• Uncategorized
  • 0

ছোট গল্পে শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

চোখ

নীল মানে নীলাদ্রির ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই টিভি শেল্ফ এর উপর সযত্নে রাখা জিনিসটা চোখে পড়ে গেল প্রতিবেশী সুজনদার। ‘বাহ্, শো-পিসটাতো দারুণ! ‘
১৭নম্বর বালিগঞ্জ প্লেস। চাকরি সূত্রে এখানে নতুন ফ্ল্যাটখানা কিনেছে নীল। ফার্নিচার, আসবাব, জিনিসপত্রের মধ্যে পুরনো গন্ধ যতটা কম ঠিক ততোটাই ছড়িয়ে নতুনের গন্ধ। শৌখিন স্বভাবের, পেশায় আই টি ইঞ্জিনিয়ার নীল নিজের মনপসন্দ করে সাজিয়ে তুলেছে ফ্ল্যাটটাকে। অবশ্যি এর সঙ্গে স্ত্রী প্রমিতার নিজস্ব পছন্দও অনেকাংশে জড়িয়ে রয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে নতুন নতুন জিনিসের মাঝে পার্টিকুলার ঐ ছোট্ট জিনিসটা ড্রয়িং রুমে ঢুকলে একবার না একবার ঠিক প্রত্যেকের নজরে পড়বেই । সবাইকে সব বৃত্তান্ত বলা যায় না, কিন্তু সুজনদার সঙ্গে এই কদিনে নীলের বেশ অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছে। ভদ্রলোকের কথার উত্তরে নীল হেসে বলল ‘একশো তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। ওটা পুরী থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল…’। শেল্ফ থেকে জিনিসটা তুলে ভদ্রলোককে দেখালো নীল। খুঁটিয়ে দেখছিলেন সুজন দা। ‘রেয়ার অ্যাসেট! জিনিসটা কী?’
‘ এটা দিয়ে মা,ঠাকুমা, জেঠিমারা বাড়িতে চাল মাপতেন। সাদা বাংলায় চাল মাপার খুঁচি। পেতলের গায়ে এই যে দেখছেন খোদাই চিত্রগুলো, এগুলো জগন্নাথ মন্দিরের একএকটি স্ট্রাকচার। মন্দিরের চূড়ার গায়ে যে অপূর্ব শিল্পকর্ম রয়েছে, নিখুঁতভাবে সেগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে… ‘।
‘এগজ্যাক্টলী সো!’
‘এ হলো টুয়েলভথ সেঞ্চুরির নাগর শিল্প রীতি। এই শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্য এটাই, এতে মূলমন্দির অর্থাৎ গর্ভগৃহের চূড়ার ছাদটি সর্পিল ভঙ্গিতে প্যাঁচানো হতো। এখানেও ঠিক তাই…। ‘ ভদ্রলোক এর কৌতুহল আরো বেড়ে যায়-‘পেলেন কোথায় এ জিনিস? ‘
প্রমিতা কফি আর কেক এর প্লেটটা সেন্টার টেবিলে রেখে পাশে এসে দাঁড়ালো। কথাগুলো শুনছিলো। কফিতে চুমুক দিয়ে নীলাদ্রি বললো ‘দাদুর মুখে যতটা শুনেছি সেটাই বলছি। তখন রেলপথ নতুন চালু হয়েছে। তাও সব জায়গায় হয়নি। ঠাকুর্দার এক পিসিমা তিনি ছিলেন পরম ঈশ্বর ভক্ত। শেষ বয়সে ভক্তবৃন্দের দলের সঙ্গে ভুবনেশ্বর থেকে পায়ে হেঁটে পুরীতে গিয়েছিলেন তীর্থ করতে। আর ফেরেননি। সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করে সেখানেই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেন। বাড়ি থেকে লোক গিয়েছিল তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। পিসিমা তার হাতে এই চাল মাপার পাত্রটা তুলে দিয়ে বলেছিলেন “এটা নিয়ে যাও। সংসারের কাজে লাগিও। এ হলো ঈশ্বরের মন্ত্রপূত। একদিন রাধামাধব আমায় স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, জগন্নাথ মন্দিরের পাশে বকুল গাছের নীচে একটা পাত্র পড়ে আছে। ওটা যেন আমি তুলে নিই। চাইলে সেটা আমি আমার পরিবারের জন্য দানও করতে পারি।