চিত্রকাহনে ঋত্বিক ভট্টাচার্য – ১

প্রথমেই বলে রাখি আমার লেখার হাত নিতান্তই খারাপ। তাই নিম্নলিখিত আবর্জনাটি একটু সহ্য করে নিতে হবে।
সালটা ছিল ২০১৩-১৪। কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করছি রবীন্দ্রনাথের আপন জায়গা বিশ্বভারতীতে। সদ্য সদ্য সুপারজুম ব্রিজ ক্যামেরা কিনেছি বন্ধুর দেখে। যা পারছি তাই তুলছি। চাঁদ, পাখি, মানুষ কিছু বাদ যায় না আমার চোখ থেকে। এমনই অবস্থায় বন্ধুর কাছে খবর পেলাম যে লালবাঁধ বলে একটা দীঘি আছে যেখানে নাকি অনেক পাখি আসে। সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ করেই দৌড়ালাম। পেয়েও গেলাম কিছু ভালো পাখি। ফেসবুকে ছবি ছাড়তেই জানতে পারলাম সেগুলোর মধ্যে নাকি পরিযায়ী পাখিও আছে। নাম তাদের গালভরা; রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড, বারহেডেড গিজ, ব্ল্যাক রেডস্টার্ট ইত্যাদি। এভাবেই তৈরি হল আমার পাখির ছবি তোলার নেশা।
এবার সোজা চলে যাওয়া যাক ২০১৬য়। স্নাতকোত্তরের জন্য ভর্তি হলাম সুদূর কোচবিহার জেলার পুন্ডিবাড়িস্থিত উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসে একই সাথে চমকিত আর নিরাশও হলাম। উত্তরবঙ্গ নিয়ে কত কিছু শুনতাম; কিন্তু পাহাড় কই? জঙ্গল কই? ভালো পাখি কই?
ভুল ভাঙতে সময় লাগলো না। আমার মতই পাগল বন্ধুও জুটিয়ে ফেললাম কয়েকটা। ত্রিপুরার দেবজ্যোতি, পুলক এরা হয়ে উঠলো আমার সবরকম পাগলামির সঙ্গী। তখন আমার জীবন একই সাথে সুখ আর দুঃখের ঘূর্ণিতে ঘুরছে। একদিকে বাড়িতে অসুস্থ মা’কে দেখতে যেতে পারছি না বলে পড়াশোনায় মন দিতে পারছি না, অবসাদ গ্রাস করছে; অন্যদিকে আমার ছবি তোলার নেশা আমাকে কিছুতেই হেরে যেতে দিচ্ছে না। ক্যামেরাও আস্তে পিছিয়ে পড়ছে বুঝতে পারছি। এভাবেই প্রথম সেমিস্টারে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে বাড়ি এলাম। মা বাবা আগেই বলেছিলেন ক্যামেরা কিনে দেবেন। বাড়ি এসে আশাতীত ভাবে নিকনের ডি৭২০০ আর সিগমার ১৫০-৬০০ জুটে গেল। শুরু হল আমার দ্বিতীয় ইনিংস।

ততদিনে মোটামুটি বুঝে গিয়েছি আমার বিশ্ববিদ্যালয় একটি লুক্কায়িত স্বর্ণখনি বিশেষ। নতুন ক্যামেরা কিনে ইতিমধ্যেই চমকিত এবং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর অবস্থায় ছুটি কাটিয়ে হস্টেলে ফিরলাম। এই সময়েই জানতে পারলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা জঙ্গল আছে। বিশেষ কারণে এখানে জঙ্গলটির নাম উল্লেখ করবো না। দেবজ্যোতিকে নিয়ে যাওয়া শুরু হল। মোটামুটি অনেকবার গিয়েছি এবং সত্যি বলতে কী, সেরকম ভাবে ভালো ছবি পাইনি কিন্তু যা পেয়েছি, তার কোনো তুলনাও নেই। জীবনে প্রথমবারের জন্য জঙ্গলে হরিণ দেখা, অবিশ্বাস্য রকমের বড় শিকারী পাখি দেখা সব এখানেই। মাঝে পুন্ডিবাড়িই বাসিন্দা অর্ণবদার সাথেও গিয়েছি। জঙ্গলের পাশেই তোর্সা নদী। সেই নদীর ধারেও অনেক পাখি পেয়েছি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কালা কাস্তেচরা(Red naped ibis), ব্রাহ্মণী হাঁস(Ruddy shelduck), ফটকা মাছরাঙা(Pied Kingfisher), রিভার ল্যাপউইং, ছোট নথজিরিয়া(Little ringed plover), ছোট বাবুইবাটান(small pratincole) ইত্যাদি।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়লো। কোচবিহার,আলিপুরদুয়ার এসব জায়গায় কিন্তু দুটি জিনিস মোটের ওপর বেশ বিখ্যাত। অজগর এবং লেপার্ড। এই অর্বাচীনের কপাল মন্দ, কোনোটাই দেখার সুযোগ হয়নি। তবে একবার দেবজ্যোতির সাথে গিয়ে লেপার্ডের উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম বইকি। চারিদিকে মৃত্যুর মত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। মাঝে খালি হরিণ আর বুনো শুয়োর দৌড়ে পালাচ্ছে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি, মুখে বলে বা খাতায় লিখে বোঝানো যায় না। এদিকে আকাশে ঘন মেঘ। আমরা দুই বন্ধু সাইকেল নিয়ে গিয়েছিলাম। যেদিকে এসেছিলাম সেদিকে না ফিরে অন্যদিকে ফিরলাম। ফিরলাম বলা ভুল, বলা ভালো পালিয়ে বাঁচলাম।

মেঘের কথা যখন এল, বৃষ্টির কথা বাদ যায় কেন? বৃষ্টির দিনগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আলাদা রূপ দেখা যায়। নিচু জায়গাগুলো জলে ডুবে যায়। তার মধ্যে জেগে ওঠে অজস্র ইন্ডিয়ান বুল ফ্রগ বা সোনাব্যাঙ। মূলত রাত হলেই শুরু হয় ব্যাঙেদের সমবেত সঙ্গীতানুষ্ঠান। চারিদিকে শুধু ব্যাঙের আওয়াজ আর তার সাথে জলের মধ্যে তাদের লাফিয়ে বেড়ানো। অস্বীকার করবো না, দেখতে মন্দ লাগেনি কখনও। তবে কখনো কোনো সাপকে দেখিনি তাদের ধরার চেষ্টা করতে। হয়তো সাপগুলো মানুষের সামনে আসতে চায় না। সারাদিন ক্লাসের পর রাতগুলো মোটামুটি এসব দেখেই কেটে যেত। যেদিন বৃষ্টি হয় না সেই রাতগুলো পেঁচা দেখে নাইটজারের ডাক শুনে ভালোই কাটত।

চলবে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।