• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১০৮)

পর্ব – ১০৮

পুজোর ছুটি শ‍্যামলী কাটিয়ে দিল প্রতিটি দিন গ‍্যারাজে কাজ করে। ছুটি শেষে কলেজ শুরু হতে শ‍্যামলী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আবার রিডিং রুমে যাওয়া হবে। মনোমত বইগুলো টেনে টেনে বের করে এনে খুশি মতো পড়ে যাবে।
বিজয়া সারতে সে গিয়েছিল অনসূয়া চ‍্যাটার্জির বাড়ি। তিনি বলেছেন পড়াশুনায় আরো গভীর মনোযোগ দিতে। আর বললেন যে কোনো আর্থিক প্রয়োজনে সহযোগিতা চাইতে যেন ভুলে না যায় সে। তখনই শ‍্যামলীর মনে পড়ে গিয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে জিজ্ঞাসাদীর্ণ যুবক নরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা। লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী পিতা বিশ্বনাথ দত্তের অকালপ্রয়াণে  নরেনের পৈতৃক পরিবার আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। তাঁর বাবা বিশ্বনাথ যেমন আয় করেছেন, তেমনি ব‍্যয় করে গিয়েছেন। বড় সংসারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ভুবনেশ্বরী দেবী হিমসিম খাচ্ছেন। তার আঁচ এসে পড়ছে যুবক নরেনের উপর। পিতার পেশায় প্রবেশ করেন নি নরেন্দ্র। বরং আধ‍্যাত্মিক জিজ্ঞাসায় আকুল। গুরু জানলেন সেই কথা। নরেন্দ্রকে বললেন দক্ষিণেশ্বরের কালি মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভবতারিণীর পাদপদ্মে নিজের আর্থিক অনটনের কথা নিবেদন করতে। পিতৃহারা যুবক যতবারই ভবতারিণীর সমীপে নিজের সমস্যার কথা বলতে যান, ততবারই আর বলে উঠতে পারেন না।  মুখে শুধু আসে, আমায় জ্ঞান দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও। এছাড়া আর কিছু বলতে পারেন না। আবার সহৃদয় গুরু ঠেলেঠুলে পাঠান। বলেন, বল্, মাকে বল্, মা অবশ্যই তোর কষ্ট ঘোচাবেন। বারবার তিনটি বার চেষ্টা করেও নরেন দত্ত প্রতিমার সম্মুখে নিজের দৈন‍্যের কথা বলতে ব‍্যর্থ হলেন। একটাই কথা বলতে পেরেছিলেন, আমায় জ্ঞান দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও। তখন গুরু বলে দিলেন, যা, তোর মোটা ভাত কাপড়ের অভাব হবে না।
কিন্তু শ‍্যামলীর অন‍্য রকম মনে হয়। সে ভাবে নরেন্দ্র দত্ত যে মাপের মর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তাঁর পক্ষে কি মাটির প্রতিমার কাছে কোনো স্থূল চাহিদা পেশ করা সম্ভব ছিল? কোনো বিচক্ষণ ব‍্যক্তি কি মৃন্ময়ী প্রতিমার কাছে ভাত কাপড় চাইতে পারেন? তীক্ষ্ণ মেধা, দুর্জয় আত্মবিশ্বাস, সংগঠনী প্রতিভা আর প্রখর ব‍্যক্তিত্বের অধিকারী যুবকটি জ্ঞান বিবেক আর বৈরাগ‍্য ছাড়া আর কোনো কিছুই কি চাইতে পারতেন?
অক্টোবরের শেষ দিনটিতেও শ্যামলী সকালে উঠে কলেজ গিয়েছিল। পুরো ক্লাস করে সে ব্যাঙ্কের কাজ সেরে ছেলেদের কলেজের ক্যান্টিনে ডাল ভাত সবজি খেয়ে সেই কলেজের লাইব্রেরীতে অভ্যাস মতো পড়ছিল। এমন সময় কলেজ হঠাৎ করেই ছুটি হয়ে গেল। কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দেখালেন না। লাইব্রেরীর স্টাফ এসে বলল “শ্যামলী, আজ বাড়ি যাও। কলেজ ছুটি করে দিয়েছে।“
কেন, হঠাৎ ছুটি কেন?
এদিক ওদিক তাকিয়ে কর্মীটি বললো, “কি জানি কেন, মনে হচ্ছে দিল্লিতে কিছু একটা বড় ব্যাপার হয়েছে। তুমি সোজা বাড়ি চলে যাবে কিন্তু।“
“কিন্তু কি হয়েছে, কেন ছুটি সেটা বলবে তো? দিল্লিতে কি হয়েছে?”
“কি জানি কি হয়েছে, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে । তুমি দেরি করো না, আমরাও বেরিয়ে পড়বো।“
শ্যামলী উৎকণ্ঠিত মনে বইপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো। কি এমন দেশে হল যে সব স্কুল কলেজ ছুটি করে দিতে হল? আর এত ঢাক ঢাক গুড় গুড়ই বা কেন?
