জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ৩)

মায়া – মফস্বল ও ক্যাংলাসপার্টিরা 

পর্ব ৩ 

ছি ছি হাসিরানী আনা বেলেঘাটা সরকার

চিন্তাশীল কথাটার মানে ঠিক কী? যে  জগতের ভারি ভারি বিষয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করে? নাকি যে খুব টেনশন করে? যদি দ্বিতীয়টা হ্য় তবে আমার মার মত চিন্তাশীল ব্যক্তি পৃথিবীতে দুটো নেই। তার এই চিন্তাশীলতাকে আমাদের পারিবারিক পরিভাষায় বলা হত হুতাশ। এই হুতাশের ব্যাপ্তি ইনক্রেডিবল। কারো বাড়ি ফিরতে সামান্য দেরি হলেই মা ধরে নিত সে নির্ঘাত খুন হয়েছে, যেকোন উপায়ে খুন নয়, স্ট্যাবড হওয়া। এই স্ট্যাবড শব্দটা মার খুব প্রিয় ছিল। রুদালির মত হুতাশী বলে যদি কোন পেশা থাকত, তবে মহিলার ভবিষ্যৎ ত্রিফলা আলোর মত উজ্জ্বল ছিল।একটু নিজের মতামত জানাবার বয়সে পৌঁছে বাড়ি ফেরার সময় নিয়ে মার সঙ্গে দুরন্ত সব ডিল হত যার অন্তিমে মা খুব নিরীহ গলায় শুধোত ‘বল, ঠিক কটা থেকে আমি চিন্তা করতে শুরু করব?’
যাকগে, সেসব অবশ্য অনেক পরের ইতিহাস।  হচ্ছিল সত্তর সালের কলকাতার কথা। সেসময় ঘরের মানুষের ঘরে ফেরা নিয়ে চিন্তার নির্ভেজাল কারণ ছিল। হয়তো কলকাতা ছাড়ার সেটাই মুখ্য কারণ। বাবার দিক থেকে মনে হয় বিভূতিভূষণের ‘নদীর ধারে বাড়ি’ গল্পটার প্রভাব পড়ে থাকবে। ঘিঞ্জি গলি, বারোয়ারি কলঘর, বাস-ট্রামের আওয়াজ থেকে বাঁচতে শান্তির সবুজ দ্বীপ মফস্বল। বাবা অবশ্য প্রফিডেন্ট ফান্ড বেচে যায়নি, তবে নিউ আলিপুরে অফিসের ফ্ল্যাটের হাতছানি উপেক্ষা করে গেছিল।
কিন্ত সে মফস্বলের মাটি
দেখতে পরিপাটি
পা দিয়েছে যে
টের পেয়েছে সে।
মাটির গুণ বলে কথা। কে না এসেছেন এখানে? বংকিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন ত বটেই, তার কয়েক শতক আগে শ্রীচৈতন্য এই রাস্তা দিয়ে ছত্রভোগ হয়ে পুরী গেছিলেন।  তাই এর আর এক নাম চৈতন্যপথ। এখানে সাধু অনন্তের ভিটেয় তাঁর এক রাত্রিবাস।
‘হেনকালে প্রভু তত্ত্ব কহিতে কহিতে
উত্তরিলা আসি আটিসারা নগরীতে
সেই আটিসারা গ্রামে মহাভাগ্যবান
আদেশ পরম সাধু শ্রী অনন্তরাম’
সেখানে আজ মহাপ্রভুতলা। সেখানে নাকি মহাপ্রভুর খড়ম রাখা আছে। তার পাশে শাঁখারিপাড়া। এক সময় নিশ্চয় এটা শাঁখারি বা শংখকারদের পাড়া ছিল। এখন পাঁচমিশেলি। সেই পাড়ায় এক দত্তদের মিস্টির বিরাট ব্যবসা। তাদেরি বাড়িতে ভাড়া উঠে আসা। ডঃ জগবন্ধু লেন থেকে শাঁখারিপাড়া। এটাও ভাড়া বাড়ি। কিন্ত চরিত্র একদম আলাদা। বাড়িওলা বা অন্য ভাড়াটেদের সঙ্গে থাকা নয়। একানে একটা একতলাবাড়ি সম্পূর্ণ নিজেদের অধিকারে। উঠোনে চারমাসের কন্যাকে তেল মাখিয়ে শীতের রোদ খাওয়ানো যায়। দুপুরে ঘুঘুর উদাস ডাক, রাতে শেয়ালের। আর সারাদিনই গৃহকর্ত্রীর গলায় অবিরাম অবিশ্রান্ত গান। গান, জর্দা পান আর লোক-অন্ত প্রাণ মানুষটি আমার মা। আর গৃহকর্তা চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হলে কি হবে, দুনিয়াদারির হিসেব কিছুই বোঝে না, নইলে কেউ জাজ্বল্যমান কলকাতা ছেড়ে মফস্বলে আসে? কিংবা জামাকাপড়ের আলনা জানলার ধারে রেখে দেয়?
