জন্ম বর্ধমানের গুসকরায়।বেড়ে ওঠা গ্রাম্য পরিবেশে। বোলপুর কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম এ। বাবা ছিলেন শিক্ষক ও সাংবাদিক ফলে রক্তস্রোতে মিশেছে অক্ষরলীপ্সা, ভালোবাসেন রম্যরচনা, ছোটগল্প ও ফিচারে বিচরণ করতে। জলবৎ তরলং তাঁর প্রথম গ্রন্থ। তাঁর ছোটগল্প ঠাঁই পেয়েছে নানা গল্প সংকলনে। "এখন শান্তিনিকেতন" "মাসিক কৃত্তিবাস" ও "বিচিত্র পত্রে" লেখালিখি করেছেন।এখন কর্মরত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাণী সম্পদ উন্নয়নে
মাসি
একটা অতিকায় শব্দ করে বাইকটা দাঁড়ালো। অন্যান্য দিনের চেয়ে তপো আজ একটু দেরীতেই অফিস থেকে ফিরল। গেট খুলতেই ওর তিন বছরের ছেলে শাম্ব আধো আধো গলায় ওকে বলল “মাতিকে না ভ্যানে করে নিয়ে চলে গেছে”। তপো শুধালো- “কোথায় সোনা?” শাম্ব বলল- “উই দিকে, দেদিকে হাম্বা চড়ে”। বাইকটা রাখতে রাখতে তপো জিজ্ঞাসা করল “কি ব্যাপার গো? ” কিচেন থেকে বের হতে হতে স্নিগ্ধা বলল- “জানো আসলে মাসি না আজ মারা গেছে।” মাসি বলতেই তপো একবার ভেবে নিল নিজের মাসিদের কথা, তারা তো কবেই দেহ রেখেছেন। তবে কোন মাসি? মনে পড়ল ওর, তবে কি ঋকদের বাড়ির মাসি? তপোর মনে এমনিতেই এক ঝকঝকে ধারনা আছে তা হল মাসি দু-প্রকার, এক রক্ত সূত্রের, দুই কাজ কামের ।ঋকদের মাসিও ঐ দ্বিতীয় শ্রেণীর, বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু নারী গাছে ফল আসেনি, তাই শ্বশুরবাড়িও কালক্ষেপ করেনি তাকে বাপের বাড়ি বসিয়ে দিয়ে যেতে। রক্তের বাঁধনও দড়ির বাঁধনের মতোই যত দিন যায় আলগা হয়। এক্ষেত্রেও তাই, বাঁধন একসময় ছিঁড়ে যায়, তারপর এর বাড়ি ওর বাড়ি কাজ।সেইভাবেই কাজে ঢোকা রায় বাড়িতে। সমীরণ রায় একজন প্রভাবশালী মানুষই কেবল নয়, মনটিও পরিবারের সবার চেয়ে নরম। বাড়ির লোকেরা মাসিকে দিয়ে একটু ফাইফরমাশ খাটালেই সে রে রে করে ওঠে। ওর পোস্টিং বালুরঘাটে, মাসে একবার বাড়ি ফেরা, মাসির জন্য হরলিক্স আনতে কখনোই ভোলেনি সে। এসব আবার দেখতে পারে না, ওর মা-বাবা।তারা বলে-“শোন সমু কাজের লোকদের মাথায় চড়াতে নেই।” সমু কিছু বলে না ,সে জানে বলে লাভ হবে না। শুধু হেসে বলে- ” কটা দিনই বা বাঁচবে!” মাসির ডান চোখটা খুব অদ্ভুত ছিল, মণিটা একেবারে সাদা, শাম্বকে স্নিগ্ধা ভয় দেখিয়ে খাওয়ায়- “এইবার মাসি চলে আসবে খেয়ে নাও সোনা। ” মাসি শাম্বকে বড় ভালোবাসতো, কোলে নিতো না যদি ভয় পায় সেই ভেবে। মাসির স্বামীকেও তপো চেনে । পেঁচো মাতাল, বারগ্রামের দিকে বাড়ি, এ গাঁ সে