জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ৫)

মায়া – মফস্বল ও ক্যাংলাসপার্টিরা 

পর্ব ৫

ইতিহাস কইতে গেলে হিসটোরি হইয়া যায়!

চারপাশে এখন যে দুই সম্প্রদায় নিয়ে রাজনীতিক্রা জল ঘোলা করে সেই জলে মাছ ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই হিন্দু-মুসলমান নিয়ে আমাদের বাড়িতে কোন মাথাব্যথা দেখিনি। আমার মার সুবাদে অনেক মুসলমান বাড়িতে আস্তেন, তাঁদের মামা বলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম। হিন্দু আর মুসলমান যে দুই যুযুধান পক্ষ এমনটা মনে করার কোন কারণ ঘটেনি। বরং গোটা ছোটবেলা উত্তাল করে ছিল ঘটি-বাঙ্গালের দ্বৈরথ।
মার মুখে শুনেছি  তার স্কুলজীবনে  ঘটি ও বাঙাল বালক বালিকারা পরস্পরের উদ্দেশে নানা ছড়া কাটত। যেমন
বাঙাল চিংড়িমাছের কাঙ্গাল।
বাঙাল মনুষ্য নয়, উড়ে এক জন্তু
লাফ দিয়ে গাছে ওঠে লেজ নেই কিন্তু।।
বাঙাল বাঙাল করিস কেন বাঙাল কি তোর পিতা?
পূজার সময় বকশিস দিব দুই গালে দুই জুতা।।
ঘটি বাঙ্গালের ঝগড়া আরো সূচীমুখ করে বললে মোহনবাগান-ইস্টবেংগল। এর কাছাকাছি আর দুটো ছিল- সিপিএম-কংগ্রেস (হায় তিনুরা তখন কোথায়? আর পদ্ম তো নিভৃতে ফুটছে!) আর উত্তম-সৌমিত্র। সেট থিওরির মত ওভারল্যাপিং অবিশ্যি ছিল। মানে যে উত্তম ফ্যান সে ইস্টবেংগল হতে পারে, এবং সিপিএম, আবার মোহনবাগানী সৌমিত্র-ফ্যান কংগ্রেসী থাকাটাও অসম্ভব নয়। তবে এই দুটোর কোনটাই  মোহনবাগান-ইস্টবেংগলের মত আমাদের বাড়ির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা নিয়ে আসেনি।
সেইসময় এই দুটো দলই নৈকষ্য কুলীন ছিল।বিদেশি প্লেয়ার বোঝাই নিছক সাইনবোর্ড ক্লাব হয়ে যায়নি। তাই তাদের সমর্থকদের আনুগত্য, ভালবাসা, পাগলামিটাও ছিল নিখাদ। বাবার সেই সংক্রামক মোহনবাগান প্রেমের ছোঁয়ায় মনে হয় আমিই  লেনিন-র মতো মনে হত আমিও মোহনবাগান। মনে পড়ে তখন প্রায়ই বাবা আমাদের কলকাতায় মোহনবাগানের খেলা দেখতে নিয়ে যেত। আমার সঙ্গে থাকত গ্লুকোজ। হাফ টাইমে সেই গ্লুকোজ, প্লেয়ারদের খেতে দিয়ে যুগপৎ রোমাঞ্চ ও গর্ব হত। পরে যখন সই করে শিবির বদলে নিলাম, মনে হত আমিও লাল-হলুদ! কট্টর মোহনবাগানী ও ঘটি বাবা এই ভবিষ্যত জানলে হয়তো  লেডি ডাফরিন থেকে আর আমাকে জগবন্ধু লেনে আনত না, বোমার মুখে ফেলে দিত নিশ্চিত।একটি মাত্র রেডিও সম্বল করে চারদিকে বিশুদ্ধ মোহনবাগানীদের নিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ যে পরিবেশটা তৈরি হত, সেটা আজকাল আমার ওয়াঘা  বর্ডারের যুদ্ধের মহড়া বলে মনে হয়। বাবারটা অবশ্য  অনেকটাই ছায়াযুদ্ধ। কারণ সেই মফস্বলে তখনো কাছাকাছি বাঙ্গাল ঢোকেনি।পাঁচটা গোল খাওয়ার লজ্জাও নিজেদের মধ্যে ঢেকেঢুকে রাখা গেছে। কিন্তু লোহার বাসরঘরে যে ফুটো ছিল, বাবা তা বুঝতে পারেনি। এই ঘটি-বাঙ্গাল নিয়েই আস্তে আস্তে আমার বাবার থেকে অন্যরকম হয়ে ওঠার শুরু।
