গল্পগাছা দিলীপ কুমার মিস্ত্রী

পতাকার মহিমা

 

 

অবশেষে পতাকা চোর ধরা পড়েছে।গণধোলাইয়ে তার অবস্থা এখন সংকটজনক।পুলিশ এসে হাজির নাহলে তো সে পথেই মারা পড়ত ।জেলা হাসপাতালে এখন সে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছে।এখনও পর্যন্ত তার নিজের কোনো আত্মীয়-পরিজন হাসপাতালে এসে উপস্থিত হতে পারেনি।আসলে, তার সঠিক পরিচয় এখনও পর্যন্ত কেউ জানতেই পারেনি।
পতাকা চুরি নিয়ে শিমুলপুরে উত্তেজনার পারদ চড়ছে তা বছর দুই গড়াতে চলল।আজ এ’দল তো কাল ও’দল।পরশু আবার আরেক দলের।সব দলের পতাকাই চুরি হয়ে যাচ্ছে লাগাবার কয়েকদিনের মধ্যে।আর তানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এ-ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েই চলেছে।হচ্ছে সভা,পাল্টা সভাও।বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে পুলিশ-প্রশাসন।সবদল গাল পাড়ছে তাদের ব‍্যর্থতার দিকে আঙুল তুলে।বলতে গেলে, একই ঘরের লোক শাসকদল ও ছেড়ে কথা কইছে না।
আবার চোর যখন ধরা পড়েছে, তখনও পুলিশের গাল খাওয়া বাদ যাচ্ছে না।এখন সমস্যা, গণপ্রহারে মৃতপ্রায় ব‍্যক্তির এই অবস্থা করার জন্য দায় কাদের।একদল বলছে, এমন কাজ ওদের।অপর দল বলছে, এসব রক্ত নিয়ে খেলার রাজনীতি আমাদের দলের নীতি-আদর্শে নেই।আরেক দিকে দাঁড়িয়ে, একদল গলা চড়িয়েছে অন‍্য সবদলের বিরুদ্ধে গাল পাড়ছে।তাদের পরিষ্কার কথা, গোটা ঘটনার জন্য ওদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই একশো ভাগ দায়ী।একটু দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে ছোটখাটো এক-দুটিদল।শাসক দল বাদে সব দল মিটিং-মিছিল করে বলছে,  সিবিআই তদন্ত হোক।আর শাসক দলের স্পষ্ট কথা, এই কাজে সিআইডিই যথেষ্ট।সিবিআই তো সারাদেশে শতকরা কুড়িটি মামলার নিষ্পত্তিও করতে পারছে না।ওদের হাতে তদন্তের ভার তুলে দেওয়া মানেই তো আপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা বা পরোক্ষ ভাবে তাদের সমর্থন করা।
রাজনৈতিক দলের পতাকা হঠাৎ হঠাৎ গায়েব হওয়া নিয়ে , সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকেও ঘোষণা করা হয়েছিল, পতাকা চোরের সন্ধান দিতে পারলে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে।যুবকের দল তাই জোরদার চেষ্টাও করে যাচ্ছিল কিছুদিন যাবৎ।
কিন্তু শেষমেশ চোর পাকড়াও হল একটি শিশুর বুদ্ধিতে।বছর আটেকের মেয়েটি ভোরে প্রাতঃক্রিয়া সারতে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিল।হঠাৎ তার চোখে পড়ল, একটি অপরিচিত লোক পতাকা খুলে ব‍্যাগে ঢুকিয়ে রাখছে।মেয়েটি চিৎকার করে পাড়ার লোকজনকে জড়ো করল।তারা এসে পতাকাচোরকে পাকড়াও করে প্রচণ্ড মারধোর করল।সঙ্গেসঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেপড়ায়, চোর বেচারির প্রাণটা পথেই শেষ হলনা; এইযা।
গতকাল পুলিশের চরম হিমশিম অবস্থা গিয়েছে হাসপাতাল চত্বরসামলাতে।সেখানে হাজার হাজার মানুষ হাজির হয়েছিল।সঙ্গে ছিল তাদের নিজনিজ দলের পতাকা এবং নেতানেত্রীরা।সবাই এসেছিল মৃত‍্যুপথযাত্রী ব‍্যক্তি ও তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানাতে।সকলের হাতে ছিল ফুলের তোড়া, মালা ইত্যাদি।কিন্তু পুলিশ কাউকে ভেতরে যেতে দেয়নি।তাই সবাই তাদের যত রাগ হাসপাতালের সামনে খোলা চত্বরে দাঁড়িয়েই উগরে দিয়েছিল।পুলিশের বাপ-ঠাকুর্দার পিন্ডি চটকাতেও কেউ ছাড়েনি।
