এই ক্যাংলাসপার্টির মুখেই যে ফ্যান্টামাটুম ভাষার জন্ম হচ্ছে, সে ব্যাপারটা খুব ছোট থেকেই বোঝার শুরু, আর তাই কান সবসময়ই খাড়া থাকত। ভাষাকে জ্যান্ত থাকতে গেলে শব্দসংগ্রহ লোকজীবন থেকেই করতে হয়। শুধু বইয়ের পাতায় চোখ রাখলে একটা ভাষার জীবন্ত রূপটা ধরা যায় না।
সদাব্রত ঘাট ছাড়িয়ে জয়নগর রোড ধরে খানিক এগোলে কীর্তনখোলা শ্মশান, আমার ধারণা ছত্রভোগ যাবার পথে শ্রীচৈতন্য ওখানে খোলা গলায় কীর্তন গেয়েছিলেন, তাই এই নাম! তো সেখানে ডোমের কাজ করত দিলীপ, সে মাঝে মাঝেই বলত ‘পোকার কীট মেরে দেব’। এই পোকার কীট মারা ব্যাপারটা ঠিক কী, এটা কী গুটিপোকা গরমজলে সেদ্ধ করে মেরে রেশম বার করবার মতো কোন প্রক্রিয়া, তা ভালো না বুঝেও এর ধমক চমক টা তো ঠিকই বুঝতে পেরেছি। এটা অনেকটা ‘এক ছোবলেই ছবি’ কিংবা ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানের’ মতো অব্যর্থ।কথায় বলে শব্দ ব্রহ্ম। মোট কথা দিলীপকে সবাই ভয় পেত। সমঝে চলত। ওর নামই হয়ে গিয়েছিল পোকার কীট মারা দিলীপ। এক ছোবলেই ছবি বা মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে- এই সব মিঠুনের (লোকমুখে মিটুন) মারকাটারি ডায়লগ। একটি এম এল এ ফাটাকেষ্ট ছবির , আরেকটি মনে পড়ছে না। এ সব ছবি আমাদের বড়বেলার। ছোটবেলার দেখা সিনেমার সঙ্গে সাহিত্যের এমন একটা নিবিড় যোগ ছিল যে তার সংলাপ বা গানের কথা ছিল অত্যন্ত পরিমার্জিত। আমাদের মুখে মুখে ঘুরত পথে হল দেরির ‘সুচিত্রা-আমি কি আপনার চোখের বালি?
উত্তম-না, বুকের মধ্যে তুষের আগুন’
কিংবা হারানো সুরের ‘কৌতূহল ভালো, কিন্তু তার একটা সীমারেখা থাকা উচিত’
শোনা যায় এক তরুণ চাকুরিপ্রার্থী ইন্টারভিউ দিতে গেছে, সপ্তরথী ঘেরা অভিমন্যুর মতো তার অবস্থা। প্রশ্নবাণে বিধ্বস্ত হয়ে, সে হঠাৎ উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। প্রশ্নকর্তারা হতবাক। তারপর সে উত্তমকুমারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে বলল ‘কৌতূহল ভালো, কিন্তু তার একটা সীমারেখা থাকা উচিত’ এরপর যে তার চাকরি হয়নি বলাই বাহুল্য।
আশি সালে উত্তমকুমার মারা গেলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল- চলচ্চিত্রে ইন্দ্রপতন। কিছু কিছু ব্যাপারে আমি বয়সের তুলনায় প্রাগ্রসর ছিলাম। সেই বয়সেই আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ে ফেলেছি, শরৎচন্দ্র পড়েও তাঁকে নস্যাৎ করতে শিখেছি বাবার প্রভাবে (যদিও এ ব্যাপারে আমার বামফ্রন্টের মতো ঐতিহাসিক ভুল হয়েছিল, স্বীকার করি), প্রচুর প্রচুর রাশিয়ান সাহিত্য পড়ে ফেলেছি, এমনকি দাদার ওপর বাটপাড়ি করে নবোকভের ললিতা, বিশ্বের অন্যতম নিষিদ্ধ উপন্যাস। যে কারণে নিষিদ্ধ, সেই কারণগুলো আমার ওপর কোন প্রভাব ফেলেনি, বরং আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল এর ভাষার অসাধারণ সৌন্দর্য, তখনকার রিলিজ করা কোন সিনেমাই বাদ নেই, সেই আমি বাড়িতে উত্তমকুমারের অকাল প্রয়াণ নিয়ে বড়দের শোকোচ্ছবাস দেখে মনস্থ করলাম একটা কিছু না করলে আমার মান থাকছে না। আমি ক্যালেন্ডারে ২৪ জুলাই তারিখটা লাল পেন্সিল দিয়ে গোল করে দাগ দিয়ে তার পাশে ছোট ছোট করে লিখলাম উতুদা আর নেই! অনুমান করতে পারি, সম্রাট অশোকের শিলালেখসমূহ একইরকম কোন তাড়না থেকে লেখা হয়ে থাকবে!
