• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে শর্মিষ্ঠা সেন

বারীণবাবুর বিপদ

বিপদই বটে!
শেষমেষ দরজাটা খুলতেই পারলেন না বারীণবাবু ৷

নাড়ুদার লোক খাবার টা নিয়ে ফেরত চলে যাবে এবার ৷ সারারাত না খেয়ে থাকবেন নাকি ! কি মুশকিল ! মাথাটা আবার ঘুরে উঠল ৷এজন্যই মনোরমা মদ খাওয়া পছন্দ করত না ৷ ‘কিন্তু আজ তো সবে মাত্র দু পেগ হয়েছিল ! বয়স হচ্ছে , তাইই হয়ত ! ‘ বারীণবাবু ভাবলেন ৷

আসলে সিঁড়ির লাইট টা না জ্বালানোই কাল হল ৷ বেল টা শুনে আনমনে নেমে এসছিলেন অনেকটা, তারপর হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন, খট্ করে শব্দ হয়েছিল একটা ৷ ব্যথা তেমন পাননি, উঠে নামতে গিয়ে আবার কিছু একটায় পা ঠেকে পড়তে যাচ্ছিলেন, সামলে গেলেন রেলিং টা ধরে ৷ মনে মনে মালতি কে গালাগাল করতে করতে নীচে নামলেন যখন ততক্ষণে বেল থেমে গেছে ৷

বিপত্নীক বারীণবাবু দু’বছর হল রিটায়ার করেছেন ৷ সরকারী ব্যাংক এ ক্যাশে বসতেন ৷ ক্যাশের খাঁচাঘরেই দিব্যি কাটিয়ে দিলেন ৷ স্ত্রীর সতের রকমের রোগ ছিল ৷ অবশ্য তাতে কিছু আটকায়নি বরং ডাক্তারের কাগজপত্র জমা দিয়ে বাংলার বাইরে বদলি আটকাতে পেরেছিলেন ৷ চাকরী জীবন শ্যামবাজার -বারাসাত -চাঁদপাড়া- পানাগড় ঘুরে ঘুরেই কেটে গেছে ৷ দেড় বছর শুধু কাটিয়েছিলেন শালবাড়ি, উত্তরবঙ্গে ৷ বিয়ের পরপরই ছিল সেটা৷ বড় সুখে কাটিয়েছিলেন সময়টুকু ৷ তারপর আবার বারাসাত বদলি, হোমটাউন ছিল বলে সেটাও হেসে খেলে গেছে ৷ সেভাবে ভাবতে গেলে চাকরী করা ছাড়া আর কোন দায়িত্ব তাঁকে নিতে হয়নি ৷ পৈতৃক বাড়িটা ছিল , মনোরমার শ্বশুর শাশুড়ির সাথে সদ্ভাবও ছিল ৷ এমন কি ছেলেটাও ফাঁকতালে কখন বড় হয়ে গেল বুঝতে পারেন নি বারীণবাবু ৷  মনোরমা নিপুণভাবে সামলে নিচ্ছিল অসুস্থতা স্বত্ত্বেও ৷ সে ওসব পরোয়াও করত না ,বলত, শরীরকে প্রশ্রয় দিলে মাথায় ওঠে ৷ শরীর বাদে বাকী সবাইকেই সে অগাধ প্রশ্রয় এবং স্বাধীনতা দিয়েছিল ৷ বারীণবাবুর সংসারের প্রতি আপাত উদাসীনতা সে তার মতো করে মেনে নিয়েছিল ৷ বারীণবাবু অফিস আর অফিসের পর পাড়ার ক্লাব এ আড্ডা দিয়েই অবসরের বয়সে পৌছে গেলেন ৷ ততদিনে মা বাবা উভয়েই মায়া কাটিয়ে পরপারে ৷ ছেলেও চাকরীর চেষ্টায় ব্যস্ত ৷ মনোরমার শরীর-মনের জোর যে অনেকদিন আগেই ফুরিয়ে গেছে সেটা বাবা ছেলে কেউই বুঝতে পারেনি ৷ যখন বোঝা গেল তখন আর কিছু করার ছিল না ! মৃত মাছের দৃষ্টি নিয়ে আরো কিছুদিন  সংসারে থেকে মনোরমা চোখ বুজল ! সমস্যা শুরু হল তারপর ৷

তখনও চাকরী বাকী বছর পাঁচেক ৷ মনোরমার অভাবে বারীণবাবু অথৈ জলে পড়লেন ৷ ব্যাংকের বই , এল. আই. সির কাগজ, গ্যাসের বই , ছেলের এডুকেশনাল লোনের কাগজ, ইলেকট্রিক বিলের রসিদ, বাড়ির ট্যাক্সের কাগজ, মাসকাবারি বাজার ফর্দ, দুধের বিল , পেপারের বিল , কেবল টিভির বিল ইত্যাদি আরো পঁচিশগন্ডা ঝামেলার ফাঁদে তাঁকে পড়তে হল ৷ তবে উনি ঠান্ডা মাথার মানুষ , সারাজীবন লোকের টাকা হিসেব করে দিয়েছেন, নিয়েছেন ; এ সমস্যা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠলেন ৷ একসময় তিনি মনোরমার জায়গাটি নিয়ে নিলেন ৷ শুধু এক রবিবার খাসি এনে শুনলেন ছেলে কোনকালেই খাসি খায়না, সে রেড মিট মোটেও পছন্দ করেনা ৷