সংসারে তার অন্নাভাব আসবে না। আমার খোঁজ আর কখনো কোরো না। আমায় রাধামাধব দেখবেন। তাঁর এই দান আমি তুলে দিলাম। তোমাদের কল্যান হোক। ” এর চেয়ে বেশি আর কিছু জানা নেই। জিনিসটার এক্জ্যাক্ট বয়স কিংবা কি করে এটা আমাদের ফ্যামিলিতে এলো তাও জানি না। ঠাকুর্দাও বলতে পারেন নি সেকথা। ঠাকুমা গল্প করতেন মা জেঠিমাদের কাছে “তোমাদের শ্বশুর মশাই খুব কষ্ট করেছেন জীবনে। ধরাবাঁধা আয় বলতে তেমন কিছু ছিল না। মোক্তারি করে যখন যেটুকু রোজগার হতো তা সব সংসারের পেছনেই, তাই দিয়েই সংসার সামলেছেন।মাথার ওপর অতগুলো ছেলেমেয়ে আর তিনি একা মানুষ। কষ্টের মধ্যে ভগবান কিন্তু ঠিক পার করিয়ে দিয়েছেন। এ খুঁচিখানা আমার সংসারের অন্নদাতা। সংসারের কল্যাণ।” আর দাদু বলতেন, ” পিসিমার মতো মানুষের আশীর্বাদ জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে… “।
‘ এ তো একটা বিরাট ইতিহাস… ‘! বললেন সুজনদা।
পাত্রটাকে জায়গা মতো রেখে নীলাদ্রি বললো ‘একটা কথা কি জানেন, এই যে গুণ, মাহাত্ম্য, কল্যাণ, অকল্যাণ, যে মানুষটাকে কোনোদিন চোখে দেখিনি তাকে ঘিরে পারিবারিক নস্টালজিয়া… যুগ যুগান্ত ধরে বয়ে আনা এই বিশ্বাসগুলো.. চাইলে কেউ এগুলো মানতেও পারে নাও মানতে পারে। দিস্ ইজ্ টোটালি আনইম্পর্ট্যান্ট। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট হলো এ জিনিসের অরিজিনাল বয়স এবং এই স্ট্রাকচার… যেটা সত্যি সত্যিই ভ্যালুয়েবল। ইনফ্যাক্ট আমি একটা বড় কিউরিও শপ্ থেকে যাচাই করিয়েও নিয়েছি…’।
সুজনদা কিছুক্ষন আগে চলে গেছেন। টিভি শেল্ফ থেকে শো পিসটা তুলে সেটা আবার যথাস্থানে, মানে কাঁচের শোকেসে সাজিয়ে রাখছিল প্রমিতা। ‘তোমাদের সেদিনের যৌথ পরিবারের চিহ্ন…। ‘ প্রমিতার কথায় ওর মুখের দিকে তাকায় নীল। ‘তা বটে। দীর্ঘদিনের ব্যবহারে পেতলের গায়ে রাস্ট পড়ে একেবারে কালচে হয়ে গিয়েছিল। পালিশ করিয়ে এনেছিলাম সেই কবে! ঠাকুমা তখন মারা গেছেন। দাদু তো তারও কতো আগে…।তারপর থেকে রংটা অ্যাজ ইট ইজ্ রয়ে গেছে…’। চোখের সামনে পুরোনো দিনের একটা ছবি ভেসে উঠলো নীলের। উনুনের গনগন করতে থাকা আঁচ। ঝুলকালি পড়া রান্নাঘরের চারিধার….। রংটা কি সেরকমই বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল…?
মা, ঠাকুমা, জেঠিমাদের লালন পালন করা সাংসারিক প্রপার্টিখানা আজ ১৭নম্বর বালিগঞ্জ প্লেসের দুকামরার ফ্ল্যাটে সদ্য উঠে আসা একটা ছোট্ট পরিবারের নিজস্ব প্রপার্টি….।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।