জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ২৯)

এলাডিং বেলাডিং সই লো

পর্ব ২৯

এলাডিং বেলাডিং সই লো
কীসের খবর হইলো?
রাজামশাই একটি বালিকা চাইল
কোন বালিকা চাইল?
তৃষ্ণা (নামটা যা ইচ্ছে বসান না, কে বারণ করেছে!) বালিকা চাইল।
শৈশবের সরল আনন্দে খেলার এই ছড়াটাকে আজকাল র তত নিরীহ মনে হয় না। রাজামশাইয়ের জন্যে নিয়মিত বালিকা সরবরাহ দিতে হয় যে রাজ্যে, সে তো এক ভয়ঙ্কর রাজ্য। সেখানে বালিকারা মোটেই নিরাপদ নয়। বড় অদ্ভুত কথা, আমরা বালিকারাই এই খেলা খেলতাম। 
সে এক অলীক সময়। যখন বনে ছিল ফল, গাছে ছিল পাখি আর বাড়ির পাশে ছিল মাঠ। স্কুলগুলোর ছুটি হত এমন সময়ে যে পর্যাপ্ত বিকেল থাকত, আর সেই বিকেলগুলো সদব্যবহার করার মতো যথেষ্ট মাঠ। আমাদের বাড়ির ঠিকানায় যে রাসমাঠ ছিল, তা সত্যি সত্যি এক পেল্লায় মাঠ, বহু যুগ থেকে আজ অব্দি এই মফস্বলের অক্সিজেন উৎস দেবত্র সম্পত্তি হওয়ায় এখনো অব্দি প্রোমটারের লোলুপ দৃষ্টি এড়িয়ে দেশলাই বাক্স বা শপিং মল হওয়া থেকে বেঁচে এসেছে। তবে ভবিষ্যতে কী হবে বলা শক্ত। এ পোড়া দেশে  সবই সম্ভব। স্যাকরাদের সম্পর্কে অপবাদ আছে, তারা মায়ের কানের সোনা পর্যন্ত চুরি করে। পৃথিবী যদি আমাদের মা হয়, তবে তার সঙ্গে আমাদের ব্যবহার স্বর্ণকারের মতোই। ল্যাম্পপোস্ট দেখলে যেমন কুকুরের এক বিশেষ ইচ্ছে জাগে, তেমনই ফাঁকা জমি, পুরনো বাড়ি কিংবা পুকুর বা জলাজমি দেখলেই এই ‘হাত-মাটি’ করা লোকদের বোজানোর ইচ্ছে জাগে। সেই ইচ্ছের মাশুল দিতে গিয়ে পৃথিবীর আজ চোখ বোজার  জোগাড়। সেই রাসমাঠে   রাসঞ্চ, রথ, নহবতখানা, শিবমন্দির ইত্যাদির পরেও অনেক রকম খেলার যথেষ্ট জায়গা ছিল। ক্রিকেট, ফুটবলের মতো যেমন কুলীন খেলা ছিল, তেমনই ছিল কুমীরডাঙ্গা, বউবাসন্তী, লুকোচুরির মতো অকুলীন অনেক খেলা। আরও খেলা ছিল দাড়িয়াবান্ধা , পিট্টু। সেসব অবশ্য আমি কোনদিন চোখে দেখিনি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’ গল্পে আছে গ্রামের বালিকাদের ফুল তোলা খেলার কথা। 
 গুলো খেলতে খেলতে আমরা এই পৃথিবীটাকে আবিস্কার করেছি।এমন এমন জায়গায় লুকোন হত, তার কাছে আমাজন অভিযান তো তুশ্চু। কেউ কেউ লুকোতে গিয়ে ঢুকে পড়ত নিষিদ্ধ জগতে। কোন বাড়ির কাকিমা হয়তো সন্ধেয় গা ধুয়ে শাড়ি বলাচ্ছে, অমল কিশোর লুকোতে গিয়ে দেখে ফেলল সেই দৃশ্য। তার চোখে উন্মোচিত হল নারী শরীরের রহস্য। সে এমন একটা সময় যখন বিনা অনুমতিতে একে অন্যের বাড়ি ঢুকে পড়া যেত। 
যারা একটু ল্যাদখোর, অত ছোটাছুটি করা যাদের পোষাত না, তাদের জন্যে ছিল  কুমীডাঙ্গা। আরও কুঁড়ে যারা, তাদের পক্ষে মানানসই ছিল   রুমালচোর। আর চিরকালের  মারকুটে ডানপিটে এবং প্রকৃত ক্যাংলাসপার্টির জন্যে ছিল খোলামকুচি, মার্বেল, ডাঙ্গুলি বিলেতে জেদি মেয়েদের জন্যে নাকি দারুণ কাজের ছিল ক্রোকে খেলা।  
 উচ্চবিত্তের শিশুর খেলাধুলো থেকে ধুলো কবেই ঝরে গেছে। এখন  লোকে ঘাম ঝরায়  জিমে বা ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে।সৌরভ, শচীন হতে হবে সবাইকেই। বিশুদ্ধ আনন্দ , বন্ধুতা, যৌথ যাপনের  সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই আর খেলা। আলাদা কেরিয়ার হয়ে গেছে।খেলা  সত্যিই ছেলেখেলা নয় আর!
