• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৩)

‘যেনাহং নামৃতা স্যাং’

২২

যে কোনও মানবদরদী লোকে চর্চাভাবনার কাজটাকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। কেন না সভ্যতার ওই একটা বড়ো রাস্তা। কিন্তু এই রামচন্দ্র লোকটা শম্বুক নামে একটা গরিব লোকের গলা কেটে নিয়েছিল তপস্যা করার অপরাধে।
তাই না কি?
হ্যাঁ , শূদ্র শম্বুক মাথা হেঁট পা উপরে করে তপস্যা করছিল। শূদ্রের তপস্যা করা বারণ। তাতে না কি পাপ হয়। শূদ্র শম্বুকের তপস্যায় পাপের প্রসারে না কি এক বামুনের ছেলে মরে যায়। বামুন রাজার কাছে প্রতিকার চাইলে রাম তপস্যারত হেঁটমুন্ড ঊর্ধপদ শম্বুকের প্রাণদণ্ড মঞ্জুর করলেন। তপস্যারত যোগীর গলা কেটে দিয়ে কোন সুশাসনের নিদর্শন তুলে ধরেন রাম?

২৩

আমাদের প্রশ্নটা ছিল আদর্শ ভারতীয় দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে। শুধু রামে আটকে থাকলে চলবে কেন?
তাহলে শুনুন , ভারতীয় পুরুষেরা নারী সম্পর্কে কোনোদিন সমভাব অনুভব করেন নি। আমরা আজ কন্যাভ্রূণ হত্যার নিন্দা করি। হরিয়ানা রাজস্থানে মেয়ে পুরুষের অনুপাত সাংঘাতিক কম বলে উদ্বেগ প্রকাশ করি। কী করি তো ?
অতিথিরা চুপ।
কেন করি বলুন তো ?
আপনিই বলুন।
কেননা প্রকৃতি নারী ও পুরুষের সংখ্যার একটা ভারসাম্য রাখতে চায়।
কিন্তু রামেদের বোনের নাম শোনেন? পাণ্ডবদের একটা বোন জন্মায় না কেন? দুর্যোধনদের একশো ভাই হতে পারে, আর বোনের বেলা কেবল দুঃশলা? রাবণদের কটা বোন ?
সমস্তটাই কি শুধু কা্কতালীয় ঘটনা?
সত্যি রামেদের বোন ছিল না , তাই না?
ছিল ছিল। শান্তা নামে দশরথের একটি কন্যা হয়েছিল একদা।
একদা?
হ্যাঁ, মহারাজ দশরথ সে মেয়েকে পালন করেন নি। রাজা লোমপাদ সেই কন্যাকে পালন করেন।
তো, সেই শান্তার কী হল?
কি আর হবে? বিয়ে হল।
কার সাথে? কোথাকার রাজার সাথে বিয়ে হল শান্তার?
না না, রাজার ঔরসে জন্ম শান্তার। অর বিয়ে হল ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির সঙ্গে।
মুনি?
হ্যাঁ , ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির সঙ্গে সেই শান্তার বিয়ে হয়। মুনির মাথায় আবার হরিণের মতো শিঙ
শিঙ ? মুনির মাথায় শিঙ? শিঙ ওয়ালা বর ?
না হলে আর বলছি কি?
ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির পিতা হলেন বিভাণ্ডক মুনি। আকাশে অপ্সরীদের উড়ে যেতে দেখে মুনি বিভাণ্ডকের রেতঃপাত হয়।
মুনির রেতঃপাত?
মুনি বলে কি মানুষ নয়? সুন্দরী নারী দেখলে অনেকের অমন হয়। আমাদের শিব ঠাকুরের অমন হত।
শিব ঠাকুরেরও ?
হ্যাঁ , চণ্ডী মেছুনী সেজে মাছ ধরছিলেন। আর শিব চণ্ডীকে পরদার মনে করে … তার পর রেতঃপাত …সাপিনীর গর্ভে মনসা। সাধে চন্ডী মনসাকে দেখতে পারতেন না?
তো মুনি বিভাণ্ডকের রেতঃপাত হবার পর কি হল?
একটি হরিণী সেই মুনি বিভাণ্ডকের বীর্য সহযোগে গর্ভবতী হয়। সেই সন্তানের মাথায় হরিণের মতো শিঙ।
সেই পুত্রসন্তান ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি ?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তার সাথে শান্তার বিয়ে দিলেন তার পালক পিতা লোমপাদ ; যে শান্তা আসলে রাজা দশরথের কন্যা …। কেমন লাগছে আদর্শ ভারতীয় দের গল্প?

