“নিরবচ্ছিন্ন বর্ষার রাতে এখনও নিশ্চয় কলিকাতার একটি কর্দমাক্ত নোংরা ও কুৎসিত পথের ধারে কেরোসিনের ডিবার ম্লান আলো দেখা যায়। ডিবার ধূমবহুল শিখাকে শীর্ণহাতে সযত্নে বৃষ্টির ঝাপটা হইতে আড়াল করিয়া গভীর রাত্রি পর্যন্ত এখনও নিশ্চয় বিগতযৌবনা রূপহীনা রজনী একরাত্রের অতিথির জন্যে হতাশ নয়নে পথের দিকে চাহিয়া প্রতীক্ষা করে।“ প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সংসার সীমান্তে‘ গল্পটির কাহিনী আমাদের চারপাশে অবিরাম ঘটে চলা এক অতি সাধারণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু গল্পটিকে তিনি উৎকণ্ঠা ও হতাশার যে অদ্ভূত মোচড়ে শেষ করেছেন, তাতেই গল্পটি সার্থকতা লাভ করেছে। একটি অতি সাধারণ ঘটনাকে কিভাবে অসাধারণ এক গল্পে রূপান্তরিত করা যায়, তা জানতেন শ্রী মিত্র।
কল্লোলযুগের তিন নক্ষত্র অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র বাংলাসাহিত্যকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাসাহিত্যে কল্লোলগোষ্ঠী যে প্রতিভাবানদের মিছিল সৃষ্টি করেছিল, তার অগ্রগামী সৈনিক ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর অধিকাংশ গল্পেই এসেছে মধ্য-নিম্নবিত্ত মানুষের টানাপোড়েন ও জীবনযন্ত্রণার কথা। কিন্তু এই পূতিগন্ধময় দুনিয়ার কথা অত্যন্ত সহজ, সাবলীলভাবেই উঠে এসেছে তাঁর লেখনীতে। তাঁর কবিতার মতোই ছোটোগল্পের ভাষায় চিত্রকল্পের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অথচ এমন একজন মানুষ নাকি লিখতে চাইতেন না? এরকম কথা শুনলে সত্যিই অবাক হতে হয়। একসময়ের সাড়াজাগানো সাহিত্যিক, নানা পুরষ্কারে ভূষিত প্রেমেন্দ্র মিত্র যাঁর হাত দিয়ে বেড়িয়েছে ‘পুন্নাম’, ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘মহানগর’, ‘হয়তো’, ‘স্টোভ’ ইত্যাদি দুর্দান্ত সব গল্প; তিনি নাকি লিখতে চাইতেন না? “লেখার ব্যাপারে সত্যিই কুঁড়েমি ছিল ওঁর। কালিঘাটের বাড়িতে বসে দেখতাম বাবা লিখতে লিখতে উঠে পায়চারি করছেন, ভাবছেন। আবার গিয়ে বসছেন লেখায়। … লিখতে বসলে তাঁর কিছু খেয়াল থাকত না। চেয়ার-টেবিলে লিখতেন না। যে খাটে শুতেন, তার তলায় একটা তোরঙ্গ থাকত, সেটা টেনে তার ওপর বসতেন। আর একটা ম্যাসোনাইট বোর্ড ছিল, সেটা খাটে রেখে তার উপরে কাগজে লিখতেন ছোট্ট, ছোট্ট, পরিষ্কার অক্ষরে।“ বাবার স্মৃতিচারণায় এই কথাগুলি বলেছেন সাহিত্যিকপুত্র শ্রী মৃন্ময় মিত্র।
তবে এর পাশাপাশি তাঁর যে মহৎ গুণটি ছিল তা হল নতুনদের লেখা পড়ে দেখা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় – “সাধারণত প্রবীণ লেখকেরা পরবর্তী প্রজন্মের রচনা বিশেষ পড়ে দেখেন না। কিন্তু প্রেমেন দা সবসময়ই সাম্প্রতিক সাহিত্যের খুঁটিনাটির খবর রাখতেন।“ তাঁর ঐ আলস্যজনিত খামতি হয়তো এই মহৎ গুণেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। প্রেমেন্দ্র মিত্র বরাবরই ছিলেন একটু আলাদা। চিরকালই তিনি বাঁধা গৎ ছাড়িয়ে স্বতন্ত্রভাবে নিজের শর্তে বাঁচতে চেয়েছেন, যার বিভিন্ন নিদর্শন বহু জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। সাহিত্যে অশ্লীলতা নিয়ে যখন সে যুগ ভয়ঙ্করভাবে আন্দোলিত হচ্ছে, তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র উচ্চারণ করলেন একটি অমোঘ বাক্য – “শঙ্কাটা সাহিত্যের অশ্লীল হয়ে ওঠা নিয়ে নয়, অশ্লীলতার সাহিত্য সাজবার চাতুরি ও স্পর্ধা দেখে।“ এই একটি বাক্যই তাঁর জাত চিনিয়েছে সমগ্র সাহিত্যজগতকে।
