অমনি বাসন্তীবালা রমানাথকে বললেন, বাবা, তোমার এখন গুরুদশা। তোমার পক্ষে এখন এই ঝুঁঝকিবেলায় ছাতে যাওয়া ঠিক নয়।
শ্যামলী অমনি হেসে উঠে বলল , আমাদের ছাতের পাশেই বাগান। তারপরে একটা ডোবার ধারে বট পাকুড় অশ্বত্থ গাছে ঝুপসি হয়ে আছে। সেখানে কালো কালো ডানাওলা বাদুড় হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে ঝুলছেন। শোনা যায়, যেসব মৃতব্যক্তির রীতিমতো শ্রাদ্ধশান্তি হয়নি, তাঁরা ওইরকম ত্রিশঙ্কুর মতো ঝোঝুল্যমান থাকেন। আপনি একটু দেখে আসতে পারেন।
সবিতা রেগে গিয়ে বলল, এই ভরসন্ধ্যে বেলা এই ধাড়ি মেয়েটার মুখের একটু রাখঢাক নেই। এই তুই ওকে রমানাথ রমানাথ করে ডাকছিস কেন রে?
শ্যামলী বলল, ওঁর পিতৃদত্ত নাম রমানাথ। তাই বলেছি। ওঁর বাড়িতে ওঁর মা কাকিমা কি নামে ডাকেন, সেটা কি আমার জানার কথা?
রমানাথ বললেন, মা আমাকে এখনো খোকা বলেই ডাকে।
শ্যামলী বলল, শুনলে পিসি, জ্যেঠিমা ওঁকে যে নামে ডাকেন, সেই নামে ডাকলে কি ভাল শোনাবে?
বাসন্তীবালা বললেন, রমানাথ তোর থেকে অনেকটা বড়। তাই নাম ধরে ডাকাটা উচিত নয়।
শশাঙ্কবাবু বললেন, এটা একটা ভদ্রতার ব্যাপার।
শ্যামলী চট করে সোফার কভারের উপর রাখা একটা তোয়ালে দিয়ে ঘোমটা বানিয়ে বলল, আমি না খুব লজ্জা পেয়েছি। এই একগলা ঘোমটা দিলাম।
রমানাথ বাসন্তীবালার দিকে চেয়ে বলল, শ্যামলী এখনকার কলেজে পড়া ডিবেট করা মেয়ে। সেকেলেপনা করলে ওকে মানাবে কেন?
তোয়ালেটা সামান্য একটু ফাঁক করে শ্যামলী বলল, মহাশয়, আপনি কি একটু চা পান করিবেন? তাহা হইলে এই অভাগিনীও একটু পাইতে পারে।
বাসন্তীবালা বললেন, সে কি, চা কেন? ওদের এ অবস্থায় চা খেতে আছে কি না, না জেনে চা দিই কি করে?
শ্যামলী বলল, ঠিক কথা, মুনিঠাকুরেরা সোমরস পান করতেন, কিন্তু চা পান করতেন বলে কোনো শাস্ত্রে লেখা নেই। চা জিনিসটা চৈনিক, আর তখনও চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান হন নি। মহাশয়, আপনি দুগ্ধপান করিবেন? দুগ্ধ বিলক্ষণ বলকারক।
রমানাথ একটু রাগ করে বললেন, শ্যামলী তোমার যদি কথা বলার সময় না থাকে, তাহলে এখন আমি উঠি।
বাসন্তীবালা বললেন, ও কি কথা, তা শ্যামলী তুই ওকে নিয়ে একটু ওঘরে যা না। শোনো রমানাথ, তুমি কিন্তু আজ এখানে দুটি লুচি খেয়ে তবে যাবে। সন্ধুব নুন যোগাড় করে ফেলেছি। ওই নুন খেলে দোষ নেই।
শ্যামলী বলল, মা সৈন্ধব লবণ ভাল কেন বলো তো?