গাঁ ঘুরে বেড়ায়। বেসিনে মুখ ধুয়ে কাগজটা নিয়ে বসল তপো, সেই এক খবর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক,জি ডি পি, ব্লা ব্লা ব্লা। ওর মা বললেন- ” বাবু একবার যাবি না শ্মশানে? সমীরন নেই। ব্যাঙ্গালোরে কনফারেন্সে।” সমীরণ নেই সেটা তপো জানে। খবর পেয়ে তার আসার কথা নয়, তবে আসার কথা যাদের, তাদের খবর দেওয়া হয়েছে, ভাইপো, ভাই, বোনেদের। এক ভাইপো নাকি এসে চলে গেছে অন্যদের ডাকতে যাচ্ছি বলে। তপো বারমুডাটা পরতে পরতে বলল- “শ্মশান যাত্রী, বাঁশ, খোল করতাল-এর ব্যবস্থা হয়েছে?” আকাশ থেকে পড়লেন ওর মা। বলে উঠলেন- “কি যে বলিস! রতন রায় দু হাজার টাকা বিচ্চুকে দিয়ে বলেছে, এর মধ্যে চালিয়ে নিতে বেশী লোক না ডাকতে, খাওয়াতে পারবে না। একটা ভ্যানে মরাটা বেঁধে নিয়ে গেল, মেটে পাড়ার কয়েকজন। ভদ্রলোক বলতে অরূপ, ঋক, মোহর আর ফুচাই।” ভদ্রলোক কথাটা তপোর মনে গজিয়ে উঠতেই একটা বিবমিষা হল ওর। তারা ভরা আকাশের নীচে অনেক কথা ভাবতে ভাবতে আদিবাসী পাড়াটা পেরিয়ে গেল ও, এরপরেই শ্মশান। লোকজন কম, তপো যেতেই, ঋক বললো “এসেছো?” তপো বলল- ” হ্যাঁ রে দেরী হয়ে গেলো। বাবা তো নেই, টাকা পয়সা কিছু লাগবে?” ঋক হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে তপোকে বলল- “তপোদা বাড়িতে বোলো না, বাবা মাসির শরীরের অবস্থা খারাপ দেখে কিছু টাকা রেখে গেছিল ডাক্তার দেখানোর জন্য। আমি নিয়ে এসেছি। কিন্তু সমস্যা হল কে মুখাগ্নি করবে? মাসি মানে তো মা একথা দাদুকে বলতেই খেঁকিয়ে বলল- “ওরে এ হল কাজের মাসি।” তপোর মনটা মিইয়ে গেল। এদিকে যারা দাহ করবে তারা চিল্লাচিল্লি শুরু করল “কে মুখাগ্নি করবে? কে?শালা বিনি পয়সার ঝঞ্ঝাট।” বোধ হয় চুল্লুর প্রভাবেই তাদের এই হৃদয় হীন আচরণ। বিনা-পয়সার মনু বামুনও ধৈর্য্য হারিয়ে চলে যাওয়ার তোরজোড় শুরু করল । হায় মাসি! ঘর ছিল, স্বামী ছিল, তবু জীবন নাটকের নাট্যকার কেন এই নিদারুন দৃশ্য এঁকে রেখেছিলেন কে জানে! ভাবছিল তপো। অভাগীদের জন্য সব যুগই সেফ হাভেন।স্বর্গ মানে না তপো। দূরে একটা কুন্ডলী পাকানো মানুষ। বহুক্ষণ থেকেই ফোঁপাচ্ছিল। হঠাৎই টলতে টলতে এসে একটা কাঠে আগুন জ্বালালো । হলদে আলোয় চিনতে পারল তপো। এতো মাসির স্বামী। টলতে টলতে গিয়ে সে মাসির মুখের কাছে আগুনটা ছোঁয়ালো । যদিও পুরোহিত তখন চলে গেছে। তারপর ওর মুখ থেকে হয়তো বা বুক থেকে উঠে এলো এক অস্ফুট আওয়াজ “আঃ”! প্রায়শ্চিত্তের কি আওয়াজ হয়? তপোর বুক থেকেও উঠে এল একটা গভীর আঃ। তপো জানেনা কেন!