একেবারে সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত এই শিল্পী মানুষটির দৈনিক রুজি-রোজগার এবং বেঁচে থাকার চৌহদ্দিটা একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে তাঁর অসংখ্য গল্প-কবিতা-উপন্যাসের সাবলীল প্রেক্ষাপট। হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীটে তাঁর বাড়ির কাছ দিয়ে অনাদিকাল ধরে বহমান আদিগঙ্গার স্রোতস্বিনী ছবির পাশে মাছ ব্যবসায়ীদের আনাগোনা, ঘুপচি গলির চারপাশে রাস্তার বাঁদিক-ডানদিক জুড়ে ইঁট-বালি-সুড়কির দোকানপাট, বিক্ষিপ্ত ঠেলাগাড়ির জটলার পাশ দিয়ে ছুটে চলা কামারশালের আগুনের ফুলকি, ঘূর্ণায়মান কুমোরের চাক – এইসব ছোটোখাটো ব্যবসায়িক মানুষের জীবনযাপনের চিত্র জীবন্ত হয়ে ধরা দিত জীবনশিল্পী প্রেমেন্দ্রর চোখে। আর এই বিষয়গুলি থেকেই শিল্পীমনের পাকশালে তৈরি হত একের পর এক সুস্বাদু, সাড়াজাগানো সব সাহিত্যকীর্তি। “লোকে সোনার চামচ – রূপোর চামচ মুখে জন্মানোর কথা বলে, আমি তো ‘প্ল্যাটিনাম টাং’ নিয়ে জন্মেছিলাম” বলতেন মিত্রমশায়। তাঁর দাদামশায় যখন মারা যান, তাঁর দিদিমার কাছে নাকি ষাটহাজার টাকার সোনার গয়না, আশিহাজার টাকার কোম্পানির শেয়ার ছিল। কিন্তু তা আত্মীয়রা একেবারে লুটেপুটে নেয়। কালিঘাটে আদিগঙ্গার ধারে ৫ হাজার টাকাও দাম হবেনা এমন বাড়ি প্রেমেন্দ্র আত্মীয়দের চাপে পড়ে কিনতে বাধ্য হন প্রায় ২৫ হাজার টাকা দিয়ে। তাঁর ছোটোবেলা কাটে তীব্র অর্থকষ্টে। এক ফুটবলার বন্ধু তাঁর কাছ থেকে পাঁচ-দশহাজার টাকা ধার করে নির্দ্বিধায় ঝেড়ে দেয়। অর্থাৎ তাঁর জীবন শুরু হয় একেবারে পেনিলেস অবস্থা থেকে। তাই বোধহয় এই বাস্তবতার ছোঁয়া লেগেছে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যেও। প্রেমেন্দ্র মিত্রের অধিকাংশ গল্পের ক্ষেত্রেই বাংলার মধ্যবিত্ত জীবনের ভয়াবহ জীবনসঙ্কট উঠে এসেছে, যার প্রেক্ষাপট ছিল তাঁর অতি পরিচিত রুগ্নভগ্ন চেহারার কল্লোলিনী কলকাতা। তাঁর প্রতিটি গল্পের বিষয়বস্তুই পাঠককে তীব্র এক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত করেছে, করেছে রক্তাক্ত। তাঁর ‘কুয়াশায়’, ‘শুধু কেরানী’, ‘নতুন বাসা’, ‘পরোপকার’, ‘অরণ্যপথ’, ‘বৃষ্টি’ ইত্যাদি গল্পগুলি মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিক জীবনযন্ত্রণার এক প্রামাণ্য দলিল হিসেবেই রয়ে যাবে আজীবন।
আসলে জীবনকে বাদ দিয়ে যে সাহিত্য হয় না, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ছিলেন এই মানুষটি। তিনি বিশ্বাস করতেন সাহিত্যের সত্যতায়, কৃত্রিমভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে সাহিত্য সৃষ্টির ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। জীবন ও সাহিত্যকে আলাদা পথে না চালিয়ে কৃত্রিমতার হাতে সঁপে না দিয়ে তিনি জীবনের অনিবার্য সংকট, বিশ্বাসভঙ্গ, অস্তিত্বহীনতা ইত্যাদিকে তুলে এনেছেন তাঁর সাহিত্যে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা কখনও পুরোনো হয় না; কেননা কালে কালে মধ্যবিত্তের জীবনাচরণ পাল্টালেও জীবনযন্ত্রণা, হাহাকারের রূপটি সেই একই আছে। আর তাই গল্পগুলি পাঠকের মনোজগতকে নানা সময়ে, নানা ভাবে নাড়া দিয়ে যায়। যুগে যুগে শাশ্বতভাবনাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে। নগরসভ্যতা, মধ্যবিত্ত মানুষ যতদিন থাকবে, হাত ধরাধরি করে থাকবে জীবনযন্ত্রণা, তীব্র অর্থকষ্ট, স্বপ্ন ভাঙ্গা-গড়ার ইঙ্গিত; ঠিক ততদিনই স্বমহিমায় বিরাজ করবেন প্রেমেন্দ্র মিত্র নামক স্বার্থক এই জীবনশিল্পীটি তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মে। ততদিনই তাঁর গল্প মানুষকে পথ দেখাবে উত্তোরণের।