সবিতা বলল, তুই চুপ কর্ তো। সবাই ওসব জানে।
বাবার দিকে তাকিয়ে শ্যামলী বলল, সৈন্ধব লবণ কিন্তু সমুদ্রের জল শুকিয়ে বানানো নয়। সিন্ধুর সাথে সম্পর্ক অতি সামান্য। ইংরেজি ভাষায় ওকে বলে রক সল্ট। পাথরের খাঁজে নুনের সন্ধান জানে জানোয়ারের দল। ওরা সন্ধে হলে পাথরের গায়ে নুন চাটতে আসে। ইংরেজিতে বলে সল্ট লিক। সেই জন্যে শিকারী ওই পাথরের ধারে পাশে লুকিয়ে থেকে শিকার করে।
সবিতাপিসি বলল, এই মেয়েটা একটা গল্পের ঝুড়ি। বিয়ে হয়ে গেলে কে আর এত গল্প শোনাবে?
শ্যামলী বলল, জানো পিসি, নুন ভারি মজার জিনিস। ধরো মাছ মাংসের দাম কমে গেলে লোকজন দু পিস বেশি খেতে পারে, আবার বেড়ে গেলে নিরামিষের দিকে ঝুঁকতে পারে। কিন্তু নুনের বেলা তা হবে না। দাম বাড়ুক বা কমুক, নুন মানুষ যেটুকু খায়, ওটুকুই খাবে।
বাসন্তীবালা বললেন, তা আর হবে না, নুনের দাম আর কতটুকু। এই একটু হলেই চলে। ওইজন্যে নুন নিয়ে কেউ অত ভাবে না।
শ্যামলী বলল, কিন্তু মা, নুন নিয়ে আগেকার দিনের মানুষ বিলক্ষণ ভাবত। সেকালে লোকেরা আত্মীয় বাড়িতে গেলে উপহার হিসেবে নুনের ডেলা নিয়ে যেত। নুন ভারি দামি জিনিস ছিল বলে লোকজন বলত, নুন খাবে যার, গুণ গাবে তার। নুন এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে একবার কারো বাড়িতে নুন খাবার পর, তার সাথে আর বিরুদ্ধতা করা যেত না। করলে সেটাকে নিমকহারামি বলা হত।
আর জানেন মিস্টার নন্দী, এই যে বাবুরা চাকরি করে যে বেতন পান, যাকে বলেন মাইনে, তাকে ইংরেজি ভাষায় কি বলে বলুন তো?
রমানাথ মুহূর্তে বললেন, স্যালারি।
অমনি শ্যামলী বলল, স্যালারি কথাটার উৎস ওই সল্ট। না না, বানানো নয়, সত্যি বলছি।
এমন সময় ঝনঝন করে ফোন বেজে উঠল। শশাঙ্ক পালের চোখের ইঙ্গিতে শ্যামলী ফোন ধরল। মুহূর্তে তার চোয়াল শক্ত হল। তারপর বলল, বাবা, আমি একটু থানা থেকে আসছি, তুমি নন্দী মশায়কে দেখো।
শ্যামলী বলল, দেখুন আপনার স্যার আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি নিজের খুশিতে আসি নি।
আর্দালি বলল, স্যারের টেবিলে ফাইল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উনি আসুন। তারপর ঢুকবেন।
শ্যামলী বিরক্ত হয়ে বলল, ডাকো তোমার সাহেবকে।
তর্কাতর্কি শুনে ডিউটি অফিসার উঠে এসে সম্মানের সঙ্গে শ্যামলীকে ওসির ঘরে বসালো। বলল, আমরা আপনাকে চিনি। এ লোকটা নতুন। কিছু মনে করবেন না।
শ্যামলী ঘরে ঢুকে দেখল নরম হলুদ রঙের দেওয়াল আর সেই দেওয়ালে বিদ্যাসাগর মশায় আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। ওসির চেম্বারের পরিবেশ দেখে সে ভিতরে ভিতরে বেশ স্বস্তি ফিরে পেল।
ওসি খানিকটা সময় পরে ফিরে এলেন। বললেন, ম্যাডাম, আপনাকে বসিয়ে রেখেছি আমি সেজন্য খুব দুঃখিত। আমি আগে কখনও আপনাকে মিট করি নি, কিন্তু আগের ওসি আপনার সম্বন্ধে আমাকে বলে গিয়েছিলেন।
শ্যামলী হেসে বলল, খারাপ কিছু বলে যান নি নিশ্চয়।
ওসি বললেন, না, ভালই বলে গিয়েছেন।
শ্যামলী বলল, এবার বলুন, ডেকেছেন কেন?
