• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে দিলীপকুমার  মিস্ত্রী

ডাক্তারবাবু 

ডাক্তারবাবুদের ধর্মঘট আজ চারদিনে পা দিয়েছে মহানগরীর একটি নামী মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তার  নিগ্রহের জেরে এই ধর্মঘট  তবে ধর্মঘট এখন শুধু মহানগর নয়, সারা রাজ‍্য মায় দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাই গাঁগঞ্জের গরীব মানুষগুলোর দুর্ভোগ চোখে দেখার মতো নয় দুটি শিশু এবং দুজন প্রসূতিমা সহ বেশ কয়েকজন মানুষ বিনা চিকিৎসায় এই দিনে মারা গিয়েছে  তবু ধর্মঘটের বিরাম নেই ডাক্তারবাবুরা অনড়
সকাল সাড়ে আটটা বাজেজুনিয়র ডাক্তার সুশান্ত হাঁসদা হোস্টেলে নিজের রুমে চেয়ারে চিন্তায় মগ্নরাতে ভালো ঘুম হয়নিবন্ধুদের সঙ্গে ধর্মঘটে সেও সামিল হয়েছেকিন্তু কাজে তার মন কিছুতে সায় দেয় না তার মাথায় প্রথম দিন থেকে অতীতের একটি ঘটনা বারবার ঘুরেফিরে আসছে। 
আজ থেকে আঠারো বছর আগে তার মা অকালে পৃথিবী ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গিয়েছে শুধুমাত্র একজন ডাক্তার তার কাছাকাছি না থাকার কারণেতাই ডাক্তারদের ধর্মঘটে তার মন কখনও সায় দিতে পারে নাতবু বন্ধুত্ব রক্ষার তাগিদে তাকে একরকম মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, নিরুপায় হয়ে সকলের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে। 
গত কয়েকদিন ধরেই তার মনের মধ্যে মায়ের কথা বারবার বেজে চলেছে। ‘কতইবা বয়স হয়েছিল  মায়ের ? বড়জোর পঁচিশ কি ছাব্বিশওটা কী একজনের মরার বয়স হল ?’  সুশান্ত মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে
সে  মায়ের প্রথম সন্তানতার যখন বছর বয়স, তখন তার মা দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের জন্য গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলতাদের ঘর থেকে বেশ কিছুটা  দূরে ছিল সেই হাসপাতাল
সেদিন, তখন সবে সন্ধে গড়িয়েছেদিনটি ছিল শ্রাবণ মাসের চতুর্থ দিনঅর্থাৎ ভরা বর্ষাকালদুপুরের পর থেকে অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়েই চলেছেএরমধ্যেই অতিকষ্টে সুশান্তের বাবাকাকা, প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে রাধাডিহি গ্রামীণ হাসপাতালে পৌঁছাল  মাকে নিয়েকাকির সঙ্গে সেও গিয়েছিল কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর পর জানা গেল
হাসপাতালে ডাক্তারবাবু নেইতিনি বেরিয়ে গিয়েছেন অনেক আগেতার বাড়ি এখন থেকে অনেক দূরে, শহরেআজকে তিনি আর আসবেন না।  অন্য কর্মীরা বলল, রুগীকে মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যেতেকিন্তু হাতে সময় নেইরুগীর অবস্থা আশঙ্কাজনকঅগত্যা, রুগীর পরিবারের সবাই হাসপাতালের  নার্সটিকে বলল, “দিদি, আপনি যা হোক কিছু করুনআমরা সবাই আপনার পাশে আছিরুগীর অবস্থাটা আমরা তো দেখতেই পাচ্ছিখুবই খারাপআপনি চেষ্টা করে যদি একজনকেও বাঁচাতে পারেন!”
নার্সটি চার ঘন্টা আপ্রাণ চেষ্টা করলেনকিন্তু শিশুটিকে নিরাপদে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারলেও, তার মায়ের দুচোখে চিরকালের জন্য অন্ধকার নেমে এলকিন্তু এরজন্য রুগীর পারিবারের কেউ নার্সটির প্রতি কোনরূপ খারাপ ব‍্যবহার করল নাবরং তাঁকে সবাই বলল,”আপনি অনেক চেষ্টা করেছেনআপনার চেষ্টায় একজন প্রাণে বেঁচেছেসেটাই আমাদের কাছে অনেকআপনার কাছে আমরা সবাই চিরঋণী হয়ে থাকলামতবে ডাক্তারবাবু থাকলে, আরেকজনের প্রাণটাও হয়তো বাঁচানো সম্ভব হোতআমাদের কপাল খারাপগ্রামের গরীব মানুষের জীবন আর কত দামী হয় !”
