• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে পত্রালিকা

স্বাবলম্বী

সাহানা – না মিঠি আমরা কোনভাবেই তোমায় ওই ছেলেটার সাথে বিয়ে দিতে পারবনা।তুমি কি দেখেছ বলতো ওর মধ্যে?
বেকার একটা।
মিঠি – মা প্লিজ। ও বেকার নয়, ও শিল্পী। এটুকু সম্মান দিতে তো পারো বিরাজকে। আর ছেলে ছেলে কি করছো, ওর একটা নাম আছে তো নাকি?
সাহানা – সে সম্মানের দায় তো তুমিই নিয়ে রেখেছো মিঠি। আমাকে শেখাতে এসোনা। বেকার না তো কি? সারাদিন এঁকে আর আঁকা শিখিয়ে বেড়াচ্ছে। কটা টাকা রোজগার করে? আর কটা ছবি বিক্রি হয় ওর বাজারে? শিল্পী শেখাতে এসোনা আমায়।
মিঠি – তুমি কিন্তু এভাবে বলতে পারনা মা। ওটা বাজার না এক্সিবিশন মানে প্রদর্শনী। আর বেকার কিসে? যা আয় করে তাতে ওর আর আমার দিব্যি চলে যাবে।
সাহানা – ওসব ছোটোখাটো আঁকিয়েদের জন্য প্রদর্শনীটা বাজার ছাড়া আবার কি? ওই কয়েকটা এঁকে নিজেকে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি মনে করছে নাকি? আর তুমিও ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে চললে তাকে উৎসাহ দিতে।
আর হ্যাঁ কিছুটা হয়তো ঠিকই বলেছো, ওই কয়েকটা আঁকা বেচার টাকায় ওর হয়তো চলে যাবে, কিন্তু তোমায় নিয়ে কতদিন চালাতে পারবে এটুকুর হিসাব ও কি তোমার জানা নেই? আর বিয়ে করে কি সারাজীবন দুজনই থাকবে, তখন কিভাবে চলবে ভেবেছো কখনো?
আর অতদূর ভাবার কি দরকার বিয়ের পর হাজারটা খরচ যখন আসবে তখন এসব ভালোবাসা জানলা দিয়ে এমনিই হুশ হয়ে যাবে।ওই ছেলেটার তো টাকাপয়সা রংতুলি কিনতেই বেড়িয়ে যাবে।
মিঠি – না মা তুমি ভুল ভাবছো। তুমি ভাবলে কিকরে যে বিয়ের পর ও একাই সংসার চালাবে আর আমার স্যালারি ব্যাংকে জমবে।
আমরা ঠিক করে নিয়েছি মা আমার টাকাতেই সংসার চালাবো, খুব একটা কম তো মাইনে পাইনা, বেশ হেসেখেলে চলে যাবে আমাদের। আর ওর টাকায় ও নিজের স্বপ্নপূরণ করুক। কে বলতে পারে যে ও একদিন অনেক বড় শিল্পী হবেনা।
সাহানা -আমি ঠিক বুঝেছিলাম মিঠি। আসল কথাটা আমি ঠিক আগেই বুঝেছি। আসলে আমিই তো পেটে ধরেছি তোমায়, আর আমি চিনবোনা। বেশ আমার মেয়েটাকে সহজ সরল পেয়ে ভালোই মাথাটা খেয়েছে দেখছি। বিয়ে হতে পারলোনা, আর এখনই সব ঠিক করা হয়ে গেছে কিভাবে তোমার টাকায় মহোৎসব করবে। বাহ মিঠি পড়াশুনো শিখে কি লাভ হল তোমার? ভালোই তো এমন দেশ উদ্ধারের কাজে নেমে পড়।
মিঠি – দেশ উদ্ধার মানে তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো বলতো মা?