উত্তম-উত্তর পর্ব বাংলা সিনেমার এক অন্ধকার যুগ। বাঙালি দর্শক সেই যে হল বিমুখ হল, সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে। শংকরলাল ভট্টাচার্য একবার লিখেছিলেন ‘উত্তম নেই, বিনোদনও এখন মধ্যমমানের।‘ এর থেকে সত্যি কথা আর হয় না। উত্তম -পরবর্তী যুগে দুটি বড় হিট ছিল শত্রু ও বেদের মেয়ে জোসনা।যতদিন না ঋতুপর্ণ ১৯ এপ্রিল নিয়ে এলেন, ততদিন ভয়ংকর অবস্থা। এইসময়ের দুটো বাংলা গানের নমুনা পেশ করি-
দ্বিতীয় গানটা একদিন মার সামনে গাইতেই মা গরম চোখে তাকাল। খুশি হবে ভেবেই গাইছিলাম। কেননা জননীর নামটি যে মমতা! তাই অনুপ্রেরণার জন্য আমাকে রাস্তার হোর্ডিং এর নিচে দাঁড়াতে হয়নি কখনো।
জানি না, ভাষার এই অবক্ষয়কে কী বলা হবে? লুম্পেন সংস্কৃতি, না প্রলেতারিয়েতের জাগরণ? তবে ভাষা দিয়ে একটা সমাজকে চেনা যায়, এ তো ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন। আমাদের ফুলদা, রাঙ্গাদা, নদা,কত কী আছে, ইংরেজদের এল্ডার ব্রাদার আর ইয়ংগার ব্রাদার দিয়ে কাজ চালাতে হয়, এর থেকে বোঝা যায়, আমাদের সমাজ অনেক ঘনসন্নিবদ্ধ, এখানে সম্পর্কের মধ্যে উষ্ণতা অনেক বেশি, ওদের মতো আড়ষ্ট নয়। সেইরকমই একটা জ্যান্ত ভাষার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নতুন নতুন শব্দ আর ইডিয়ম গড়ার ক্ষমতা। আর কান পাতলে শোনা যাবে আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষজন, হ্যাভ নটস, আমার ক্যাংলাসপার্টির এই ক্ষমতাটা আশ্চর্য রকম বেশি। তাদের মুখে মুখে ক্লাচ ক্লিপ হয়ে যায় কাঁকড়া, পলিথিন চিকচিকে বা কাঁচকাগজ,রেললাইনের সঙ্গে ফিশপ্লেট আটকানোর পেন্ড্রোল ক্লিপ হয়ে যায় জিলিপি, ফ্যান্টাস্টিক থেকে ফ্যান্টামাটুম, শবের অনুগমনকারী শ্মশানযাত্রী গামুই-র মানে করা হয়, যারা মড়ার সঙ্গে গিয়ে গামলা গামলা লুচি মিস্টি খায়!
