেন। যেখানেই ভাল কিছু করার সুযোগ থাকে, সেখানেই ফটোগ্রাফার ক্লিক করে বসে।
আমি একজন প্রেমিককে খুঁজে বের করলাম। খুব সম্ভবত ছেলেটি ছাত্র। তার প্রেমিকার হাত ধরে বসে আছে। যারা ভালোবাসতে জানে, তারা কখনো খারাপ মানুষ হতে পারেনা। আমি এই যুগলের পাশে যেয়ে বসলাম। ছেলেটি মেয়েটিকে একটি স্বর্ণের গহনা উপহার দিচ্ছে। এমন বয়সের একটি ছেলে তার প্রেমিকাকে এত দামি একটি গহনা কি করে দিতে পারে? এটা তার মায়ের গহনা নয় তো? যা আলমারিতে মায়েরা যত্ন করে রেখে দেয়।
রাস্তার ধারের ভিক্ষুকটি এতক্ষন চোখে দেখতো না। মানুষজন কমার সাথে সাথেই সে চোখে দেখতে শুরু করলো এবং তল্পিতল্পা গুছিয়ে সিগারেট টানতে টানতে হাঁটতে লাগলো।
আমি বিস্ময় নিয়ে মানুষ দেখছি। মানুষ দেখার আনন্দ আছে এবং বেদনার অংশটুকুও একেবারে কম নয়। শহরে কত কত মানুষ, কত কত মুখোশ পরে থাকে। বাইরে থেকে এদের আসল চেহারাটা বুঝা যায়না।
আমি হাঁটছি, একজন ভাল মানুষের সন্ধানে। চোখের ক্ষুধা মূলত মুগ্ধতা। আমি একজন ভাল মানুষের দিকে তাকিয়ে চোখের ক্ষুধা নিবারণ করার চেষ্টা করছি। এই চোখ খারাপ মানুষ দেখতে দেখতে ভাল মানুষ দেখলেও সহজে বিশ্বাস করতে চায়না।
আমার ক্লান্ত লাগছে। তবু আমি হাঁটা থামাবো না। আমাকে একজন ভাল মানুষ খুঁজে বের করতে হবে। অন্তত একজন ভাল মানুষ; যার দিকে তাকিয়ে থেকে বলা যায়- আপনি এখানে স্ট্যাচুর মতন বসে থাকুন, আমি দু চোখ ভরে আপনাকে আরো কিছুক্ষণ দেখি।