“জান্নাত” অপরাধ জগতের গল্পে সৌভিক দত্ত

পেশায় গৃহশিক্ষক ও অনুবাদক। নেশা ইতিহাস চর্চা।
– তবে ভাইজান, যাই বলেন তাই বলেন, মানুষ মেরে মজা হল গলার নলি কেটে‚ ভদ্রলোকের এক কথা! গলার ঐ নরম মাংসটায়, এই এই, আপনি এখন আমার যেখানে ক্ষুর ধরে আছেন, হ্যাঁ ঠিক ওখানেই‚ আর একটুউ জোরে চাপ দিলেই খুচ করে চামড়াটা কেটে যাবে। আর ভেতর থেকে ছলকে বেরিয়ে আসবে লাল গরম রক্ত, টকটকে লাল!
.
ক্রিম মাখানো দাড়ি শেভ করতে করতে ক্ষুর ধরা হাতটা যেন হঠাৎ থেমে গেল একবার, ঠিক কন্ঠনালীর ঐ নরম জায়গাটায় এসেই! লোকটা শুধু একবার খুব আস্তে উচ্চারণ করল,
– ওহ !
– কি ওহ ? আসল মজাটা তো শুনলেনই না। রক্ত বেরোনোর ঠিক আগের মূহুর্তে ভুউউস করে একটা গরম হাওয়া বেরিয়ে আসে! কেমন বলুন তো ,কি বলা যায়, বলছি দাড়ান, হ্যাঁ অনেকটা ওই‚ ওই আপনার সাইকেলের টায়ার লিক করলে যেমন আওয়াজ হয়! হুম, এইবার হয়েছে, ঠিক ওইরকম।
.
– স্যার, আপনি কি কাসেম কে এভাবে মেরেছেন ?
– কে কাসেম কে ? ওই কাল যে জংগী টাকে……?
– হ্যাঁ! ক্ষীন স্বরে উত্তর আসল দ্বিতীয় জনের গলা থেকে।
– আরে নাহ না! ওটা পাতি এনকাউন্টার ছিলো! শুট করেছিলাম মালটাকে। পেছন দিক থেকে পিঠে একটা, আর এইই ,দাড়ান দেখাচ্ছি
, এইযে তালুর ঠিক নীচে, এখানে একটা। পালিয়ে যাচ্ছিলোতো,তাই।
– পালিয়ে যাচ্ছিল না? ঈষৎ শ্লেষ যেন মিশে যায় নাপিতের গলায়!
– হ্যাঁআআ, ওই আর কি! তাছাড়া বেঁচে থেকেই বা কোন স্বচ্ছ ভারত মিশনে নামত বালটা? জঞ্জাল যতো! কাজ বলতে তো শুধু নিরীহ মানুষ দের উপর জঙ্গীপনা! ও গেছে ভালোই হয়েছে! আল্লাহর মাল আল্লাহই তুলে নিয়েছে উছিলা দিয়ে!
.
– হুম। নাপিতের কঠিন হয়ে ওঠা চোয়াল দুটোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শুধু একটা শব্দ!
.
– জীবনে গলায় পোঁচ বসিয়েছি শুধু দুজনেরই! দুটো ইউপির মাল, এখানে এসে একটা প্রাইমারি স্কুলে বম্ব ব্লাস্টের প্লান করেছিল। কেনরে ভাই? না কম্পিউটার শিক্ষা নাকি হারাম! সহ্য করা যায় বলুন তো?
মারার ইচ্ছা হলে আমাদের মার, এই আমরা পুলিশ, মিলিটারি, পলিটিশিয়ানদের! সিভিলিয়ানস দের মেরে, আর সব থেকে বড় কথা এই এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে মেরে কিসের বীরত্ব তোদের? বাস্টার্ড টেররিষ্ট!