একদিন সকালে উঠে দেখা গেল জানলার শিক বেঁকিয়ে জানলা থেকে বাবার কোট নিয়ে গেছে চোর। বাবার প্রিয় কোট, হয়তো একমাত্র কোট তখন, কারণ এই  আপাত নিউক্লিয়ার পরিবার আসলে ভেসে থাকা হিমবাহের নাকের ডগার মত, জলের গভীরে আছে বৃহত্তর  দশ বারোজনের পরিবার, যা সারাবছর টানতে হয়। ডিসেম্বর মাস। বেলেমাটির মফস্বলে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। আতান্তর বলে আতান্তর! সে চোর নাকি আগেও উদ্যোগ নিয়েছে, টর্চের আলোয় এক রাতে তার মুখও দেখেছে বাবা। পরের রোববারে বাজার ফেরতা হাবুর দোকানে চা খেতে গিয়ে বাবা আবিস্কার করল তার পাশে বসে কাচের গেলাস দু হাতে আঁকড়িয়ে আরাম করে চা খাচ্ছে যে, সে আর কেউ নয়, সেই চোর!
এই হচ্ছে মফস্বলের মাখো মাখো জম্পেশ জীবন। চায়ের দোকানে ছিঁচকে চোরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, সে একগাল হাসলে একচিলতে হাসতেও হয়, শাঁখা পলা পরা যে বউটি ঘর মুছে বাসন মেজে দিয়ে গেল বেলায়, সে-ই রাতে শাসনের খারাপ পাড়ায় লম্ফ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে খদ্দেরের আশায়!
শাঁখারিপাড়ার পেছন দিয়েই শাসনে যাবার রাস্তা। পাশের রাস্তা বিষ্ণুপুরের দিকে চলে গেছে। যেখানে বিখ্যাত বিষ্ণুপুর শ্মশান। তার ঝুরি নামানো বটের ছায়ায় অন্ধকার, ভাঙ্গা ঘাটলা। তার অনেক আগে এ মফস্বলের নিজস্ব শ্মশান কীর্তনখোলা, যার নামের মানে নিজেই তৈরি করে নিয়েছিলাম (ইটিমোলজি আশৈশব আমার আগ্রহের বিষয়)- এখানে শ্রীচৈতন্য খোলা গলায় কীর্তন গেয়েছিলেন। সত্যি মিথ্য জানি না!
শ্মশানের কথা উঠলে সেইসময় বড়রা খুব উদাসীন মুখ করে বলত ‘বড় শান্তির জায়গা’।  আমার দ্রবময়ী টাইপ মা যা শুনে বলতেই পারত ‘আঃ মোল যা! বেটাদের রকম দেখো’ একটু বড় হবার পর মা প্রায় দুপুরে ওই শ্মশান পেরিয়ে আমাকে ট্যাঁকে গুঁজে রিক্সা করে একজায়গায় যেত। রানা বেলিয়াঘাটা বলে একটা গ্রাম। বাসস্টপে নেমেই রানা বেলিয়াঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়।এ গ্রামের একমাত্র পাকা বাড়ি। তারপর পুকুর ঘাট পেরিয়ে কুল, কামরাঙ্গার জঙ্গল পেরিয়ে বাবার থান। এক নিকোনো কুঁড়ে ঘরে বসে আছেন লাল টকটকে বাবা পঞ্চানন। প্রতি বছর প্য়লা মাঘে ঘটা করে পুজো হ্য় তাঁর। তখন আমরা কচিকাঁচারা সামনের উঠোনে হুটোপাটি করে খেলি।আগুন ঘিরে গোল করে বসা কীর্তনের আসর থেকে দু-একটা আখর ছিটকে এসে আমাকে অন্যম্নস্ক করে দেয়। ফট ফট করে কাঠ ফাটে, আগুনের ফুলকি ঝিকমিক করে।
এই ঠাকুর যাদের, তারা একটি সম্পন্ন (তখনো পর্যন্ত) পরামানিক পরিবার। একান্নবর্তী। পরে তারা আলাদা হাঁড়ি হল, পারিবারিক সেলুনটি এতগুলি লোকের গ্রাসাচ্ছাদন করতে পারল মা। দারিদ্র্য এসে কেড়ে নিল লক্ষ্মীশ্রী। এইসময় তারা সপরিবারে এপিঠ-ওপিঠ(!) করে প্রামাণিক থেকে সরকার হয়ে গেল। সেই বাড়ির একটি মেয়ে নাম জিগ্যেস করলে বলত
‘ছি ছি হাসিরানী আনা (রানা) বেলেঘাটা সরকার!’
অনেক পরে জানব পিটি ঊষা র পুরো নাম – পিল্লু ভাল্লি কান্দি থেকে পরম পিলে ঊষা, যার মধ্যে নাকি বাড়ির উঠোনের কাঁঠাল গাছটির কথাও আছে। তার বহু বছর আগে, নিজের নামের সঙ্গে যে আস্ত একটা গ্রাম জুড়ে নেওয়া যায়, তা হাসিরানীই শিখিয়েছিল!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।