• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১০১)

পর্ব – ১০১

রমানাথ তাঁর হাতব‍্যাগ থেকে শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণের কার্ড বের করে শশাঙ্ক পালের দিকে এগিয়ে দিলেন। শশাঙ্ক পাল কার্ডটা খুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে বললেন, শ্রাদ্ধকর্তা কিন্তু তুমিই। মা বয়সে বড় বলে, তাঁর নামটা আগে রয়েছে। কার্ডে যখন তোমার নাম রয়েছে, লোকজন তোমার মুখ চেয়েই আসবেন। সেক্ষেত্রে তোমার সাথে তোমার মায়ের মতান্তর যেন কোনোভাবেই সামনে না আসে।
  বাসন্তীবালা বললেন, তোমার বাবা আমাদের খুবই স্নেহ করতেন, সেই জোরেই বলছি, মাকে আগলে রেখো।
রমানাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মাকে দেখাশুনার লোকের অভাব নেই। কেবল আমিই মাকে নিরিবিলিতে দুটো কথা বলব বলে কাছে পাচ্ছি না।
বাসন্তীবালা বললেন, এখন তোমার গুরুদশা চলছে। বাবা মায়ের দেহান্ত হলে তাকে মহাগুরুনিপাত বলে। আর এক বৎসর ধরে চলবে কালাশৌচ। এ সময় বিবাহাদি শুভকর্ম নিষিদ্ধ।
বাসন্তীবালা আরো বললেন, এই সময়টা তোমাকে খুব শান্ত ধীর স্থির ভাবে চলতে হবে।
শ‍্যামলী বলল, মা ওঁকে বলো, এই সময় আশ্রমের লোকজন মা ছেলেতে গোলমাল বাধিয়ে মজা লুটতে চাইবে। উনি যেন ভুলেও সেই ফাঁদে পা না দেন। আর ব‍্যাঙ্কে টাকা পয়সার অ্যাকাউন্ট, লকার আর বাড়ির দলিল সাবধানে গুছিয়ে রাখেন।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তোমার বাবার ব‍্যবসা দেখাশুনার কি বন্দোবস্ত করবে?
রমানাথ বললেন, আমি নিজে একটা ব‍্যবসা করি। আমি সেটাই আঁকড়ে থাকব।
শশাঙ্ক পাল বললেন, একটা ব‍্যবসা মানে ফুলটাইম চাকরির চাইতেও বেশি।
শ‍্যামলী জানতে চাইল, আপনার কিসের ব‍্যবসা?
রমানাথ বললেন, গিফট আইটেমের।
শ‍্যামলী জানতে চাইল, আপনার বাবা কিসের ব‍্যবসা করতেন?
 রমানাথ বললেন, সে অনেক রকম ব‍্যবসা।
শ‍্যামলী বলল, কি কি রকম?
রমানাথ বললেন, বাবা একটার পর একটা ব‍্যবসা বাড়িয়ে গিয়েছিলেন। আর ওই জোরেই বাড়ি গাড়ি সব‌ই করেছেন। তবে বাবার প্রথম ব‍্যবসা হল ডেকোরেটরের জিনিস ভাড়া দেওয়া। শতরঞ্চি, ত্রিপল, এইসব যা অনুষ্ঠানে ম‍্যারাপ বা প‍্যাণ্ডেল বাঁধতে লাগে।
শ‍্যামলী বলল, বেশ, এবার দ্বিতীয়?
রমানাথ বলল, বাবার দ্বিতীয় ব‍্যবসা হল, ঘুঁটে।
শ‍্যামলী অবাক হয়ে বলল, ঘুঁটে, মানে গরুর গোবরের?
সবিতা শ‍্যামলীর কথা শুনে ধমকে উঠল, হ‍্যাঁ, ঘুঁটে আবার কিসের হয়?
শ‍্যামলী হেসে বলল, ঘুঁটের ব‍্যবসাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। কি করে করতেন?
রমানাথ বললেন, ওই তো, যারা গরু পোষে, তারা ঘুঁটে যাতে দিয়ে যায়, তাইতে বাবা আগাম টাকা দাদন হিসেবে দিয়ে রাখতেন। তোমার ঘুঁটে তুমি আমাকে ছাড়া আর কাউকে বেচতে পাবেনা।
শ‍্যামলী বলল, বেশ, তারপর?
রমানাথ বললেন, তারপর আরেকটা টিম থাকত, যারা মাথায় ঝোড়া নিয়ে দোরে দোরে ঘুরে ঘুরে ঘুঁটে চাই, ঘুঁটে চাই, বলে কমিশনের বিনিময়ে বিক্রি করে দেবে। আমাদের ডেকোরেটরের গোডাউনের মতোই ঘুঁটেরও গোডাউন আছে।
শ‍্যামলী বলল, বাস্ রে, ঘুঁটের গোডাউন?
