|| জীবনের চলমানতায় নদী প্রাসঙ্গিকতা || আলোচনায় তনিমা দত্ত

বর্তমানে পেশাগত ভাবে একজন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষিকা৷ অতীতে মহাবিদ্যালয়ের সাথেও যুক্ত ছিলেন৷ গবেষণার সাথে সাথে সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি ও নৃত্য,গীত,চিত্রাঙ্কনে আগ্রহী থেকে ও নিজেকে লিপ্ত রেখে তার ক্ষুদ্র জগত থেকে বর্হিজগতে নিজেকে প্রসারিত করে চলেছেন৷
নদীপ্রধান দেশ আমাদের বাংলা। এ দেশের বুক চিরে বয়ে যায় নদী। বলা হয়ে থাকে ‘বাংলার রূপ তার মাটিতে তার বৃক্ষরাজি তে সর্বোপরি তার নদ-নদীতে’।নদীর সঙ্গে আমাদের প্রাণের যোগ,যা অগাধ ও সুগভীর।ইতিহাসে পাই ঋগ্বেদে সরস্বতী ছিলেন বিদ্যার দেবী নদীরূপিনী।আজও যেমন গঙ্গা নদী। আর্যরা এসে প্রথমে উত্তরপশ্চিম ভারতের যে অঞ্চলে বসতি স্থাপন কিরেছিলেন,সেটির নাম দিয়েছিলেন ব্রহ্মাবর্ত।দুই নদীর মধ্যবর্তী এই অঞ্চল।দুটি নদীর নাম সরস্বতী ও দৃষদ্বতী।নদীর তীরে বেদ আবৃত্তি ও গীত হতো।বেদ মানে বিদ্যা অথবা বাক।যে নদীর ধারে বেদ গান,ক্রমশ সেই নদীর নামে বিদ্যদেবী আরাধিত হলেন, তাঁর নাম হলো সরস্বতী।শুধু জল যুক্ত বলেই দেবীর নাম স্বরসতী তা নয়,বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধান এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্য ছিল।এর তীরে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের নাম সারস্বত যজ্ঞ, নদীর জলে পিতৃতর্পণ বিহিত ছিল।
মানব সৃষ্টির আদিকাল থেকে নদীর সঙ্গে মানুষের আত্মীক সম্পর্ক।নদী ছাড়া মানবজীবন ছিল অসহায়।পৃথিবীর প্ৰাচীন সভ্যতা গুলির অধিকাংশ গড়ে উঠেছে নদী কে কেন্দ্র করে যেমন সিন্ধু সভ্যতা,মেসোপটেমিয়া সভ্যতা ইত্যাদি।এই সভ্যতা গুলি গড়ে ওঠার পেছনে নদীর ভূমিকা অপরিসীম।শুধু তাই নয় নদী কে কেন্দ্র করে মানবজীবনের বিচিত্র লীলা উদ্ভাসিত হয়েছে।এই নদী কখনো স্নেহময়ী,কল্যাণময়ী,আবার কখনো রুদ্ররূপী, অনিষ্টকারী।নদীর এই সৃষ্টি ও ধ্বংসলীলার মধ্যে মানুষ যেমন তার ব্যাবহারিক জীবনের প্রয়োজন মেটায়,আবার তেমনি অপার্থিব জীবনের শান্তি মেটাতে সক্ষম হয়।তবে শুধু ,সমাজ জীবনে নয়,সাহিত্যেও নদীর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।বাংলা সাহিত্য তার একটা উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।বাংলা সাহিত্যে নদীর কথা এসেছে একেবারে চর্যাপদের যুগ থেকে।পদকর্তা চাটিল পাদ ৫নং চর্যাপদে ধর্মীয় তত্বকথার মধ্যে অস্তিত্ব প্রবাহকে নদীর প্রবাহের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন-“ভবনই গহন গম্ভীর বেগেঁ বাহিঁ“। মধ্যযুগের সাহিত্যেও এই প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে।‘শ্রীকৃষণকীর্তন কাব্য’,’মহাভারত’,’মঙ্গল কাব্য’,’মৈমনসিংহগীতিকা’,’মেঘনাদ বধকাব্য’,’ব্রজঙ্গনা কাব্য’,’চতুর্দশপদীকবিতা’ প্রভৃতি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।পরবর্তীতে উপন্যাসের সূচনা হলে সেখানেও নদী এসেছে অপরিহার্যতার অঙ্গ হিসাবে।যেমন কাজী আব্দুল ওদুদের ‘নদীবক্ষে’,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীরমাঝি’,’তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’,বিভূততীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ সরোজকুমার রায়চৌধুরীর ‘ময়ূরাক্ষী’,নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উপনিবেশ’হুমায়ুন কবিরের ‘নদীওনারী’,অমরেন্দ্রোনাথ ঘোষের ‘চরকাশেম’,অদ্বৈতমল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’,প্রমথনাথ বিসীর ‘পদ্মা’,সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’,দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ আলাউদ্দীন আল আজাদের ‘কর্ণফুলী’,সামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’,সৈয়দ শামসুল হকের ‘নদী কারো নয়’,হারুন পাসার ‘তিস্তা’,শামসুল জুয়েলের ‘মরা ডাকাতিয়া’ সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গহীন গাঙ’ ইত্যাদি উপন্যাসে নদী এসেছে অপরিহার্যতার অঙ্গ হিসাবে।শুধু তাই নয় আমাদের বাংলা সাহিত্যে হুগলি,অজয়,ব্রহ্মপুত্র,কংসাবতী প্রভৃতি নদ নদীরও প্রভাব রয়েছে। এইভাবেই নদী গতিশীল প্রাণের অথবা কালপ্রবাহের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবজীবন ও তার সভ্যতার বয়স যেমন হাজার বছরের তেমনি নদীর সঙ্গে সাহিত্যের যোগাযোগও দীর্ঘদিনের।আর এই নদীলগ্ন সাহিত্যে বিধৃত হয়েছে কালের গোপন আর্তনাদ-আমাদের দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন ও গভীর জীবনসঞ্জাত উপলব্ধি।