জানেন তো, পুলিশকে সবাই ভয় পায়, কিন্তু পুলিশও যে কাউকে ভয় পায়, তা সবাই জানে না।
শ্যামলী হেসে উঠল। বলল, তা আপনি কাকে ভয় পান?
অফিসার ইন চার্জ বললেন, যে কোনো জেনুইন ভদ্রলোক যাঁকে ভয় পান, তাঁকে।
শ্যামলী বলল, কে তিনি?
অফিসার বললেন, ওহোঃ, আপনি বুঝতে পারলেন না? আমার স্ত্রী।
শ্যামলী বলল, ভদ্রমহিলা খুব রাগী বুঝি?
অফিসার বললেন, না না, মোটেও রাগী নন, বেশ পুতুল পুতুল গড়ন। আমার কাছে তাঁর মাত্র দুটি , না না, ঠিক তিনটি চাহিদা।
শ্যামলী বলল, যথা?
ওসি বললেন, প্রথম হল, সকালে উঠে যোগব্যায়াম করতে হবে। দ্বিতীয় হল, সময় মতো খেতে হবে। বাড়ির বাইরের খাবার নট অ্যালাও।
শ্যামলী হেসে বলল, আর তিন নম্বরটা?
ওসি বললেন, আমাদের দুটো বাচ্চা। তাদের পড়াতে হবে।
শ্যামলী বলল, সে কি, বাচ্চাদের পড়াবেন না?
ওসি বললেন, আমি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজ থেকে সায়েন্স গ্রাজুয়েট। পড়াতে পারি। কিন্তু একটা তিন আরেকটি চার, এই বয়সের বাচ্চা পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
শ্যামলী হেসে ফেলল। সত্যি, এইটুকু বাচ্চাদের বাড়িতে না পড়িয়ে খেলাধুলা করতে দিলেই ভাল।
ওসি বললেন, যাই হোক, আপনি আমার কষ্টটা বুঝতে পারলেন। আসলে ওঁর ধারণা আমি খুব ভাল মাস্টার।
শ্যামলী বলল, এহেন ধারণা তৈরির কোনো কারণ আছে নিশ্চয়ই।
ওসি বললেন, না, উনি আমারই ছাত্রী ছিলেন কি না!
শ্যামলী কল্পনায় একটা সুখী ও পরিতৃপ্ত সংসারের ছবি দেখতে পেল। তারপর বলল, ডেকে পাঠিয়েছেন কেন বলুন?