কিছু খেলা এখনো অবশ্য অবিকল এক।তাদের দেখা মেলে  পাড়া, স্কুল বা অফিসের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় । লজেন্স দৌড়, অংক দৌড়, ছুঁচে সুতো পরানো, হাঁড়ি ভাঙ্গা, বস্তা দৌড়, মিউজিকাল চেয়ারএই খেলাগুলোর মধ্যে এখনো যেন গ্রামীণ ভারত উঁকি মারে।
অনেক খেলারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ছড়া।
–সাতটা বাজল এখনো কুমীর এল না, আটটা বাজল এখনো কুমীর এল না, কুমীর জলকে নেমো না, কুমীর ডাঙ্গায় ওঠো না
ফুলবড়িটা ডুবে গেল, সবাই মিলে এক পা তোল,
চুলটানা বিবিয়ানা/ সাহেবমেমের বৈঠকখানা/ আজ বলেছে যেতে/ পানসুপারি খেতে/ পানের ভেতর মউরীবাটা
আর ছিল ইকিড়মিকিড় চাম চিকির/ চামে কাটা মজুমদার / ধেয়ে এল দামোদর, /দামোদরের হাঁড়িকুড়ি/ দুয়ারে বসে চাল কুটি/চাল কুটতে হল বেলা/ ভাত খাবি য় জামাই শালা/ ভাতে পড়ল মাছি/ কোদাল দিয়ে চাঁছি/ কোদাল হল ভোঁতা/ খা শিয়ালের মাথা’
আরও ছিল অব ডব ঘি মৌরী। আর একটা  ‘রস কস শিঙ্গাড়া  বুলবুলি, মস্তক’ জাতীয় কিছু, সেটা আমি কোনদিন ধরতে পারিনি। এখন মনে হয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে   নিচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো যে স্টোন পেপার সিজার খেলাটা খেলে, বুঝি তার আদি জননী।
কন্যা যখন নার্সারি টু তেই স্কুল থেকে শিখে এল করিনা কাপুর / পরে না কাপড়, আমি তো চমৎকৃত। তারপর একটু খোঁজ খবর নিতে সত্যি সত্যি চমৎকার কিছু খেলার ছড়ার সন্ধান পাওয়া গেল। যা আমাদের শৈশবের খেলাগুলোর মতোই তালে তালে বলতে হয়, সাধারণত এর সঙ্গে কোন শারীরিক ক্রিয়া জড়িয়ে থাকে, যেমন গোল করে ঘোরা, ঝপ করে বসে পড়া, আরও এক ধাপ এগিয়ে এর মধ্যে একটা  সদ্য শেখা পাঠ ঝালিয়ে নেওয়ার  ব্যাপার থাকে। কয়েকটা  উদাহরণ দেওয়া যাক।
-লেডি, হান্টার, টাইগার
-ও পিলা,
কাঁচা পিলা
কী কাঁচা?
লেবু কাঁচা
কী লেবু?
পাতিলেবু
কী পাতি?
মোমবাতি
কী মোম?
গরম মোম
কী গরম? 
দুধ গরম
কী দুধ?
খাঁটি দুধ
কী খাঁটি?
আমের আঁটি
কী আম?
লাল আম
কী লাল?
রক্ত লাল
কী রক্ত?
মানুষের রক্ত
কী মানুষ?
বনমানুষ
কী বন?
কচু বন
কী কচু?
মানকচু
কী মান?