এই সব শব্দ অভিধানের পরিভাষার থেকে ঢের বেশি জুতসই এবং কাজের। মনে আছে, আমার এক মামী উস্থি পেরিয়ে এক প্রত্যন্ত গ্রামে বছরের পর বছর একটি স্যাংশন না হওয়া স্কুলে শ্রম দিতে যেতেন। তখনো মিড ডে মিল চালু হয়নি, শুখনো মুখে ইস্কুলে যারা আসত, তাদের অনেককেই পরের বছর আর দেখা যেত না। এদের পাশ করাতে হিমসিম খেতে হত মামীকে। আমি গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি গেলে এদের খাতা দেখার সুযোগ পেতাম আর অনেক জ্ঞান আহরণ করতাম।ইতিহাসের একটি প্রশ্ন ছিল- হজরত মহম্মদ কে ছিলেন? উত্তর পেলাম- হজরত মহম্মদ ছিলেন পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি। ইসলামের এত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আর তো চোখে পড়েনি। বেচারা রুশোর নাম সবাই লিখেছে ঘুসো বা ঢুসো, হয়তো তাঁর বক্তিমের ওজন বোঝানোর জন্যেই। ইংরেজি খাতার নম্বর যোগ করতে গিয়ে খুব মুশকিলে পড়ি। শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ করে তো শূন্যই হয়। ইংরেজিতে কেউ বেশি ঝামেলায় যায় নি। একদম সাদা খাতা দিতে যাদের বিবেকে বেঁধেছে, তারা উত্তরের জায়গায় প্রশ্নটাই সুন্দর করে লিখে দিয়েছে। একজন দেখলাম ট্রান্সলেশন করতে কসুর করেনি। বাবা চা করে আনলেন- এর ইংরেজি করেছে ফাদার ইজ আ সারভেন্ট! সম্ভবত, এই মেয়েটিই পরবর্তী কালের মেগাহিট ছবি ‘বাবা কেন চাকরের’ অনুপ্রেরণা।
সেইসব খাতা দেখে খুবই ঋদ্ধ হতাম বলাই বাহুল্য। সেইসময় একদিন, নদী পেরিয়ে ওপারের কুঁকড়োহাটি থেকে হাজির হলেন নীহারিকা দিদা, দাদুর সেজ ভাইয়ের স্ত্রী। ছোটখাট মানুষটি উত্তেজিত হয়ে তাঁর কোন আত্মীয়ার বাচ্চা হওয়ার বর্নণা দিচ্ছিলেন- ‘অমুকের তো সিরাজ করে বাচ্চা হয়েছে আর বিল্ডিংর পর বিল্ডিং হয়ে যাচ্ছে’! কিংবা কে ভুলতে পারে বাবু-সন্টুর মাকে যিনি টেলিভিশনের আদি যুগে টিভিতে কমারশিয়াল ব্রেক নামে বিজ্ঞাপন বিরতি আসলেই বলতেন, যাই জলটা ভরে আসি, ওই কামারশালের বেগ শুরু হয়ে গেছে!ইনিই টিভিতে বেনসন হেজেস কাপ জয় দেখার পর আমাদের বলেছিলেন টিভির সামনে বোকার মতো না বসে থেকে ,মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতে, কাপ নিয়ে ওরা নাকি নাচতে নাচতে আসছে। খেলাটা, মনে রাখতে হবে, অস্ট্রেলিয়ায় হয়েছিল।
কিংবা অষ্টদি, আমার মায়ের সাহা্য্যকারিণী, একদিন হ্নতদন্ত হয়ে এসে বলল ‘ও দিদি, খবর শুনেছ, মাদার ডেয়ারি নাকি মারা গেছে!’ হ্যাঁ মাদার টেরেসার মৃত্যুর খবর এইভাবেই আমার কাছে পৌঁছেছিল।
১৯৮৪ সাল। ইন্দিরা হত্যার পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের পর কুট্টির এক কার্টুন বেরোল- এ তো ইন্দিরা হাওয়া নয়, ঝড়। সেই ঝড়ে সোমনাথ চ্যাটার্জির মতো হেভিওয়েট প্রার্থী কুপোকাত হলেন নবাগতা মমতা ব্যানার্জির কাছে। সেই নিয়েও একটা কার্টুন আঁকলেন কুট্টি। মমতা একপ্রেস সোমনাথ চ্যাটার্জিকে চাপা দিয়ে বেগে চলে যাচ্ছে। পাশে লেখা নিঃসন্দেহে এটা আত্মহত্যা। এই কথাটির একটা ঐতিহাসিকতা ছিল। সেইসময় সঞ্জীব-তীর্থংকর হত্যা মামলা আলোড়ন ফেলেছিল। সরকার পক্ষের আইনজীবী সোমনাথ চ্যাটার্জি বারবার বলছিলেন ‘এটা খুন নয়, আত্মহত্যা’। এ তো গেল এলিট ক্লাসের ইতিহাস। ক্যাংলাস পার্টিরও নিজস্ব ইতিহাস থাকে। শীতল বৈদ্য, আমাদের দোতলা হবার সময় জোগাড়ের কাজ করেছে, তার অক্ষরপরিচয় আমার হাতে। সে পরে মাছের ব্যবসা করে সম্পন্ন হয়। সে একদিন একটা জাতীয় কংগ্রেসের ইস্তাহার নিয়ে হাজির হল। সে এখন গোটা গোটা বাক্য পড়তে পারে। উত্তেজিতভাবে মমতার ছবি দেখিয়ে বলল ‘দেখো দিদি, কি ফুটফুটে চেহারা, এ হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধীর মেয়ে, জানো তো?’ এরপর তো আমাকে গাইতেই হয়, ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’, অবশ্যই উল্টোদিক থেকে!