বাবার থেকে আলাদা? সে তো অসম্ভব! জন্মের অসুখের তীব্র যন্ত্রণা যখন চারটে ক্যাম্পজকেও হারিয়ে দিত, তখন তারা ভরা আকাশের নিচে রোগক্লিষ্ট মেয়েকে কোলে বসিয়ে বিশ্বসাহিত্যের পাঠ দিয়েছিল এই মানুষটাই। তখনো সে মেয়ের অক্ষরপরিচয় হয়নি। পরতে পরতে খুলে দেখিয়েছিল মঁপাসা টলস্টয় রবীন্দ্রনাথ চেকভের জীবন। শিখিয়েছিল যন্ত্রণা ছাড়া শিল্প হয় না। এই মানুষটার জন্যেই অনেক কিছুই নিজেকে আলাদা করে পড়তে হয়নি।শ্রুতিবাহিত পেয়েছি সংস্কৃত বাংলা ইংরেজি সাহিত্যের রত্নরাজি।শুধু সাহিত্য কেন, রাজনীতি সিনেমা নাটক এমনকি যৌনতা নিয়েও খোলাখুলি আলোচনা। একবার আমাকে বলেছিল ‘সুন্দর বটে তব অংগদখানি, তারায় তারায় খচিত’ গানটা নাকি রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে লিখেছেন, যখন আমার অপূর্ব সুন্দর বাবা  তারায় তারায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল! বেমালুম বিশ্বাস করেছিলাম সে কথা। বাবা যেমন কবিতার প্রকরণ শিখিয়েছিল, হাতে ধরে দেখিয়েছিল কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রিত নির্মেদ গদ্য লিখতে হয়, আবার তার প্রভাবেই শরৎচন্দ্রকে নস্যাৎ করে এসেছি বহুকাল,  একথাও অনস্বীকার্য।
কিন্তু ঘটি বাঙাল প্রশ্নে বাবার মৌলবাদ যত নিরীহই হক, আমার মন সাড়া দিল না।হয়ত ততদিনে পড়ে ফেলেছি কেয়াপাতার নৌকা বা নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে। দেখে ফেলেছি কোমল গান্ধার- যেখানে একটা রেললাইন এসে থেমে যায়, তার আর কোথাও যাওয়ার নেই। দৃশ্যটা আমার বুকে ধাক্কা দেয়। আর দেশহীনতার অভিশাপ সারাজীবনের মত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কাঠ-ঘটি আমিই যে পরে চরের মানুষ লিখব, দেখব সীমান্তহীন পৃথিবীর স্বপ্ন- এ হয়তো তার পূর্ব প্রস্তুতি।
তবে এগুলো সবই তাত্ত্বিক, ভারি ভারি কারণ। খুব বাস্তব যে কারণে আমি বাবার বাঙ্গাল-অপ্রীতি থেকে বেরিয়ে আসি তা হচ্ছে কানে আসা একটা ফিসফিস –বাঙ্গালরা কিন্তু দারুণ রাঁধে! কে না জানে, আমাদের  পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিনিময়ক্ষম এই রসনা। তা ভাষাই হোক, কি খাদ্য। আমার কানে আসতে থাকে কে বাঙ্গালবাড়ি থেকে কী খেয়ে এসেছে। অবশ্য এ সবের মধ্যে একটি ঘটি অহঙ্কার ফুটে ওঠে প্রচ্ছন্নে। ‘ওরা না কিচ্ছু ফেলে না। পচা মাছ, আলুর খোসা দিয়ে যে কি অপূর্ব রাঁধে!’ এই কথাটার মধ্যে বেশ কূটনীতি আছে। প্রশংসার আড়ালে বলা হল বাঙ্গালরা যেসব উপকরণ দিয়ে রাঁধে , সেসব ঘটিরা রাঁধার যোগ্যই মনে করে না। আমার জীবনে অবশ্য বিরল সৌভাগ্য হয়েছে এর উল্টোপিঠটাও দেখার। বাঙ্গালবাড়িতে ঘটিবিদ্বেষী কথা বার্তা অনর্গল। আমাকে ঘরের লোক ভেবে ‘ঘটিগুলা কী যে ছাইপাঁশ রান্ধে, মুখেই তোলা যায় না’ কিংবা কারো সম্পর্কে ‘এদেশের লোক তো, খারাপ ত হইবই, তাই কও?’