এক প্রবল আক্রোশে পা দিয়ে মাটিতে লাথি বসিয়ে দ্যায় চেয়ারে বসা লোকটা।
.- হু, তাতো বটেই। প্রথমবার ক্ষুর চালানো শেষে গাল দুটো আরো বেশী মসৃণ করার উদ্দেশ্যে ক্রিম লাগাতে লাগাতে বলল সে। ওদের ধরলেন কিভাবে স্যার?
– ওইই, ধরা পড়ে গেল, নিজেদের বোকামির জন্যই আরকি।
– আর ধরেই মেরে দিলেন?
– হ্যাঁ ভাই, সামনে ইলেকশন। এই খবর যদি বাইরে যেত তো কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত। একদল চিল্লাতো, পুলিশ কত অপদার্থ, শহরটা দিন দিন জঙ্গীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে, তো আরেকদল চেঁচাতো পুলিশ নিরীহ মুসলিম দের ধরে ধরে ফাঁসাচ্ছে! রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে, সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে এই সেই হ্যানো ত্যানো! আর এই দুদলের রাজনীতির মাঝে মিডিয়া গুলো টিআরপির আশায় আমাদের সিক্রেট প্লান গুলোর সর্বনাশ করে ছাড়তো !
তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে ইন্টারোগেশন এর পরেই, ঠিক তোমার মতোই একটা ক্ষুর দিয়ে, ফুউসস ! হা হা হা!
চেয়ার কাঁপিয়ে হেসে ওঠে লোকটা।
.
.
.
এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট অফিসার সমসের খান, স্পেশাল ব্রাঞ্চ! হঠাৎ করে খোদ রাজধানীর বুকেই একের পর এক জেহাদী হামলায় দিশাহারা হয়ে গেছিল সরকার। জংগী মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল স্পেশাল ব্রাঞ্চের হাতে, মহারাষ্ট্রের আর্বান নকশালদের প্রায় একার হাতেই নিকেশ করে ফেলা আইপিএস অফিসার সমসের খানের নেতৃত্বে!
.
গতপরশু দুপুরে একদল বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পুলিশকে নিয়ে একটা জঙ্গী ঘাটির ভেতর তল্লাশি চালান তিনি। আর তাতেই নাকি বেশ কয়েকটা জঙ্গীদের ধরা পড়ে‚ আর ধঈ আনার সময় তারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়! এই নিয়েই গত তিনদিন ধরে রাজনীতির আঙিনা পক্ষে – বিপক্ষে রীতিমতো তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। বিরোধী পক্ষ আর মিডিয়ার অভিযোগ যে, জঙ্গীদমনের নামে বেছে বেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরেই গনহত্যা চালাচ্ছে স্পেশাল ব্রাঞ্চ! এমনকি গতকালই পুলিশি সন্ত্রাসের প্রতিবাদে এবং শহীদ স্মরণে কয়েকটা মানবাধিকার সংগঠন মোমবাতি মিছিল করেছিল শহরের রাস্তায়। আবার খোদ পাকিস্তান থেকে জেহাদী নেতা আবু মুসা ঘোষণা করেছে, ভারতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে শান্তিকামী নিরীহ মুসলিমদের উপর পুলিশের এই অত্যাচারের বদলা তারা অবশ্যই নেবে।
.
শহরের পুলিশ ক্যাম্পের ঠিক সামনেই আছে মহম্মদ তারেক এর সেলুন। থানার সামনে হওয়াতে নেহাতই খারাপ ভীড় হয়না তার সেলুনে। তারউপর এখন এইসব ঝামেলার মাঝে তারতো পোয়াবারো! পুলিশ, মিডিয়া, ক্যাম্পের সামনে বিক্ষোভকারী বুদ্ধিজীবী ,প্রতিবাদী সংগঠন – অনেকেই মাঝেমধ্যে ঢুঁ মারছে তার সেলুনে,
– “শিগগিরই একটু শেভ করে দাওনা ভাই‚ একটু তাড়াতাড়ি, হ্যাঁ?”
