• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে সুপর্ণা বোস

দুধ 

রওনা দেবার আগে একবার শাশুড়ির ঘরে ঢুকল মনামী । বাইরে দিনের আলো ফুটে গেলেও বন্ধ ঘরের ভেতর আবছায়া । কিছুটা চোখ সয়ে গেলে দেখল , মশারির ভিতর ঠাকুমার পাশে অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে তিতলি। পেল্লায় খাটের একপাশে অয়েল ক্লথের ওপর তার রঙিন কাঁথার বিছানা । দুপাশে ছোট দুটি পাশ বালিশ । মাথার নিচে একটা । মা ষষ্ঠীর ঘটের ওপর আঁকা মঙ্গল চিহ্নের ভঙ্গীতে শুয়ে রয়েছে সে । হাত দুটি মাথার দুপাশে তোলা । ক্ষুদ্র পা দুটি অল্প ভাঁজ করে দুদিকে ছড়ানো ।একমাথা চুলের ভিতর ছোট্ট মুখটি শালুক ফুলের মতই সুন্দর।
মেয়ের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে মনামী। ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তোলে ছোট্ট মুখখানি । প্রায় সপ্তা খানেক হয়ে গেল মেয়েকে কোলে নেয়নি। ক্ষুধার্ত ঠোঁটে গুঁজে দেয়নি নিজের স্তনবৃন্ত। মনামী দেখল , মেয়ের মাথার কাছে পড়ে রয়েছে অর্ধেক পান করা দুধের বোতল ।
গতকাল রাতে হসপিটালের গাড়ি তাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে যাবার পর নিয়ম মাফিক নিজেকে স্টেরিলাইজড করেছে সে । তবু ছয় মাসের মেয়ের কাছে সাহস করে যেতে পারেনি । তিতলি ঘুমিয়ে পড়ার পর দূর থেকে তাকে দেখেছে আর মাথার মধ্যে কন্টামিনেশন ,কোয়ারেন্টাইন ,ইনকিউবেশন এর মত অজস্র শব্দ ঘুরপাক খেয়েছে ।
সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। স্বামী সৈকত ভরসা জোগাতে চেষ্টা করেছে।
__“এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে । সাসপেকটেডদের তো কোয়ারেনটাইন করা গেছে । নিশ্চই সিচুয়েশন কন্ট্রোলে আসবে।” মনামীকে কাছে টানে সৈকত । স্বামীর বুকের ভেতর ছোট্ট মেয়ের মত মুখ ঘষে সে ।
_“তুমি ভাবতে পারবে না সৈকত পরিস্থিতি কি ভয়ঙ্কর হতে পারে যে কোন সময় । ইতালী আমেরিকার মত দেশ যা পারেনি তা আমরা কি পারব? আমরা কি পারব কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রুখে দিতে । একমাত্র লক ডাউন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই । ” সৈকতের বুকের ভেতর পাখির ছানার মত কেঁপে উঠেছে মনামী । আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরেছে সৈকত_ “ শোনো লক্ষীসোনা, এতোটা টেনশন নিওনা তুমি । তুমি নিজে একজন মেডিকেল পার্সন হয়ে যদি এতোটা ভয় পাও_” চুপ করে যায় সৈকত । আসলে সে নিজেও কম আতঙ্কিত নয় ।
মাঝরাতে ঘুমন্ত তিতলির কান্না শুনে , ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে মনামী। ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে বুকে তুলে নেয় । এই সময়টায় একবার বুকের দুধের নেশা চাপে মেয়ের । স্তনের ভেতর দুধের ভার অনুভব করে মনামী । গতকাল রাতেও পাম্প করে ফেলে দিয়েছে । কষ্ট হয়েছে । হবারই কথা । প্রক্রিয়াটি সহজ নয় । চোখের সামনে ড্রেন দিয়ে বয়ে গেছে দুধ। সারারাত কেঁদেছে শিশুটি।
যে অদৃশ্য শত্রু র সাথে লড়াইয়ের জন্যে রণ নীতি তৈরি করা যায়নি। যার নিষ্ঠুরতায় উজাড় হয়ে গেছে কয়েকটি দেশ । তার প্রবেশের জন্যে কোনো সম্ভাব্য ছিদ্র সে রাখবে না । একজন সরকারী নার্স হিসেবে ফ্রন্ট লাইনে এমারজেন্সী ডিউটি করছে সে ।পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে কতৃপক্ষ হসপিটালেই থাকার ব্যাবস্থা করেছেন। টানা পাঁচ দিন পর গতকাল রাতে বাড়ি এসেছিল । বাড়িতে বৃদ্ধা শাশুড়ি ছ মাসের শিশুকণ্যা । তাদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে নিজেকে আটকে রেখেছে নিজের রুমে । শুধু একটিবার তিতলিকে চোখের দেখা দেখে এবার বেরিয়ে পড়বে কর্তব্যের ডাকে।
বেরোবার আগে মেয়ের মুখটা স্পষ্ট করে দেখার জন্যে আলোটা জ্বালতেই ঘুম ভেঙে গেল সুমতির।
_“বেরোচ্ছ?”
_“হ্যাঁ মা ”
_“কবে তোমাদের ছাড়বে বলো তো?”
