আজ অনেকদিন বাদে খেয়া তার সেই ছোট্ট কাঠের বাক্সটা নিয়ে বসে। গতকাল অফিসে ছিল তার শেষ কর্মদিবস। আজ থেকে তার অখন্ড অবসর। দুপুরবেলা একলা ঘরে আজ সে। কি করবে ভেবে পাচ্ছিলনা। এতোগুলো বছরে ছুটির দিন ছাড়া একলা ঘরে কোন দুপুর কাটায়নি সে।
অর্কর সাথে প্রথম যখন এই মহানগরে আসে তখন ছুটির দিনের দুপুরগুলো ছিল অর্কের। সে অস্থির হয়ে থাকতো কখন খেয়া তার কাছে আসবে। অর্কের সেই উদ্দাম ভালোবাসার খামখেয়ালীতে কখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসতো টেরই পেতোনা। তারপর একে একে পুর্নি আর অর্না এলো। অতিথি অভ্যাগতরা আসতো। তাই পরের ছুটির দিনগুলো হয়ে উঠেছিল আরো ব্যস্ততায় ভরা।
পুর্নি আর অর্নাকে নিয়ে সময়ের সাথে কিছুতেই দৌড়ে পারতোনা। সেই পুর্নি অর্না এখন তাদের নিজেদের সংসার সামলাচ্ছে। আর অর্ক ! বছর পাঁচেক আগে তাকে একলা ফেলে চলে গেছে না ফেরার দেশে। হয়তো কিছুটা অভিমান নিয়েই চলে গেছে অর্ক। কয়েক বছর ধরে অর্কের সাথে খেয়ার সম্পর্কটা হয়ে উঠেছিল একেবারেই পোষাকী। এক ছাদের তলায় থাকতে হয় তাই থাকা। রাতের বেলা একটা ঘরে থাকতে হয় তাই ঘরে ফেরা।
আজ সত্যিই সে একেবারে একলা। এরকম একটা একলা দুপুরের আকাঙ্ক্ষা করেছে খেয়া অনেকবার। কিন্তু পায়নি। এখন নির্জনতায় তার কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কাছেই ফিরে আসছে। এটা ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে মনের কোনে ভেসে ওঠে তার সেই ছোট্ট কাঠের বাক্সটার ছবি। যে বাক্সটার কথা অর্ককে কখনো বলা হয়নি। অর্কের চোখ এড়িয়ে বাক্সটা এতোকাল সে যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছে। আচ্ছা এতে কি তার অপরাধ হয়েছে ?
আজ এই একলা ঘরে এতোকাল পরে সেই কাঠের বাক্সটা নিয়ে বসলো খেয়া।সেটার ডালা খুললো। একেএকে তুলতে লাগলো বাক্সের বুকের মাঝে আগলে রাখা জিনিষগুলো। যেগুলোর হদিস কেউ জানেনা। কি আছে এই বাক্সে?
সেই কিশোরীবেলায় যেমন করে কোঁচড় ভরে যে শিউলি,বকুল ফুল কুঁড়িয়ে এনে মালা গাঁথতো ঘরের দাওয়ায় বসে,সে রকম করেই বাক্স থেকে একটা একটা জিনিষ তুলে মালার মতো করে গাঁথছিল খেয়া।চোখের সামনে বায়োস্কোপের দৃশ্যের মতো মালাটা লম্বা হচ্ছিল।
কোথাও লুকানো আছে সেই ইচ্ছেটা যেটা সে করেছিল মাধ্যমিকের আগে। লেখাপড়া শিখে মস্তবড় ডাক্তার হবে। গ্রামের মানুষের সেবা করবে।আবার হাতে উঠে এলো উচ্চমাধ্যমিকের পর আশাহত মনে যখন গ্রাজুয়েশনের জন্য কলেজে ভর্তি হল।বি এ এমএ পাশ করে স্কুল কলেজে পড়াবে সে। তার মাঝেই উঠে এলো ভালোবাসার সেই মানুষটা,যাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে বলে ভেবেছিল।
কয়েকটা হলুদ খাম,নীলখাম। কিছু শুকনো গোলাপের পাঁপড়ি আর শুকনো বকুলফুল।একটা কলম।কয়েকগাঁছি রেশমি চুড়ি। সবশেষে নীচে একখানা সাদাকালো ছবি ।যা এখন আর ছবি নেই,ঝাপসা খানিকটা জলছাপের মতো।
কয়েক ঘন্টার নোটিশে যখন অর্কের সাথে তার বিয়ে হয়ে যায় খেয়া তখন সবে উচ্চমাধ্যমিকের পরে কলেজে যাওয়া শুরু করেছে। মেঘের কথা কাউকে বলতে পারেনি ।এমনকি মেঘকে জানাতেও পারেনি কিছু। কারন মেঘ তখন ওর অসুস্থ মাকে নিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। অনেক ভাইবোনের সংসারে নিত্য অভাব অনটনের মাঝে সবার বড়মেয়ে খেয়ার জন্য অযাচিত ভাবেই অর্কের মতো সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলে পেয়ে বাবা এককথায় রাজী হয়ে যায়। খেয়ার মতামত নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায়না। তাই বিয়েটা তার হয়েই যায়।
চল্লিশ বছর আগে এমনটাই কি স্বাভাবিক ছিলনা? একাএকা হেসে ওঠে খেয়া। আজকের দিনে হলে কি এমনটা ঘটতো ? মুঠোফোনের বদৌলতে আর যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নয়নের ছোঁয়ায় হয়তো সবকিছু অন্যরকম হতে পারতো।
অর্ক মানুষটার সাথে থাকতে তার খারাপ লাগেনি। বরঞ্চ মনে হয় সে ভালই ছিল অনেকগুলো বছর। আজ এই বাক্সটা দেখে মনে হচ্ছে মেঘের সাথেও হয়তো এমনই হতো। মেঘ যে বদলে যেতোনা তারকি কোন নিশ্চয়তা ছিল? নিত্যকার “থোর বড়ি খারা,খারা বড়ি থোর” নিয়মের জীবনে মেঘের মনে কি ঘূনে পোকার বাসা বাঁধতোনা।
পাওয়া না পাওয়ার অন্তরালে টিমটিমে এক আলোকরশ্মি হয়েই নাহয় থাক মেঘের এই স্মৃতিটুকু মেশানো তার অধরা স্বপ্নেরা !