সুশান্তের সেই বোন এখন কলেজে পড়ছেসেও ডাক্তারী পড়বার সুযোগ পেয়েছিলকিন্তু বাবার ইচ্ছে, মেয়ে শিক্ষিকা হোকগ্রামের মেয়েদের লেখাপড়া শেখার কাজে সাহায্য করুকমেয়েও বাবার ইচ্ছেকে বাস্তব রূপ দিতে মানসিকভাবে নিজেকে তৈরি করছে নিষ্ঠার সঙ্গে
এরমধ্যেই  সুশান্তর টেবিলে রাখা মোবাইল বেজে উঠলসে দেখল, বাবার ফোনশুরু হল বাবাছেলের কথাবার্তা
হ‍্যাঁ বাবা, বল
শুনছি, আজ বিকেলে স্বাস্থ‍্যমন্ত্রী তোমাদের ডেকেছেন আলোচনার জন্যতুমি কী যাচ্ছো ?
ঠিক নেই বাবাযেতেও পারি, নাও যেতে পারি। 
না, আমি বলছি, তুমি অবশ্যই যাবে। 
হ‍্যাঁ বাবা, আমি তোমার মনোভাবটা বুঝতে পারছিআচ্ছা,আমি যাব
শুধু যাবে না, পজিটিভ ভূমিকা পালন করবেতোমাকে আমি শুধুমাত্র একজন ডাক্তার হিসেবে দেখতে চাই নাডাক্তার হবার সঙ্গে সঙ্গে একজন সম্পূর্ণ মানুষও তোমাকে হতে হবেমনে রাখবে, পরেরটি ফার্স্টপ্রায়োরিটি। 
বাবা, আমি তোমাকে কখনও নিরাশ করবো নামা হারানোর যন্ত্রণা, আমি আজও ভুলতে পারিনি
শোনো বুবু, তোমাকে আমি একটি গল্প বলছি শোনোআসলে, এটা কোনো গল্প নয়, একটি সত্যি ঘটনাআমার মামাবাড়ি যুগবেড়িয়া গ্রামের ঘটনাতুমি এটা রেকর্ডও করে নিতে পারোপরে বন্ধুদের শোনাবে
ঠিক আছে বাবা,আমি রেকর্ড করে নিচ্ছিবল
আমি তখন খুব ছোটসবে ফাইভে উঠেছিপুজোর ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিসেটা অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় ছিল। 
আমাদের পলাশডিহিও একটা গ্রামকিন্তু আমার মামাবাড়ির গ্রামটা ছিল খুবই উন্নত গ্রামতুমি সেখানে কখনও যাওনিগেলে বুঝতে পারতে, আদর্শ গ্রাম কাকে বলে। 
আমি, মা আর দিদি গিয়েছিবাবা সেবার যেতে পারেনিআমার মামাবাড়িটা ছিল গ্রামের হাসপাতাল লাগোয়াই বলা চলেআমরা সেখানে পৌঁছেই জানলাম, হাসপাতালে ডাক্তারবাবুর বদলি আটকাতে গ্রামের শয়ে শয়ে মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছেসবাই হাসপাতাল ঘিরে রেখেছেমামাবাবুও সেখানে গিয়েছেতাদের দাবী, জেলা স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে এসে ডাক্তারবাবুর বদলির অর্ডার বাতিল ঘোষণা করতে হবে। 
হাসপাতালে প্রায় বন্দীর অবস্থা রোগী, ডাক্তার, নার্স, কম্পাউন্ডারসকলের
দুপুরের পর জেলা স্বাস্থ্য অধিকর্তা এলেনগ্রামবাসীর সামনেই ডাক্তারবাবুকে প্রশ্ন করলেন, ‘ ডাক্তার সাহা, আপনার কাছে কোন ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে কী ? কবে এসেছে ?’
অধিকর্তার প্রশ্ন শুনেও ডাক্তার সাহা  চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেনতাঁর মুখে একটি কথাও নেইঅধিকর্তা বিরক্তি প্রকাশ করে, আবার প্রশ্ন করলেন,’আপনার কাছে কোন
ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে কী ? না হলে, এঁরা কেন এখানে মিছিমিছি এতো ঝামেলা করছেনআপনি কেন চুপ করে রয়েছেন ডাক্তার সাহা, উত্তর দিন ?’
