দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৯৫)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ৯৫
১৯৪
ভোরবেলায় অধ্যাপক করবী মিত্র ফোন করলেন। বললেন, ঠিক আটটায় গাড়ি পাঠাব। একদম রেডি হয়ে থাকবি।
শ্যামলী বলেছিল, আচ্ছা।
গাড়ি ছুটছিল। শ্যামলী করবী দেবীকে জিজ্ঞাসা করল, ম্যাম, ডক্টর সান্যালের বাড়িটা কোথায়?করবী বললেন, কলকাতায়। সায়েন্স কলেজের কাছে। জায়গাটাকে গড়পাড় বলে।
মনশ্চক্ষে শ্যামলী দেখতে থাকে বোস ইনস্টিটিউট, জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি। আর সেখানে জানালার ধারে একটি ছোট টেবিলের তিনদিকে চেয়ার নিয়ে বসে জগদীশচন্দ্র, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে মার্গারেট নোবল বসে তুমুল আড্ডা দিচ্ছেন।
অধ্যাপক করবী লক্ষ্য করলেন শ্যামলী নিজের মধ্যে ডুবে আছে। তিনি আপন খেয়ালে কবিতা বলে যেতে লাগলেন,
শ্যামলী সশ্রদ্ধ ভাবে তাকাল তার শিক্ষকের দিকে। করবী বলে চলেছেন,
টিচ মি হাফ দ্য গ্ল্যাডনেস
দ্যাট দাই ব্রেইন মাস্ট নো,
সাচ হারমোনিয়াস ম্যাডনেস
ফ্রম মাই লিপস উড ফ্লো
দ্য ওয়র্ল্ড শুড লিসন্ দেন,
অ্যাজ় আই অ্যাম লিসনিং নাউ।
টিচ মি হাফ দ্য গ্ল্যাডনেস
দ্যাট দাই ব্রেইন মাস্ট নো,
সাচ হারমোনিয়াস ম্যাডনেস
ফ্রম মাই লিপস উড ফ্লো
দ্য ওয়র্ল্ড শুড লিসন্ দেন,
অ্যাজ় আই অ্যাম লিসনিং নাউ।
করবী বললেন, বল্ তো শ্যামলী, কী কবিতা বলছি?
ম্যাম, এটা পি বি শেলির স্কাইলার্কের প্রতি কবিতা।
খুশি হয়ে অধ্যাপক মিত্রর বললেন, বাঃ শ্যামলী, বেশ তো বলতে পারলি। কি করে পারলি রে?
শ্যামলী হাসে।
তারপর অধ্যাপক করবী বললেন, শ্যামলী, এবার তুই একটা কবিতা বল্।
শ্যামলী বলল, ম্যাম, কবিতার নাম ত্রাণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৈবেদ্য থেকে বলছি।
এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে, হে মঙ্গলময়,
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয় —
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর।
দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার,
এই চিরপেষণযন্ত্রণা, ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি, দণ্ডে পলে পলে
এই আত্ম-অবমান,
….
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো।…
করবী মিত্র বললেন, বাঃ তুই তো দারুণ আবৃত্তি করিস্। আচ্ছা শ্যামলী বল্ তো এই যে একটি গানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো,… কেন বল্ তো?
শ্যামলী বলল, এই গানটা যখনই গাই, আমার কি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়।
করবী বললেন, কী হয় বল্ দেখি।
শ্যামলী বলল, আগুনকে সবাই ভয় পায়, কিন্তু তাকেই পরশমণি করে ভাবছেন রবীন্দ্রনাথ। মানুষের দেহ, তাকে গড়পড়তা লোকের মতো নশ্বর, মরণশীল, মল মূত্রে পরিপূর্ণ, এই সব ক্লিশে না বলে একেই, এই দেহকেই তুলে ধরতে বলছেন, সত্যিই তো এই দেহটুকু ছাড়া আর নিজের মতো কীই বা আছে আমাদের? আর কি বলছেন? না, দেবালয়ের প্রদীপ করতে বলছেন। তার পর বললেন, নিশিদিন আলোকশিখা জ্বলুক গানে।
শ্যামলীর শিক্ষক গাইতে থাকলেন,
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো–
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব-পানে॥
শ্যামলী বলল, ম্যাম, কবিগুরু এই যে বলছেন, আঁধারের গায়ে গায়ে সারা রাত তারা ফোটানোর কাজের কথা, বলছেন মানুষী চোখ থেকে কালো কলুষ ঘোচানোর কথা, আর যেখানে পরশ পড়বে, সেখানেই আলো জাগবে, বলছেন, ব্যথা নেই তা কিন্তু নয়, তবে ব্যথা যা ছিল আলো হবার লক্ষ্যে জ্বলে উঠবে, এই ধারণাটা আমার তো দারুণ লাগে।
ছাত্রী ও শিক্ষক, দুজনে মিলে গান গাইতে গাইতে গাড়ি পৌঁছে গেল গড়পাড়ে। দেখতে পেল ব্যালকনিতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন অধ্যাপক সান্যাল।