এরপর আর তেমন কোন ঝামেলা হয়নি ৷ দীর্ঘদিনের কাজের মেয়ে মালতী সময় মতো কাজকর্ম করে দিয়ে যেত ৷ রিটায়ার করে গেলেন , ছেলে প্রকাশও চাকরী পেয়ে গেল ব্যাংক এ , প্রাইভেট ব্যাংক এবং প্রথম পোষ্টিং হল গুড়গাঁও তে ৷

ছেলে চলে যাবার পর বারীণবাবু বাড়ী থেকে রান্নার পাট একরকম তুলেই দিলেন , নিজের ইচ্ছেমত জীবনযাপন করবেন বলে ৷ বাড়ীতে রান্নার ঝামেলা রাখলে সেই তো সকাল সকাল বাজার ! আর একার বাজার হলেও শাক পাতা , কলা মূলো নিতে নিতে ব্যাগ ভরেই যেত , মাসের শেষে ফ্রীজ থেকে পচা সবজি, শক্ত কাঠ হয়ে যাওয়া মাছ, মিষ্টি  ফেলতে হচ্ছিল ; তারপর মাসে মাসে চাল ডাল নুন তেলের চক্বর ! তারচেয়ে এই ভালো ৷ নিজের খুশী মতো ঘুম থেকে ওঠা , মন্থরগতিতে দিন শুরু করা ৷  মর্নিং ওয়াক টোয়াক কোনকালেই করেন না বারীণবাবু , উনি চিরকালের  আয়েশী মানুষ ৷ সকালে মালতী চা জলখাবার করে দিয়ে ঘর ঝাড়পোছ করে যায় ৷  দুবেলা খাবার আসে নাড়ুদার  ‘ঘরোয়া খাবার ‘ থেকে ৷  নাড়ু ওরফে নারাণ দাসের হোম ডেলিভারী আছে ৷ প্রকাশ যাবার সময় নাড়ুর ছেলে মিঠুন কে খুচরো কাজের দায়িত্ব দিয়ে গেছে ৷ ওই , রাত বিরেতে দরকার হলে যাওয়া , অসুখ বিসুখে ডাক্তারের কাছে লাইন দিয়ে নাম লেখানো  ইত্যাদি নানান কাজে ৷ অবশ্য বারীণবাবু  মাপা জীবনযাপন করেন বলে মিঠুনের ডাক তেমন পড়েনা ৷ আজ হয়ত  ডাক পড়বে , খাবার দেওয়ার ছেলেটিকে আবার বলবেন নাকি ভাবলেন বারীণবাবু ৷

আস্তে আস্তে রেলিং ধরে ওপরে উঠলেন তিনি , মাথাটা ভার হয়ে আছে পড়ে গিয়ে ৷ ঘরে এসে চোখটা জ্বালা করে উঠল, আলোটা বেশী নাকি ? অনেকটা জল খেলেন একবারে ৷ এত পিপাসা ছিল ! টেবিলের ওপর বোতল গ্লাস আর বাদামের প্লেট টা পড়ে, ওদিকে না গিয়ে বারীণবাবু শোকেস এর ওপর রাখা মনোরমার ছবির কাছে গেলেন ৷ অনেক বছর পর খুব মায়ায় পড়ে গেলেন , মনোরমার চোখদুটোয় আজ যেন আগের মতো আনন্দ দেখতে পেলেন ৷

পরদিন মালতী কাজে এসে দেখল কোলাপ্সেবল গেট এবং সদর দরজা দুটোই বন্ধ ৷ বাইরে দুধ এবং পেপার পড়ে আছে ৷ মালতী বেল বাজিয়ে , ফোন করে সাড়া না পেয়ে একটু চিন্তিত হল ! বেশ কয়েক বার ফোনে না পেয়ে সে প্রকাশকে জানাল ৷

এরপর পর পর অনেক কিছুই ঘটে গেল ৷ মিঠুন, পাড়া প্রতিবেশী আর পুলিশ যখন দরজা ভেঙে ওপরে উঠল, দেখল , বারীণবাবু মুখ থুবড়ে একদলা হয়ে সিঁড়িতে পড়ে আছেন৷ লুঙ্গি উঠে কোমরের কাছে জড়ো, নাক থেকে অনেকটা রক্ত বেরিয়ে কালো হয়ে আছে , লাল পিঁপড়ে আর বড় বড় মাছি মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে তাদের দখল বুঝে নিতে এসে গেছে !

অবশেষে প্রায় শেষ বেলায় বারীণ বাবু  লাশকাটা ঘরে শুয়ে রইলেন , ছিমছাম একাবোকার সংসার ছেড়ে, ছেলের অপেক্ষায়!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।