ওসি একটা ইংরেজি স্টেটসম্যান শ্যামলীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ছোটবেলা থেকে স্টেটসম্যানের মতো ইংরেজি লিখব, এই ছিল স্বপ্ন।
শ্যামলী দেখল, প্রফেসর সান্যালের সাথে তার ছবি যেদিন বেরিয়ে ছিল, সেই পরশুদিনের কাগজটি।
শ্যামলী ধীরে ধীরে বলল, দেখুন অফিসার, শুধু এই কাগজটা দেখাবেন বলে আপনার মতো ব্যস্ত মানুষ আমাকে ডেকে পাঠান নি।
ওসি বললেন, আমি আপনার ছবি দেখে যতটা ইনটেলিজেন্ট ভেবেছিলাম, আপনি তার চেয়ে বেশি ইনটেলিজেন্ট।
ওসি বললেন, দেখুন ক্লাসিক্যাল গানের গুণী শিল্পী গাইবার প্রথম দিকে আলাপ করতে থাকে। তার পর বিস্তার, বন্দিশ, তান, গমক, মীড়। কিন্তু আলাপ দেখেই বুঝতে পারবেন শিল্পী কোন্ ঘরাণার।
শ্যামলী বলল, আমি বাড়িতে গেস্ট ফেলে ছুটে এসেছি। যদি দয়া করে আসল কথাটা বলতেন।
ওসি বললেন, চলুন, আমার আজকের সন্ধ্যার গেস্টদের দেখাই।
ওসি উঠে এগিয়ে চললেন। ওসির পিছনে পিছনে শ্যামলী গেল। হাজতখানায় কয়েকজন যুবকের মধ্যে বসে আছে শান্তনু আর অতনু। শ্যামলীকে দেখে ওরা হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজল।
শান্তনুকে রীতিমতো পুলিশী গলায় অফিসার জানতে চাইলেন, এই ভদ্রমহিলা তোমাদের কে হয়?
মিয়োনো স্বরে সে জবাব দিল, বোন।
ওদের দেখিয়ে নিয়ে তিনি শ্যামলীকে আবার ঘরে এনে বসালেন। বললেন, আপনার ভাইদের আমরা আটকে রেখেছি বলে আমাদের আপনি খারাপ ভাববেন না। ওরা লেবুবাগান বস্তিতে মারপিট করে ধরা পড়েছে।
শ্যামলী বলল, লেবুবাগান বস্তি মানে…
অফিসার সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ। ব্রথেল। ওখানে মদের পার্টি করছিল। জুয়া খেলছিল। মারামারি করে ধরা পড়েছে।
শ্যামলী শিরদাঁড়া টানটান করে বলল, অফিসার, আপনার আইনে ঠিক যা সাজা হয়, তাই দিন ওদের।
ওসি বললেন, আমি জানতাম, আপনি এটাই বলবেন। কিন্তু আমি ওদের বেইলেবল কেস দেব, আইপিসির ৫০৬, ৩২৩ আর ৩৪১। সব বেইলেবল সেকশন। বেল দিয়ে দিচ্ছি। বেল নিয়ে বাড়িতে রাখুন। ভদ্রলোকের ছেলে। হাজতে রাখা ভাল দেখায় না।
শ্যামলী বলল, আমায় কি করতে হবে?
অফিসার বললেন, একটা ক্রিমিনাল লইয়ার আনুন। সে সিওরিটি দেবে। আমি তক্ষুনি ছেড়ে দেব। পরে কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কেস হবে । খুব বেশি কিছু হবে না।
শ্যামলী বলল, আমি কলেজে পড়ি। আমার তো টাকা নেই। বাবাকে জানাবো। বাবাই যা কিছু করবেন।
ওসি বললেন, দেরি করবেন না কিন্তু। ইতিমধ্যে একবার টিফিন খাওয়াতে হয়েছে। দেরি করলে রাতের খাবার খরচাও আমাদের পকেট থেকে দিতে হবে।
শ্যামলী বাড়ি গিয়ে দেখল তখনও রমানাথ বসে আছেন।
শ্যামলী তাঁকে বলল, আপনি এবার বাড়ি যান।
তিনি বললেন, তুমি ঠিক আছ তো?
শ্যামলী বলল, এখনো অবধি তো আছি। আপনি আর দেরি করবেন না। পৌঁছে একবার ফোন করে বলবেন, ভুলে গেলে চলবে না।
রমানাথকে সদর দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে শ্যামলী বাবাকে শান্তনু আর অতনুর খবর বলল। বলল, পুলিশের অফিসার বলেছেন, বেল নিলে এখুনি বাড়িতে ফিরে আসতে দেবে।
শশাঙ্ক পাল রাগ করে বললেন, আমি যাব না যা। পুলিশ যা পারে করুন। মারধোর করে করুক। আমি ছাড়াতে যাব না।