রাস্তায় বেরিয়ে শ্যামলী দেখলো রাস্তায় ভিড়। স্কুল কলেজ সব ছুটি হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় না কি দাঙ্গা বেধে গিয়েছে। দিল্লিতে না কি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে কারা গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। যারা ওঁকে মেরেছে, তারা না কি ওঁরই রক্ষী । নিজের বাড়ির ভিতরে, নিজের রক্ষীদের গুলিতে নিহত ভারতের প্রবল শক্তিমান প্রধানমন্ত্রী। শ্যামলী কোনও দিন ইন্দিরা গান্ধীকে পছন্দ করে নি। কিন্তু আজ ক্ষমতামদমত্ত মহিলাটিকে নিজের বাড়ির ঘেরাটোপে নিজের বিশ্বস্ত রক্ষীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবার খবর শুনে তার এক রকম খারাপই লাগল।
শ্যামলী খেয়াল করলো যে লোকেরা ছুটতে শুরু করেছে। একটা সর্বভারতীয় বাংলা সংবাদপত্র বিশেষ সংস্করণ বের করে তাতে হেডলাইন লিখেছে “ইন্দিরা গান্ধী নিহত। হত্যাকারী একজন শিখ।“ খবর পেশ করার রকম জেনে খুব খারাপ লাগল শ্যামলীর। এ জিনিস তো সাংবাদিকতা পেশার কলঙ্ক। আর এই রকম ন্যক্কারজনক সংবাদ পরিবেশনার কায়দায় সারা দেশের আবেগপ্রবণ ইন্দিরাপ্রেমীর রাগ গিয়ে পড়েছে শিখ সম্প্রদায়ের উপর। গোটা দেশে শুরু হয়ে গিয়েছে শিখ নিধন পর্ব । আবেগ। শব্দটার উপরেই নিঃসীম রাগ হতে লাগল শ্যামলীর। আবেগের চোটে খুন করা হচ্ছে সেই সব শিখদের, ঘটনার সাথে যাঁদের ন্যূনতম সংশ্রব নেই। নিরপরাধ, নিঃসম্পর্কিত শিখ জনতার উপর আছড়ে পড়ছে আবেগ বিহ্বল ইন্দিরাপ্রেমীদের ক্ষোভ । মানুষ তলিয়ে ভাববে না, বিচার বিশ্লেষণ করবে না, যেখানে খুশি অন্ধভাবে নিজের প্রতিক্রিয়া বর্ষণ করবে? না কি এটা একটা ঠাণ্ডা মাথার কারবার! দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ পত্রটি যাকে উৎসাহ দিয়েছে!
শ্যামলীর মনে এল গুরশরণ কৌর এর কথা। ফিলজফি অনার্সের মেয়েটি। কলেজে ওকে খুব চুপচাপ থাকতে দেখেছিল। কলেজের ম্যাগাজিনে হিন্দি ভাষায় গুরশরণ একটি নিবন্ধ লিখেছিল। তার লেখার বিষয় ছিল গান্ধীজীর দর্শন চর্চার প্রয়োজনীয়তা। শান্ত ধীর মেয়েটিকে অন্য মেয়েরা সেই লেখা পড়ে ব্যঙ্গ করেছিল। বলেছিল “তোর একগালে চড় মারলে আর এক গাল বাড়িয়ে দিবি তো?” মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে মেয়েটি বলেছিল, আমি তো আমার এসে-তে সে রকম লিখি নি। কলেজের করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে কথা শুনেছিল শ্যামলী। কিন্তু সে ব্যাপারে নাক গলায় নি সে। আজ মনে পড়ল। শান্ত একটি মেয়ে অহিংসা আর শান্তির সপক্ষে লিখেছে । আর তাকে ব্যঙ্গ করছে অন্য মেয়েরা। আচ্ছা, গুরশরণদের এখন কি অবস্থা?
কিন্তু গুরশরণ কোথায় থাকে, কেমন তার পরিবার শ্যামলী কিছুই জানে না। মেয়েটিও ভারি চুপচাপ । শ্যামলীও কলেজের সময়টুকুতে নিজের পড়াশুনার বেশি কিছু চিন্তা করতে চায় না, কিন্তু আজ দেশব্যাপী শিখবিরোধী হত্যালীলার খবর জেনে একটি স্বল্পপরিচিত পঞ্জাবী মেয়ের জন্য মন কেমন করে উঠলো শ্যামলীর।
“ছোড়দি কোথায় যাচ্ছেন?”
বুড়ো একজন রিকশাওয়ালা তাকে দেখে দাঁড়ালো । “উঠে পড়ুন। বাড়ি পৌঁছে দিই আপনাকে।” শ্যামলী তাকালো মানুষটার দিকে। তার মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় এর রিকশাতেই পরীক্ষাকেন্দ্রে যাবার ব্যবস্থা করেছিল বাবা। শ্যামলী তারই দায়িত্বে পরীক্ষা দিতে যাবে বলে কোন সকাল থেকে এসে বসে থাকতো লোকটা । ক’ বছরেই কি রকম বুড়িয়ে গিয়েছে সে। তবু চিনতে অসুবিধে হল না। রিকশাওয়ালা বলল “উঠুন । আজ দিনটা খারাপ।“
শ্যামলী দোটানায় পড়ে। বলে “তুমি চলে যাও ভাই। আমার একটা কাজ আছে।“
“ আজ আর বাইরে থাকা নয় ছোড়দি। এখনি আপনাকে বাড়ি যেতে হবে।“
শ্যামলী ভাবল লোকটি এখনো তাকে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী কিশোরী ভাবছে না কি? তাহলে কি তার চলনে বলনে এখনো ততোটা ভারিক্কি ভাব আসে নি, যা দেখলে মানুষ নারী বলে স্বীকার করে?
একটু শক্ত হয়ে বলল শ্যামলী “আমার একটা কাজ আছে।”
রিকশাওয়ালা বলল “আজ আবার কি কাজ! বললাম না, আজ দিনটা খুব খারাপ?”
শ্যামলীর রাগ হল। কিন্তু মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে সে বলল “সত্যি আমার একটা কাজ আছে।“ বলে জোরে পা চালিয়ে সম্পূর্ণ অন্য দিকে হাঁটা লাগালো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।