সারা মাসের উপার্জন হয়তো এই কয়েক দিনেই ? তুলে নিয়েছে মহঃ তারেক। মহঃ কাশেম এর মৃত্যুতে মহঃ তারেক এর ক্যাশবাক্স উপচে পড়ছে। আল্লাহর কি অদ্ভুত খেলা! আপন মনেই বলে ওঠে তারেক।
.
.
আইপিএস শমসের খান এখানে চার্জে আসার পর থেকে একদিনও আসেনি তার সেলুনে অনেক পুলিশ অফিসারই আসে, কিন্তু তিনি কোনোদিনও আসেননি। আজ হঠাৎ তাকে সেলুনের দিকে আসতে দেখেই ঘাবড়ে গেছিল তারেক! তবে কি আল্লাহ তারপ্রতি মুখ তুলে চেয়েছে? কাশেম তো এই মুনাফেক টার হাতেই শহীদ হয়েছে‚ হ্যাঁ মোল্লা সাহেব তো এর কথাই বলেছিলো। আর আজ সে এসে উঠেছে একেবারে তার হাতের মুঠোয়? মনে মনে আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারেনা তারেক। কাশেম এর মৃত্যুর প্রতিশোধ আজ সে নেবেই! হ্যাঁ, কাশেম‚ মহম্মদ কাশেমুদ্দিন রহমান‚ তার ভাই, তার নিজের মায়ের পেটের ভাই। ছোটবেলায় ভাইবোন দের ভেতর তার সবথেকে বেশী ভাব ছিলো এই কাশেম এর সাথেই দুই ভাইয়ের এত মিল দেখে স্কুলের বিজয় মাস্টার মজা করে তাদের নাম দিয়েছিল রাম লক্ষ্মণ!
সেই কাশেম বড় হয়ে মন দিলো জেহাদ ছড়ানোর কাজে‚ দার উল হার্ব ভারতবর্ষকে দার উল ইসলাম বানানোর কাজে‚আর তারেক এসে ঘাটি গেড়ে বসল খোদ এই থানার সামনে। নিজের অবশ্য খুব একটা ইচ্ছা ছিলোনা এসবে আসার, বলতে গেলে কাশেম এর চাপেই তার এই রাস্তায় আসা!
কাশেম তাকে বোঝাতো,
– “শোন, এ হল দ্বীনের কাজ! আমাদের মোল্লা সাহেব বলেছেন‚ এই লড়াইয়ে মরলে আমরা শহীদ হব, আর বাঁচলে গাজী! আর মরার পর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে জান্নাত, জান্নাত ! হিসহিসিয়ে উঠেছিল কাশেম!” খাদ্যের সামনে লকলকে জিভ বের করা লোভী সাপের মত বলেছিল ,
– “বুঝেছিস? এত সহজে জান্নাতে যাওয়ার রাস্তা ছাড়বি কেন বেওকুফ ? চল চল , এখুনি কাজে লেগে পড় . . .”
.
সেই শুরু, তারেক এর নতুন জীবন। বলতে নেই, খোদার দয়ায় পুলিশ দের অনেকেই সেলুনে বসে ফোনে দরকারী কথাবার্তা বলত , এমনকি তার সাথে হাসিঠাট্টা করতে গিয়েও মনের ভুলে বলে ফেলত অনেক গোপন খবর। খুব বেশী কিছু না পাওয়া গেলেও যা পাওয়া যেত‚ তাও নেহাতই কম কিছুনা। আর সেই সামান্য তথ্যই যোগ বিয়োগ করেই অনেক প্রয়োজনীয় খবর বের করে ফেলে তাদের মোল্লা সাহেব।সবই আল্লার রহমত। অবশ্যই তিনি মহান। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে তারেকের!
.