সাহানা – আমি জানতাম মিঠি ওই ছেলেটা তোমায় বুঝিয়েছে, তোমার মাইনেটা এবার পুরোটাই ওর পেছনে যাবে, শুধু তাই না সংসার চালাবে তুমি, সব করবে তুমি, আর উনি এঁকে বেড়াবেন।
তোমার একবারও মনে হচ্ছেনা মিঠি, একটা বেকার ছেলেকে তুমি কেন উদ্ধার করতে যাবে? এর থেকে তুমি অনেক ভালো ছেলে পাবে জীবনে।
মিঠি – আচ্ছা মা তোমায় একটা কথা বলি হয়তো খুব খারাপ লাগবে তোমার, কিন্তু না বলে পারছিনা।
তোমার যখন বিয়ে হয়েছিল বাবা তখন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, আর তুমি কয়েকটা মাত্র টিউশন পড়াতে। তোমার মুখেই শুনেছি বাবার টাকায় সংসার চলতো আমাদের, আর শুধু সংসার না আমার পড়াশুনো, আতিথেয়তা, আমাদের শখ আহ্লাদ, ঘুরতে যাওয়া সব বাবা একাই টানতো। আর তোমার টিউশনের টাকা জমিয়ে তুমি শাড়ি কিনতে নতুন নতুন, ছোটোখাটো সাজার জিনিস ও।
আচ্ছা মা কোনোদিন ভেবে দেখেছো বিবাহ শব্দটার মানে হচ্ছে বিশেষ ভাবে বহন, কিন্তু এই শব্দটার কোথাও লেখা আছে কি ছেলেদের একমাত্র দায় মেয়েদের বহন করার? আগেকার সমাজ অন্যরকম ছিল, মেয়েরা বাইরে বেরোতে পারতোনা, আর্থিকভাবে তারা পুরোটাই নির্ভর করে ছিলো বাড়ির কর্তার ওপর। শুধু কর্তা বদলেছে বয়সের সাথে, কখনো বাবা, কখনো স্বামী, কখনো সন্তান। কিন্তু মেয়েদের জায়গা কিন্তু ছিলো সেই এক।
আজ তো অনেক বদলেছে সমাজ, আমাকেই তোমরা শিখিয়েছো নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে আগে, স্বাবলম্বী হতে হবে, তারপর বিয়ে। আর তাইতো করেছি আমি, এখন আমিও একটা হাইস্কুলের টিচার। এখন ছেলেদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে মেয়েরা সবই তো করছে, কোন পেশায় মেয়েরা যায়নি বলতো? মহাকাশে অবদি পাড়ি দিয়েছে এই মেয়েরাই।আর তুমি বলছো সংসারের দায়িত্ব, আমার কাছের মানুষটার দায়িত্ব নিতে পারবোনা আমি?
আচ্ছা মা তুমি বলতো তোমার কোন স্বপ্নপূরণ করেনি বাবা, যখন যা চেয়েছো তাও দিয়েছে, আর না চাইলে তোমার মন বুঝে নিয়ে হাজির করেছে ঠিক। আর বিরাজ ও ঠিক তোমার মতন ভয় পাচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে এই সমাজের কথা ভেবে। আমার কি উচিৎ না এখন ওর হাতটা ধরে ওর স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া। মা, ভালোবাসা থাকলে টাকাপয়সা, বাড়ি গাড়ি সব গৌন হয়ে যায়। যেটা মুখ্য সেটা হচ্ছে দুটো মানুষের ভালো থাকা, ভালোবাসায় থাকা।
এতগুলো কথার পর সাহানা চুপ করেছিলো। সত্যিই তো আজ খুব মনে হচ্ছে তখন যদি শাড়ি, গয়না এসব নিয়ে মিঠির বাবার কাছে বায়না, জেদাজেদি না করে চাকরি করার আবদার করতাম, হয়তো প্রথমে মানতো না, কিন্তু পরে হয়তো ঠিক রাজি হতো।সবাই বলতো ভালো রান্না করতে পারি আমি, কিন্তু কোনোদিন নিদেনপক্ষে রান্নাটা নিয়েও তো কিছু করার কথা ভাবতে পারতাম। তা না ওই নিত্যনতুন হাল ফ্যাশনের শাড়ি আর গয়না আর এসব নিয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম এতগুলো বছর। আর সত্যিইতো এতদিন উনিই আমায় একাই বহন করেছেন। আমিতো চাইলেই ওই টিউশনের কটা টাকা তুলে দিতে পারতাম ওনার হাতে। পারিনি, তখন এমন ভাবে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি যে সংসার চালানোর দায় একমাত্র ছেলেদের নয়, বরং দুজনের।
তারপর একটু চুপ থেকে নিজেই বলেন, এই মিঠি শোন না, একদিন নিয়ে আয় বিরাজকে, রবিবার বিকেলে আসতে বলিস, তোর বাবা ও বাড়িতে থাকবে। আর হ্যাঁ বিরাজকে রবিবার এখানেই খেতে বলিস রাতে। পরে তোর থেকে শুনে নেবো ও কি খেতে ভালোবাসে। এখন একটু মালপোয়া বানাতে খুব ইচ্ছে করছে। একইরকম না, একটু এক্সপেরিমেন্ট করবো আর কি?
আর শোন তুই তো অনেকদিন থেকেই বলছিস, পরে সময় করে বসে আমার রান্নার একটা ইউ টিউব চ্যানেল খুলে দিস তো। আজকে তোর কথাগুলো শুনে এবার স্বাবলম্বী হওয়ার ভূতটা মাথায় চেপেছে। এবার আমিও একটা কিছু করে তোর বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসারের হাল ধরবো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।