রমানাথ বললেন, হেসো না শ‍্যামলী, বাবা মাসের মধ্যে দুবার লরি করে কলকাতায় বড়বাজারে ঘুঁটে পাঠাতেন।
শ‍্যামলী বলল, বড়বাজারে ওরা কি ঘুঁটের মালা বানায়?
সবিতা শ‍্যামলীকে বলল, কি হচ্ছেটা কি শ‍্যামলী?
শ‍্যামলী বলল, আহা পিসি, শুনতে দাও না ঘুঁটের মালার গল্প!
রমানাথ বললেন, সত‍্যিই মালা বানায়। ঘুঁটের মাঝখানে ফুটো করে সুতলি দড়ি দিয়ে গেঁথে রাখে। ওই জন্য আর ঘুঁটে ধরে ধরে গুণতে হয় না। মারোয়াড়ি বাড়ির সেকেলে বুড়িরা ঘুঁটের আঁচের ভাত খায়। খাস কলকাতায় অনেক মারোয়াড়ি পরিবার। অনেকেই একশ দেড়শ বছর ধরে আছে। এরা ভাল খদ্দের। বাবা অবশ‍্য বড়বাজারে ডিস্ট্রিবিউটর এর ঘরে মাল পাঠিয়ে দিতেন।
শশাঙ্কবাবু বললেন, মাটির হাঁড়িতে ঘুঁটের জ্বালের ভাত ভারি মিষ্টি হয়।
শ‍্যামলী বলল, আর কিসের ব‍্যবসা ছিল ওঁর।
রমানাথ বললেন, রিকশার।
শ‍্যামলী বলল, সে কি রকম?
রমানাথ বললেন, গরিবের পক্ষে রিকশা কেনা সম্ভব নয়। সে ডেলি হিসেবে মালিকের কাছ থেকে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। সন্ধ্যায় মালিক টাকা আদায় করে নেবে। তবে মালিক পক্ষকে মদের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। নেশা করার আগেই রিকশা জমা নিয়ে নিতে হবে, আর গলায় গামছা দিয়ে টাকা আদায় করে নিতে হবে। নেশা করে ফেললে রিকশাওলা ফতুর। সেদিন মালিক আর তার থেকে পয়সা পাবেন না।
শ‍্যামলী জিজ্ঞেস করল, আর কোনো ব‍্যবসা আছে?
রমানাথ বললেন, আছে। বাবার দুটো মন্দির আছে। কালি ঠাকুরের। রোজ সন্ধ্যায় পুজো হয়। শনিবার আর মঙ্গলবার আর প্রতি অমাবস্যায় স্পেশাল পুজো। প্রণামী বাবদে মন্দিরের থালায় যা পড়বে, তা থেকে বামুন ঠাকুর কমিশন পাবে।
 জানো শ‍্যামলী, আর একটা ব‍্যবসা বাবা করতে চেয়েছিলেন। আমার চেঁচামেচিতে করতে পারেন নি।
শশাঙ্ক পাল বললেন, কিসের ব‍্যবসা শুনি?
রমানাথ বললেন, ভিখিরির ।
শ‍্যামলী বলল, ভিখিরির ব‍্যবসা, সে আবার কি?
রমানাথ বললেন, অন্ধ বা খোঁড়া বাচ্চাদের যোগানদার আছে। চুরি করে এনে বাচ্চাদের কানা খোঁড়া বানানো হয়। অনেক সময় তাদের বাবা মা‌ই যোগানদার হয়। তাদেরকে দেখভাল করার লোক রাখতে হয়। সারা দিন ভিক্ষা করে ভিখিরি যা পাবে, তার একটা অংশ ও রাখবে। বাকিটা মালিকের। যেদিন ভিক্ষা পাবে না, সেদিন মালিক ওকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবে।
শ‍্যামলীর মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় একবার বাবার সাথে ধর্মতলায় গিয়ে প্রখর রৌদ্রের মধ‍্যে খালি গায়ে, ছোটো একটা প‍্যান্ট পরা অবস্থায়, এক হাত পা হীন যুবককে ভিক্ষা করতে দেখেছিল। সেদিন বাবাকে শ‍্যামলী প্রশ্ন করেছিল , বাবা ওর হাত পা কোনোটাই নেই, ও এখানে এল কি করে?
শশাঙ্ক পাল উত্তর দেননি। মেয়ের হাতের নড়া ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। শ‍্যামলী পিছন ফিরে ফিরে যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, ততক্ষণ দেখে গিয়েছিল।
আজ পুরোনো সেই কথা মনে পড়ায় শ‍্যামলী বলল, এমন একটা ব‍্যবসা জ‍্যেঠুকে  না করতে দিয়ে আপনি খুব মহৎ কাজ করেছেন রমানাথ।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।