_“এখন তো বলতে পারবো না । কমিউনিটি ট্রান্সমিশন আটকে দেওয়া গেলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে । তার জন্যে লক ডাউন টা সিরিয়াসলি মানতে হবে । ”
_“সে কি আর সবাই মানছে? এই তো গত সপ্তায় তুমি ফোন করে বললে কাজের লোককে আসতে মানা করে দিতে । আমি করে দিলাম। দেখি পাশের বাড়িতে দিব্যি কাজে আসছে । বলতে বলল , তারা নাকি বারণ করেনি । ”
_“ আপনি গেটে তালা দিয়ে রাখুন । নিজেও বেরোবেন না আর কারোকে এলাও করবেন না বাড়িতে । ”
_“সে তো বুঝলাম । কিন্তু মেয়ে যে তোমার কেঁদে একসারা হচ্চে । ”
_“ কি করবো বলুন । এ যে বড়ো বিপদের সময় । তিতলিকে সাবধানে রাখবেন ” , বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এল মনামীর।
ঠিক তক্ষুণি বাইরে গাড়ী এসে হর্ণ দিল ।
তিতলির ঘুমন্ত মুখের ছবি চোখের পাতায় এঁকে দ্রুত গিয়ে গাড়িতে বসল সে । গাড়ি এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে ।
এক ঝলক তাজা হাওয়া এসে মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। কত শত পাখির ডাকে ভরে উঠেছে ভোরের আকাশ বাতাস। যেন কোথাও কোনো কলুষতা নেই । মৃত্যু নেই ।চরাচর জুড়ে অপার আনন্দ । মেয়ের ঘুমন্ত মুখটা চোখের পাতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে । স্তনে আবার সেই অদ্ভূত শিরশিরানি । সময়ে অসময়ে ইউনিফর্মের ওপরেও ভিজে ওঠে । নাহ আজকাল আর অপ্রস্তুত বোধ করে না সে । এই স্টেইন তার মাতৃত্বের স্বাক্ষর ।সমাজের প্রতি তার ত্যাগের স্বাক্ষর ।
শিশুকে প্রথম স্তন্যপান করানোর অনুভূতি প্রায় প্রতিটি মায়ের কাছেই স্মরণীয় । শিশুর জন্মের পর মায়ের প্রথম দুধ তার ইমিউনিটি স্ট্রং করে । মায়ের সাথে শিশুর স্কিন কন্ট্যাক্ট তার ইমোশনাল কোসেন্ট বৃদ্ধি করে ।
প্রথম প্রথম মনামী বিশ্বাসই করতে পারত না যে , কেবলমাত্র বৃন্তে ঠোঁট রেখে শিশুটি সত্যিই পুষ্ট হচ্ছে! সে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ত , ভাবত , তিতলি যথেষ্ট আহার পাচ্ছে তো? অস্থির লাগত । যদিও এবিষয়ে সে অজ্ঞ নয় । জীববিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে সমস্তই তার জানা । তবু মেয়েরা যখন সদ্য মা হয় তখন তার শরীর এবং মনে জেগে ওঠে অপরূপ মাতৃত্ব । সন্তানের জন্যে এক মধুর উদ্বেগ।
গাড়ি এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে আর মনামীর ভাবনাগুলো আবর্তিত হচ্ছে তার সন্তানকে ঘিরে । “ ভাগ্যিস পাঁচ মাসে অন্নপ্রাসন টা করিয়ে ছিল । তাই দুপুরে সমস্ত সব্জি দিয়ে মেখে একটু ভাত খাওয়ানো যাচ্ছে । যদিও দু তিন চামচের বেশি খায় না । তারপর একটু বেলা বাড়লে মুসুম্বীর রস । সেও সবসময় মনের মত পাওয়া যায় না ।মুসুম্বী ঠিকমত ধোয়া হচ্ছে ত? জুসারটা ঠিক মত ক্লিন করা হচ্ছে?” নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে মনামী । নিজেই নিজেকে আশ্বস্ত করে । শাশুড়ির ওপর তার ভরসা আছে ।
সকাল হচ্ছে। ক্রমে মায়ের প্রথম দুধের মত হলুদ আলোয় ভরে যাচ্ছে চারপাশটা । জেগে উঠছে জনজীবন। মানুষে মানুষে স্পর্শ বাঁচাতে বাজার বেরিয়ে এসেছে রাস্তায় । অন্ততপক্ষে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখা বাঞ্ছনীয় । এভাবেই জীবাণুর বিস্তার প্রতিহত করা যাবে ।
কিছুটা এগোতেই বাজারের দৃশ্য দেখে শিউরে উঠল মনামী । নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না । প্রশাসনের সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একে অন্যের ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে মানুষ বাজার করছে । রীতিমত ঠেলাঠেলি করে থলে ভরছে । এভাবে চললে যে শেষ রক্ষা হবে না তা ওয়াকিবহাল মাত্রেই জানেন । এরকম সময়ে সচেতন মানুষের সব থেকে বেশি জ্বালা । তারা পরিণতি কল্পনা করতে পারেন এবং মরার আগে সহস্রবার মরেণ । যাদের জ্ঞানগম্যি নেই তারা এই দুঃসময়েও কি অবলীলায় নর্ম্যাল লাইফ লীড করে চলেছে । দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মনামীর ।
রাস্তার পাশের মিষ্টির দোকানগুলো একে একে খুলতে শুরু করেছে । গ্যালন গ্যালন দুধ নাকি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল । সেজন্যেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত । তবে এখনো খুব বেশী পরিমানে মিষ্টি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না কারিগরের অভাবে । গাড়ি চলাচল বন্ধ । মহাপ্রভূ মিষ্টান্ন ভান্ডারের কাচের সোকেসের ভেতর অল্প সংখ্যক সন্দেশ জাতীয় মিষ্টি চোখে পড়ল । সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল মনামী। মেয়ের ঘুমন্ত মুখটা চোখের সামনে জেগে উঠলে চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এল তার। কি জানি আবার কবে সে ফিরতে পারবে মেয়ের কাছে । ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।