বর্তমান
কী বর্ত?
চুপ করতো!’
-This is the game of concentration
No repeat, no hesitation
I go firsrt, I go second
Topic plz flowers name.
সেইসময়ের খেলাধুলোর মজা  ছিল ওই ছড়ায়। অনেকগুলো খেলা ছড়া ছাড়া হতই নাএমনিতে ঘুরতে ঘুরতেও কত ছড়া কাটা হত। ‘একতলা দোতলা তিনতলা/ পুলিশ গেল নিমতলা/ পুলিশের হাতে মোটালাঠি/ ভয় করে না ক্যাংলাসপার্টি/ক্যাংলাস পার্টি বারোটা/ ডিম পেড়েছে তেরোটা/ একটা ডিম নষ্ট/ ক্যাংলাস পার্টির কষ্ট
একলা বাপের একলা মেয়ে 
ভুত আমার পুত
পেত্নি আমার ঝি
রাম লক্ষণ বুকে আছে
 ভটা আমার কী?
ঠিক দুক্কুর বেলা 
ভূতে মারে ঢেলা
 ভূতের নাম রসি
 হাঁটু গেড়ে বসি
 সেই হিসেবে এখনকার খেলাগুলো অনেকটাই তার রূপ রস ছন্দ হারিয়েছে। পুরনো খেলাগুলো খুব গ্রামে বা শহর মফস্বলের দারিদ্র্যসীমার নিচে বাচ্চারা খেলে। আর স্বচ্ছল পরিবারের বাচ্চারা মজেছে নানান বৈদ্যুতিন খেলনায়, যা অনেক মজা দিচ্ছে যেমন, তেমনি টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাস্তব-বিচ্ছিন্ন এক অলীক দুনিয়ায়, এর ফল তো পড়ছেই শরীরে মনে। সময় কাটানোর জন্যে খেলা, ভালবেসে খেলা এখন তো মাঠ থেকে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কম্পিউটার বা মোবাইলে এখন নানান গেম – যেগুলো খেলতে কাউকে লাগে না, একা একাই খেলা যায়। 
একা একা খেলতে গিয়ে আবার এই ভার্চুয়াল জগতেই বন্ধু খুঁজে নেওয়া। যেমন পোকেমন, যেমন তামোগাচিপোকেমন কথাটা এসেছে পকেট মনস্টার থেকে, খুদে খুদে খেলনা সব, দ্রুত এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে সেগুলো নিয়ে টিভি সিরিজ তো হলই, ডিজিটাল সংস্করণও বেরিয়ে গেল। তারপর এল তামোগাচি। সে এক অলীক পাখি। তাকে ঘড়ি ধরে খাওয়াতে হয়, ঘুম পাড়াতে হয়, এমনকি মরে গেলে ভার্চুয়াল গ্রেভিয়ার্ডে অর্থাৎ অলীক কবরখানায় কবরস্থ করা হয় এই অলীক পাখিদের। এই তামোগাচির জন্ম জাপানে। কিন্তু সে শুধু জাপানি শিশুদের বন্ধু হয়ে  থাকেনি, হয়ে উঠেছে সারা পৃথিবীর শিশুদের বন্ধু। কিন্তু সত্যিই কতটা বন্ধু এরা? যাদের ধরা ছোঁয়া যায় না অন্য বন্ধুদের মতো, তাদের নিয়ে মাতামাতি এমন পর্যায়ে গেছে যে রাস্তা পার হতে হতে তামগাচির খাওয়ার সময় গেলে তাকে খাওয়াতে ব্যস্ত খুদেরা, যার ফলে হামেশাই দুর্ঘটনা। আর এই মিছিমিছি বন্ধুকে সত্যি বন্ধু ভেবে মন ভাঙা তো আকছার। 
 একবার মনে আছে, আমার জেঠাতুতো দিদি টুকিদির বিয়ে। টুকিদি পরম রূপসী, কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে বিয়ে দেওয়া হবে, এরকম ঘটনা আমাদের মায়া মফস্বলে ভাবাই যায় না। আমরা খুব উত্তেজিত। বিয়ের দিন সেই বাড়িতে গিয়ে নতুন নতুন বন্ধুদের সঙ্গে খেলা চলছে। বিয়েবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে  অনবরত ওঠানামা,  একটি মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল ছড়া কাটতে কাটতে 