নদী সাহিত্যের অনন্য অনুষঙ্গ।পারে পারে জনবসতি,নদীর ভাঙাগড়ার মতো মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক,ধর্ম,বর্ণ, গোত্র ও রাজনৈতিক অবস্থা নদী প্রসঙ্গকে ধারণ করে কখনো কখনো পরিবর্তিত হয়।পরিবর্তনের হাওয়ায় গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী।জীবনচক্রে জীবিকার পথগুলো সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে থাকে ভিন্নতর।জল গড়ায়, জীবন গড়ায়, জল থেকে উর্বর মাটির বুকে সর্বস্যহারা মানুষ বসতি স্থাপন করে।নদীর আশ্রয়ে অল্প আয়াসে আজও বাস করে কিছু মানুষ।নৌকার উপর নদীতেই তাদের জীবন-মৃত্যু,জলেই বসবাস,নাগরিক হয়েও তারা নিজ দেশে পরবাস।নদীতেই বারোমাস।বাঙলার বেদেজীবন হাজার বছরব্যাপী ভাসমান জীবন-যাপনে অভ্যস্ত।নদীই তাদের একমাত্র ঠিকানা।যুগের স্রোতধারায় বর্তমানে বেদে পরিবার গুলো এখন মাছ ব্যাবসায়ী পরিচয় ধারণ করেছে।নৌকার ভেতরেই চুলোয় চলছে রান্নাবান্না ,খাওয়াদাওয়া,ঘুম।শিশু জন্মায় নৌকা তে,নৌকাতেই বেড়েওঠা। নৌকাতেই বিয়ে,আবার নৌকাটিই জীবিকা অর্জনের মাধ্যম।নদী কেন্দ্রিক-এক অন্যরকম জলে ভাসা জীবন। নদী সরাসরি যোগান দেয় মানুষের জীবন-জীবিকার অতি প্রয়োজনীয় রসদ।“নদী জানে তাকে জোগাতে হবেই তৃষ্ণার্ত কে জল,মৎস কুলকে দিতেই হবে খুলে তার তরঙ্গায়িত জলজ স্তন।“
বাংলার অদিরূপ ছিল নদীময়,জলময়,বনময়,যা এখন অতীত।কিছুটা প্রকৃতির কারণে আবার কিছুটা মনুষ্যসৃষ্টি করণে।নদীর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে,মাটির বাঁধ দিয়ে,সেচের জন্য জল উত্তোলন করে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর নামানোর ফলে,নদী তে শিল্পবর্জ্য ফেলার ফলে প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি যা প্রকৃতির অংশ হয়ে আমাদের নানাভাবে উপকার করছে তাদেরকে হনন করতেও আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছিনা।আমাদের স্বজনতুল্য নদী ও যে অনেক বেদনা ও কষ্টে আর্তনাদ করছে তা আমাদের শোনা একান্তই কর্তব্য।নদীসংলগ্ন মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত নদী কে মনে রাখে।তবে নদী থাকলেই হয়না,তাকে যত্ন-আত্তি করে রাখতেও জানতে হয়,প্রেয়সীর মতো।লন্ডনের টেমস,প্যারিসের শ্যেন, কিংবা আরও পূবে দানিয়ুব কে দেখলে মনে হয়,কত সবুজ,কত জীবন্ত।সবাই যেন চিরযৌবনা।সেই নদীর প্রতি অনাচারেরও শাস্তির বিধান আছে সেই সব দেশে।কিন্তু আমাদের দেশে সেই নদী ই অবহেলার শিকার হচ্ছে।আর তাই কখনো কখনোও সে নিজেই তার প্রতি এবহেলার প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হচ্ছে যার পরিনাম হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর।
নদীও মানুষের জীবন এদেশে যেন একই সূত্রে বাঁধা।মানব সৃষ্টির আদি কাল থেকে নদীর সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্ক।নদী ছাড়া মানব জীবন অসহায়।সাহিত্য সমাজ ও মানুষের জীবন চর্যার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতেই তাই অনিবার্যভাবে কখনো নদীর অনুসঙ্গ এসেছে ক্ষীণভাবে আবার কখনো প্রবল দাপটে।আর তাই আমাদের উচিত এই সংকল্পে ব্রতী হওয়া যে নিজেদের এলাকার নদী গুলিকে অন্তত স্বাধীনভাবে বাঁচতে দেওয়ার চেষ্টা করা যাতে তাদের গতি কখনো স্তব্ধ না হয়ে যায়,কারণ তাদের গতিময়তাতেই আমাদের চলমানতা।আমরা যেন তাদের হত্যাকারী না হয়ে উঠি।আর আমাদের প্রত্যেকের এই ছোট্ট প্রয়াসেই গড়ে উঠবে নদীকেন্দ্রিক শস্যশ্যামলা বাংলার উজ্জ্বল গৌরবমণ্ডিত ভবিষ্যৎ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।