তবে সেসব অনেক পরের কথা। ইতিমধ্যে আমরা একতলা ছেড়ে দোতলায় উঠে এসেছি। বাবা বছরে দু মাস হয়তো বাড়ি থাকে, তাই দুটি ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে পড়ে থাকা মায়ের দাবীতে নিচে ভাড়াটে বসানো হল। জানি না, কীভাবে সম্ভব হল, কাঠ বাঙাল তারা। ভদ্রলোক মস্ত চাকরি করেন, তাছাড়া ফুলতলায় তাঁদের কাপড়ের মিল (সেসময় ফুলতলা একটা জমজমাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট, বিশ্বকর্মা পুজোয় ধুম কি! শিল্পের মড়কে অবশ্য সব কারখানার চিমনি চ-ই এমনি এমনি হয়ে গেল  নব্বই দশকের আগেই)। সেই  মিলের কাপড়ের বস্তা রাখা থাকত একদম শেষের ঘরে।সেখানে তাঁদের দুটি ছেলেমেয়ে আর আমি পাহাড় পাহাড় খেলি দুপুরবেলা। একদিন কাকিমা একবাটি তরকারি দিয়ে গেলেন। মাংস নয়, আলাদা মাছ নয়, স্রেফ ভেটকি মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপি।(সম্ভবত এটা বিশুদ্ধ বাঙাল টেরিটরিও নয়।)কিন্তু তেল মশলায় গরগরে কি তার স্বাদ, কি তার গন্ধ! লজ্জার মাথা খেয়ে দ্বিতীয় বার চাইতে গেছিলাম।
বাবা মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলত ‘উঃ! যেখানে সূর্যের আলো ঢোকেনি, সেখানেও বাঙ্গালরা ঢুকে পড়েছে!’ আর এ ত খোদ সিংহের ডেরায়।
পাড়াতেও ততদিনে টালির চালের একখানা ঘর আর একফালি বারান্দা করে একটি আট দশ জনের বাঙাল পরিবার উঠে এসেছে। তাদের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য আশি অতিক্রান্ত এক বৃদ্ধা, দিনরাত বারান্দায় উবু হয়ে বসে ঝিমোন আর বিড়বিড় করে বকেন। একফালি উঠোনে অল্প সময়েই তাঁরা বেগুন ধনেপাতা লংকা ফলিয়ে ফেলেছেন। টালির চালে লতিয়ে কুমড়ো, সিমলতা। উঠোন আলো করে মোরগঝুঁটি ফুল। একদিন খেলতে খেলতে সেই উঠোনে ঢুকে পড়ে দেখি সেই বৃদ্ধার সাদা থান সরে প্রকাশিত যোনির রং হুবহু সেই মোরগঝুঁটি ফুলের মত!
সেদিনই বোধহয় হাত ধরে আমাকে ভেতরে টেনে নিয়ে গেছিল বুলাদি। জলে ভেজানো তেঁতুলের ছড়া খেতে দিয়ে রুমাদি-বুলাদির মা নিজের জীবনের গল্প করতে গিয়ে আমাকে বলেছিল
‘আমাগো জীবনের ইতিহাস কইতে গেলে হিস্টোরি হইয়া যায়!’
এই ইতিহাস মুছে ফেলার সময়ে কথাটা খুব মনে পড়ে।  হ।  খাঁটি কথা। আমাদের সবারি তো তাই, কও?। ইতিহাস কইতে গেলে  হিস্টোরি হইয়া যায়!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।