আজ হঠাৎ আরাফাত এসেই বলতে লাগলেন বিভিন্ন অপারেশন এর কথা! অনেক অপারেশন এর গোপণ খবর, যে খবর এখনও পর্যন্ত বাইরের কেউ জানেনা। কাকে কিভাবে এনকাউন্টার করা হয়েছে, কটা গুলিতে কাকে মেরেছে, কে মরার সময় কি বলে আর্তনাদ করেছে, কে হাত জোড় করে প্রার্থনা করেছে তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, কে মরার আগে নিজের ছোটো মেয়ের ছবি একবার দেখে নিতে চেয়েছে -এমন নানান গোপণ সব কথা ! এদের অনেক কেই চেনে তারেক। এই গতসপ্তাহে যে মোস্তাক শহীদ হল, সে তো ছিলো তার একেবারে জিগরী দোস্ত ! সেই মোস্তাক কেও এই হারামজাদা টাই মেরেছে ? এটাতো জানা ছিলোনা তার!আর কাশেম, সে তো তার নিজের . .
.
কি আশ্চর্য! শমসেরকে সে মারবে ভেবেছিল গলায় ক্ষুর বসিয়ে নলি কেটে। আর ক্ষুরটা বসানোর ঠিক আগের মূহুর্তেই কিনা লোকটা বলে উঠল গলায় ক্ষুর বসিয়ে মারার কথা! লোকটা কি মনের কথা পড়তে পারে নাকি? সে অবশ্য শুনেছে হিন্দুুদের অনেক রকম ক্ষমতা থাকে বটে, কিন্তু এই লোকটাকে তো হিন্দু না. . .যদিও মুনাফেক‚ তবুও ……নাহ‚ ভেবে কোনো দিশা খুঁজে পায়না সে। বারবার লোকটা তার বন্ধুদের মারার কথা বলে তাকে তাঁতিয়ে দিচ্ছে , এমনকি তার ভাইকে পেছন থেকে ফেক এনকাউন্টার করে মারার কথা বলে। অথচ সে . .? নিজের ওপরেই প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ওঠে তারেক।
কতবার মনে হচ্ছে দি একবার বসিয়ে ক্ষুরটা, দিই একবার, দিই? কি আর এমন কঠিন কাজ একটা মানুষকে মারা ? এই লোকটাও তো মেরেছে, নিজের হাতে মেরেছে . .অথচ সে . .! নাহ! যতবার ঘুরিয়ে গলায় উপর আনল ততবারই যেন পেটের ভেতর কি একটা মোচড় দিয়ে উঠল! ভয় নাকি অন্যকিছু? উহু, ওর দ্বারা আজ আর হলোনা …
.
তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে উঠে দাড়াল শমসের। কত টাকা? হ্যাঁ, একমিনিট, এই নিন।
.
– “বাই দ্য ওয়ে, ওই মহম্মদ কাশেম আপনার ভাই, তাই না? আপনি তো ওদের হয়েই ইনফর্মার এর কাজ করেন? কাশেম ইন্টারোগেশন এর সময় আপনার নামই বলেছিলো। কাশেম মরার আগে বলছিল সত্যিটা জানতে পারলে আপনি নাকি আমায় মেরে ভাইয়ের বদলা নেবেন। আমি বেট লড়েছিলাম যে আপনি পারবেন না‚ যারা মানুষ মারতে পারে তাদের দেখলেই বোঝা যায়‚ আপনাকে সেইরকম কোনোদিনই মনে হয়নি ! তাই নিজেই দেখতে চলে আসলাম আপনি সত্যিই আমায় মারতে পারেন কিনা!
পারলেন না তো ? ওক্কে, আপনার টাইম ওভার, এখন আমার দান। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট মহম্মদ তারেকউদ্দিন রহমান! রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল! চলুন তাহলে এবার থানায় যাওয়া যাক।কি বলেন? হু?”
.
শমসের খানের সাথে এগিয়ে যেতে যেতে তারেকের মনে হল যেন একদলা জমাট বাঁধা অন্ধকার ওর দিকে এগিয়ে আসছে। যে অন্ধকারের জন্ম আর যেখানেই হোক এই পৃথিবীতে কিছুতেই নয়‚ অন্য কোথাও‚ অচেনা কোথাও! আর তার ভেতর থেকে হিসহিস স্বরে কাশেমের গলা ভেসে আসছে , “জান্নাত ! জান্নাত!”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।