ডাক্তার সাহা  তবুও একটি কথা মুখ থেকে বের করলেন নাশুধু সলজ্জ চোখে একবার হাসপাতালের কম্পাউন্ডার মুকুন্দবাবুর চোখে তাকালেনমুকুন্দবাবু সঙ্গে সঙ্গে কাঁচুমাচু হয়ে, অধিকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন,
নমস্কার স‍্যারস‍্যার, ট্রান্সফার অর্ডার ওঁনার আসেনি, এসেছে আমার।‘
অধিকর্তা মনে মনে রাগ পুষছিলেন মুকুন্দবাবুর কথা শুনে তাঁর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। ধমকের স্বরে বললেন, আপনি কী এই হাসপাতালের ডাক্তার ? তাহলে, এঁরা সবাই কেন ডাক্তারবাবুর ট্রান্সফার আটকাতে হাসপাতাল ঘেরাও করে রেখেছেন ? এসব কী ছেলেখেলা ? আমার সময়ের দাম কত তা আপনি জানেন ? আপনাকে আমি শুধু ট্রান্সফার নয়, এরপর পানিস্মেন্ট ট্রান্সফারের অর্ডার করছি, দাঁড়ান।‘
সাহেব রাগে কাঁপছেনমুকুন্দবাবু মাথাটি নীচু করে গোবেচারার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেনডাক্তার সাহা  কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তাঁর সাহেবকে কিন্তু  তাঁকে থামিয়ে দিয়ে, গ্রামের প্রবীণ মাষ্টারমশাই  অমূল‍্যবাবু বলতে লাগলেন
স‍্যার, আপনি অযথা মুকুন্দবাবুর উপর রাগ উগড়ে দিচ্ছেনএতে ওঁনার কোন দোষ নেইএই গ্রামের সবাই মুকুন্দবাবুকেই হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বলে জানেন, মানেনকারণ, গ্রামবাসীরা বিপদেআপদে, রাতবিরেতে  ওঁনাকেই কাছে পানউনিই আমাদের কাছে ডাক্তারবাবুতাই ওঁনার ট্রান্সফার অর্ডার বাতিলের দাবিতেই সবাই এখানে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেনএতে মুকুন্দবাবুর কোন দোষ নেইআপনি অযথা ওঁনাকে তিরস্কার করছেননা না স‍্যার, এটা আমাদের কাছে অপমানজনক।‘
কথাগুলো শুনে, সাহেব থমকে গেলেনকিছুক্ষণ চুপ করে রইলেনএরপর ভুরু কুঁচকে একবার ডাক্তার সাহার  মুখে তাকালেনপরক্ষণেই দ্রুত গতিতে কম্পাউন্ডার মুকুন্দবাবুর কাছে এগিয়ে গেলেনতাঁর সঙ্গে হ‍্যান্ডসেক করে, হাসতে হাসতে বললেন,
আপনার মতো মানুষ যদি আমরা প্রতিটি হাসপাতালে অন্তত একজন করে পাঠাতে পারতাম, তবে ডাক্তারবাবুদের ঝামেলা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব হোতো। 
আপনার জন্য আমার গর্ব বোধ হচ্ছেসত্যিই, আমি খুব আনন্দিতপ্লিজ, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।‘
বাবার  গল্প বলা শেষ হয়েছেসে কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ছেলের মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইছেকিন্তু সুশান্ত কিছুই বলছে নাঅগত্যা বাবা তাকে প্রশ্ন করল, ’ গল্প শুনে, তুমি কিছু বুঝলে বুবু ?’                                                                      
সুশান্ত তবুও চুপ করে রয়েছে দেখে, বাবা আবার বলতে লাগল। ‘ওই গ্রামে প্রতি বছর মেজুন থেকে অক্টোবরনভেম্বর পর্যন্ত কলেরা রোগ জাঁকিয়ে বসতঘরে ঘরে একাধিক রুগীহাসপাতালে জায়গা কতটুকুডাক্তারবাবু ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরুতেন না পারলে, ছুটি নিয়ে বাইরে চলে যেতেনওই মুকুন্দবাবু দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে, গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের চিকিৎসা করতেনকারও কাছে কখনো  টাকাপয়সাও চাইতেন নাওঁনার হাতে কোনও রুগী যে মারা যায়নি, এমনও নয়কিন্তু গ্রামের একজন মানুষও কোনদিন তাঁর দোষ দেখেনিসবাই তাঁকে শুধু ডাক্তারবাবু নয়, দেবতার চোখে দেখতএখন তোমাদের মধ্যে ডাক্তারবাবু তো অনেক, সেই মুকুন্দবাবুর মতো একজনও মানুষ,দেবতা কোথায় বুবু ?’
বুবু  এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, অত্যন্ত নমনীয় স্বরে বলতে লাগল,
বাবা, তুমি ঠিক বলেছআমরা একশ্রেণির শিক্ষিত সমাজঅহংবশতঃ নিজেদের ডক্টর ভাবতেই বেশি পছন্দ করিএকজন মানুষ হিসেবে নিজেকে  ভাবতে ভুলে যাচ্ছিসাধারণ মানুষের জন্য ডাক্তারবাবু হতে ভুলে যাচ্ছি, যেটা এইমুহূর্তে খুব প্রয়োজনবাপি, আমি মিটিংয়ে পজিটিভ ভূমিকা নেবোআর ফিরে এসে, রাতে বন্ধুদের তোমার গল্পটি অবশ্যই শোনাবোসত্যি বাবা,একজন  প্রকৃত মানুষই পারে সমাজের  সামনে আয়নাটা তুলে ধরতেবাবা,আমি তোমার জন্য সত্যিই গর্বিত।‘
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।