আজ চোরটি মারা গিয়েছে এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয়ে গেল অন্য আরেক রাজনীতি।যাকে বলে, মরা মানুষ নিয়ে রাজনীতি।সবদল দাবী করতে লাগল, মৃতব্যক্তি তাদের দলের সমর্থক।তাকে তাদের হাতেই তুলে দিতে হবে।কিন্তুপুলিশ-প্রশাসনের সিদ্ধান্ত, পোস্টমর্টেম করার পর মৃতদেহ তার পরিবারের হাতেই তুলে দেওয়া হবে।একান্তই যদি তার পরিবারের খোঁজ না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে প্রশাসন নিজ দায়িত্বে মৃতের সৎকার করবে।মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা কিছুতেই বরদাস্ত করা হবে না।
এদিকে পোস্টমর্টেমের কাজ শেষ।কিন্তু মৃতদেহ নেবার জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ এগিয়ে এল না।টানা এক সপ্তাহ মৃতদেহ হাসপাতালের মর্গেই পড়ে রইল।অবশেষে প্রশাসনের উদ‍্যোগে মৃতদেহ সৎকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।বিতর্ক এড়াতে বিষয়টি সমস্ত রাজনৈতিক দলকে জানিয়েও দেওয়া হল সেকথা।তাদের এমনও জানানো হল, ইচ্ছে করলে তারা সৎকারের সময় সেখানে উপস্থিত থাকতেও পারবে।প্রশাসনও তেমনটি চায়।
পরদিন সকল সাড়ে-আটটা।চৈত্রের প্রখর রোদ অসহ্য ঠেকছে।কিন্তু এরমধ্যেও সবদলের নেতা-কর্মীরা হাসপাতাল চত্বরে হাজির হয়েছে।মৃতদেহ মর্গ থেকে বের করে একটি ম‍্যাটাডোর ভ‍্যানে তোলা হয়েছে।ম‍্যাটাডোর ভ‍্যানের আগে-পিছে একাধিক পুলিশের সাজোয়া গাড়ি।অফিসারের নির্দেশ পেয়ে গাড়িগুলো সবে চলতে শুরু করেছে।তারই পিছনে গাড়ি, বাইক, স্কুটি,পায়ে হেঁটে একাধিক দলের মিছিল।মিছিলে নানারঙের পতাকা হাওয়ায় পত্পত্ করে উড়ছে।সে এক নয়নাভিরাম সম্প্রীতির দৃশ্য।এমন দৃশ্য স্হানীয় জনসাধারণ এর আগে কখনও দেখেনি।মিছিল এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে।
মিছিল হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দশপা’ও এগোতে পারেনি, হঠাৎ পুলিশের সোর্স এসে খবর দিল-মৃতব্যক্তির পরিবারের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।এখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের ভিতরে একটি ছোট্ট গ্রামে তার পরিবার থাকে।তবে পরিবারের লোকজন এখানে আসতে রাজী হয়নি।আসলে, তারা কথাটা বিশ্বাসই করতে পারছে না।অগত্যা সমবেত ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, মৃতদেহ নিয়ে মিছিল ঐগ্রামে, পরিবারের কাছে পৌঁছবে।এবার মিছিল চলল সেদিকে।
ঠিক ভরাদুপুর।মিছিল এসে পৌঁছলো জঙ্গলের মাঝখানে ছোট্টগাঁ আরাঝিটকায়।হাতে-গোনা গোটা কয়েক ঘর।এগুলোকে ঘর বলাও ঠিক নয়।ঝিটেবেড়ার দেয়াল, উপরেবনেরজংলি-ডালপালার ছাউনি।ঘনবর্ষায় ভিতরে ঢুকে থাকলেও মাথাটুকু একেবারে ভিজবেনা, তেমন হতেই পারে না।এককথায়,খুব গরীবমানুষ এরা।গরীবী কাকে বলে এখানে এসে না পৌঁছোলে, প্রশাসনের কর্তা এবং রাজনৈতিক দলের লোকজন,নেতানেত্রীরা তা কোনদিনই অনুভব করতে পারত না।