পেন পেন পেন,পাইল পেন, সিঁড়ি থেকে নেমে এল সুচিত্রা সেন’ আমি তো রোমাঞ্চিত, আমাদের মফস্বলে ছড়াটা কখনো শুনিনি। সারাদিন এমন আনন্দে কাটার পর শেষটা অবশ্য বিয়োগান্ত। সন্ধেয় সারা বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে, কনের সাজ দেখার জন্যে আমরা উঁকিঝুঁকি মারছি, লুচি ভাজার গন্ধে চারদিক আমোদিত, এবার বর আসবে এক্ষুনি, নিয়ে যাবে তক্ষুনি হলেই হয়, কোথায় কী, মেয়ের প্রেমিক, তার কমান্ডো বাহিনী নিয়ে এসে হাজির। মেয়ে গটগট করে তার সঙ্গে চলে গেল। এরকম অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সের পর রাতের খাওয়া জুটেছিল কিনা কে জানে। বড়দের হাহুতাশের মাঝে আমার কিন্তু মনে ঘুরছিল –সিঁড়ি থেকে নেমে এল সুচিত্রা সেন। বহুবছর পরে মা বলেছিল, একটা সময়, অনেকেই নাকি বাংলা পরীক্ষায় উত্তমের বিপরীত শব্দ সুচিত্রা লিখে আসত!
খেলনাগুলোও ছিল অন্যরকম। বারুণী বা চড়কে কেনা খেলনার মধ্যে খুব স্মণীয় চটপটি বা টমটম গাড়ি, একটা মাটির সরার ওপর একটু চামড়া আঁটা, দড়ি দিয়ে টানলে দুটো কাঠি তার ওপরে চটপ আওয়াজ তুলত। এরকম ছিল চরকি, কাঠের পুতুল, কাগজের য়ান ডাইমেনশনাল পুতুল, এসব দিয়ে একটা বাতিল চামড়ার বাক্সে আমার পুতুলের ঘর ছিল। দুএকবার পুতুলের বিয়েও দিয়েছি, তাতে লুচি আলুরদ আর বোঁদের ভোজই ছিল মুখ্য। একদিন ঘুম ভেঙে দেখি বাবা ট্যুর থেকে ফিরেছে ক রাত্তিরে, আর বিছানায় আমার পাশে রাখা একটা চোখ বন্ধ, চোখ খোলা পুতুল। সেটাই আমার ছিল অত্যন্ত মহার্ঘ্য খেলনা।
বিশুদ্ধ ইনডোর গেমের মধ্যে ছিল  ক্যারাম,  তাস,লুডো, দাবা, চাইনিজ চেকার, ব্যাগাডুলি, বিজনেস (এখন যার নাম মনোপলি। বাবা থাকলে বলতেন তালপাটালি গাঙ পেরিয়ে নাম পালটে সন্দেশ হয়েছে) এছাড়াও চোর পুলিশ, কাটাকুটি, ফুল ফল নাম দেশ
এখানে বলে রাখা ভালো, আমি অনেকগুলো ইনডোর গেমে চ্যাম্পিয়ন (বাড়িতেই অবিশ্যি!) ছিলাম, ক্যারাম তার অন্যতম।তাসেও কল ব্রে অব্দি উন্নীত হয়েছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম, ক্যারাম আর দাবা  এদুটোয় আমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হব, শুধু সময়ের অপেক্ষা।কত বিকেল ক্যারামের সামনে উত্তেজিত ভাবে বসে কেটে গেছে। কয়েক বোর্ড খেলার পর শেষ পাতে মুখমিস্টির মত ছিল তালগাছ খেলা। একবার একটি বালক, আমার চেয়ে ছোট, আমাদের পাড়ায় তার দিদির বাড়ি, দিদির বাড়ি এলে মাঝে মাঝে আসত , জমে উঠত ক্যারাম খেলা, সেই ক্যারাম খেলার ফাঁকে সে জানিয়েছিল দুধে জল থাকে।  শুনে আমি  হাসিতে ফেটে পড়লাম।  দুধে জল থাকে! তাহলে দুধে জল মেশানোর জন্যে মা দুধের দিদিকে এত অভিযোগ করে কেন? পরে যখন পাঠ্য বইয়ে পেলাম  দুধের অধিকাংশ জল, তখন আর লজ্জার শেষ ছিল না!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।