মৃতের পরিবারকে একঝলক দেখে, সবাই তো স্তম্ভিত হয়ে গেল।এ কী দেখছে তারা।মহুয়া গাছের নিচে যে দুটি ছেলেমেয়ে খেলা করছে, তাদের বয়স আনুমানিক পাঁচ এবং দশ হবে বোধহয়।মেয়েটি বড়ো।তার গায়ের জামাটি তৈরি নানারংয়ের পতাকা দিয়ে।ছেলেটার জামাও ঠিক তাই।সবাই আরও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে মৃতের স্ত্রীকে।দেখছে, সে শিমুল গাছের নিচে বসে একটা মাটির হাঁড়িতে কাঠ জ্বালিয়ে কী সব শেদ্ধ করছে।তার শরীরে কোনো অন্তর্বাস নেই।লজ্জা ঢাকতে সে যেটি কাপড় হিসেবে ব‍্যবহার করেছে সেটিও নানারঙের পতাকা জোড়া লাগিয়ে নিজের হাতে গড়া।সবাইকে সবচেয়ে অবাক করেছে যে ছবিটি,সেটি হল একজন বিধবা প্রৌঢ়ার।জানা গেল,সে মৃত ব‍্যক্তির মা।তার শরীরেও পোশাক বলতে ঐ নানারঙের পতাকা জোড়া লাগিয়ে তৈরি একটা রঙিন থানের মতো।পিছিয়ে পড়া একটি গ্রামের একজন বিধবাকে এমনসাজে,এমন রঙিন পোশাকে দেখা;  হাজির হওয়া মানুষের দল জীবনে এই প্রথমবার দেখল।সবার মন তাই এখন ভীষণ ভারাক্রান্ত।
অনেকটা সময় কেটে গেছে।এবার ফেরার পালা।পুলিশ অফিসার ফেরার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের অনুরোধ করল।তারা রাজী হয়েও একত্রিত ভাবে অফিসারের কাছে একটি পাল্টা অনুরোধ জানাল।বলল,“মৃতদেহটিকে একটিবার অন্তত নিচে নামানো হোক।পুলিশ অফিসার নিরুপায় হয়ে মৃতদেহ উঠোনের মাঝে নামাবার ব‍্যবস্থা করল।এরপরই ঘটল এক অবাক কান্ড।পুলিশ অফিসারের দু’চোখে যেন রাতের স্বপ্ন নেমে এসেছে।সে দেখছে, মৃতদেহের শরীরের উপর এক-এককরে এসে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা তাদের দলীয় পতাকা, ফুল, মালা রেখে প্রনাম জানাচ্ছে।কেউকেউ দু’দন্ড দাঁড়িয়ে, চোখের জলও ফেলছে।একাজে কেউ,কোনও দল পিছিয়ে নেই।মৃতদেহের বুকের উপর স্তুপাকৃত নানারঙের পতাকাগুলো একসঙ্গে মিলেমিশে এই মুহূর্তে যেন একটা দেশের ছবি হয়ে উঠেছে।ভালো করে দেখলে, সত্যিই তাই মনে হচ্ছে।পুলিশ অফিসারের চোখে তো তেমনি লাগছে।
এরপর, মৃতদেহ আবার গাড়িতে ওঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।কিন্তু এবার পুলিশ অফিসার নিজেই তার সহকর্মীদের সেই কাজে বাধা দিল।সে সহকর্মীদের আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল, ”প্লিজ,আপনারা সবাই একটিবার মৃতদেহের পিছনে গিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে,অ্যাটেনশান অবস্থায় দাঁড়ান।জাস্ট ওয়ানমিনিট।বডি গাড়িতে তোলার আগে আমি একটিবার দেশের এই বিরলতম ছবিটাকে নূন্যতম শ্রদ্ধা জানাতে চাই।চাকুরি জীবনে এমন সুযোগ আমার কাছে আর আসবে না।সামনেই রিটার্মেন্ট।আপনারা সবাই আমার জন্য একটু কষ্ট করুন,প্লিজ !”
পুলিশ-প্রশাসনের লোকজন এবং অন‍্যান‍্য সবাই এই মুহূর্তে মৃতদেহকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।পুলিশ অফিসার হঠাৎ তার মাথা থেকে টুপিটা খুলে বাঁহাতে রাখল।তারপর, দ্রুত মৃতদেহের সামনে এগিয়ে গিয়ে ডানহাত কপালের কাছে নিয়ে বুটে খটাস শব্দ তুলে একটা স‍্যালুট করল।সবাই অবাক চোখে দেখল, তাদের এতদিনের চেনামানুষটি আজ হঠাৎ কেমন যেন বদলে গিয়েছে।সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছে।সত্যিই, এতদিন তাদের চোখে দেখা সেই গম্ভীর,কঠোর মনোভাবাপন্ন অফিসারটি ও আজ কেমন যেন একজন সহজ সরল,মাটির মানুষ হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের মানুষই বটে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।