২৪

বাবা, তোমরা এবার এ ঘরে এস। খাবার ঠাই হয়েছে।
সে কি , এবার আমরা বাড়ি যাব। গল্পে গল্পে রাত কতো হয়েছে খেয়াল করি নি।
তা বললে হয় বাবা? আমাদের সৌভাগ্য যে তোমরা সকলে গল্প করে খুশি হয়েছ। আমার মেয়ে যে এত গল্প করতে জানে , তা আমিই জানতাম না। পেটের মেয়ে বলে বলছি না বাবা, মেয়ে আমার খুব ভদ্র।
শ্যামলী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
মা রে, তুই একটু ওদের খেতে নিয়ে আয়। আমার যে আরও দেখাশোনার কাজ আছে।
শ্যামলী চোখ তুলে তাকায়। পাত্রের বন্ধুরা সে চোখে অগাধ বন্ধুতা দেখতে পায়।
সে কি মাসিমা, আমাদের যে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। কাল সবার অফিস।
গাড়ির ড্রাইভারকে কখন খাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। কাল তোমরা এখান থেকে ঝোল ভাত খেয়ে অফিস কাছারি যাবে এখন।
সে কি , আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আমাদের না বলে কয়ে চলে গেল?
না বাবা, তার মোটে দোষ নেই। সে অনেকবার করে নিজে চোখে এসে দেখে গিয়েছে যে তোমরা গল্পে মজে আছ।
সে কি, টাকাটাও তো নেয় নি লোকটা।
বাবা, তোমরা গেরস্ত ঘরে এসেছ। গেরস্তের রীতি নীতি আছে বাবা। কাল আমাদের গাড়ি তোমাদের এগিয়ে দেবে। আজ রাতটা এখানেই থাকো তোমরা। কাচা পাজামা পাঞ্জাবি সবার জন্যে রেডি আছে। বিছানাও।
পাত্রের বন্ধুরা হাঁ হয়ে যায়। এ রকম আবার হয়? বন্ধুর জন্যে মেয়ে দেখতে এসেছে, না অনেকদিনের আপন জনের বাড়িতে এসেছে ঠাহর পায় না তারা। একজন বলে, বেশ তো, আজ সারা রাত ধরে আদর্শ দাম্পত্যের গল্প শুনব।
শ্যামলী বলে, ইশশ , শখ কতো ! খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল আমার ক্লাস টেস্ট। কিচ্ছু তৈরি হতে পারি নি আপনাদের জ্বালায়। চোখে তার দুষ্টু হাসি খেলা করে।
বন্ধুদের একজন বলে, কি সাহস আপনার? জানেন না, অতিথি নারায়ণ ? নারায়ণ গল্প শুনবে বলছে !
হুম, নারায়ণ ! অতিথির গল্প শোনাবো আর একদিন। তিব্বতে ওরা কি করে অতিথি নারায়ণের সেবা করতো। রাহুল জী লিখেছেন।
কি করে?
এবার শ্যামলীর বাবা এসে তাগাদা দেন, চলো চলো, আর গল্প নয়। খেয়ে নেবে চলো।ওরা বাবার সাথে খাবার ঘরে চলে গেলে সবিতা পিসি ঢুকল।
হ্যাঁ রে মেয়ে, অতোগুলো পুরুষ কে কি কথার যাদুতে এমন মাতিয়ে দিলি ? ওদের তো তুই এক হাটে কিনে আর এক হাটে বেচে দিতে পারবি ! এতো রকম কথা কবে শিখলি ? কার কাছে শিখলি?
শ্যামলী তার পিসির কথা কানে নিল না।

২৫

ক্লাস টেস্ট ভালো ভাবেই উতরে গেল। বাড়িতে ফিরে চুপচাপ অঙ্কের খাতা টেনে নিয়ে বিছানায় বসে গেল শ্যামলী। বাবা কত দিন বলেছেন টেবিল চেয়ারে বসে পড়তে হয়। ও শোনে নি। বাবা এখন আর বলা ছেড়ে দিয়েছেন। ভাইয়েরা দুজনেরই পড়াশুনায় মন নেই। বড়জন সর্বত্র খেলে বেড়ায়। যে কোনও জায়গায় টুরনামেন্টের খবর শুনলে হল। সে দৌড়বে। ছোটোজন ভাল খেলে না। দাদার ব্যাগ বওয়া তার প্রিয় কাজ। বাবা ওদের কিছু বলেন না। কাল পাত্রের বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গেল। সকাল হতে নিজেকে একেবারে আলাদা করে নিয়েছিল সে। সবিতা পিসিকে ইঙ্গিতে ডেকে বলেছিল – ওঁরা ঘুমোচ্ছেন , ঘুমোন। কিন্তু আমি কলেজে চললাম। আমার পরীক্ষা আছে। বলে দিও ওঁদের।
বেলায় খেতে ডাকল মা। অঙ্কের খাতা ছেড়ে উঠলো না মেয়ে। তার পর সবিতা পিসি এসে ডাকল। হ্যাঁ রে , কাল অতো খেটেছি। সকাল থেকে রাজসূয় সামলেছি। দুপুরে একটু রেস্ট নিতে দিবি না?
পিঠে হাত রাখে সবিতা পিসি।
আদর করে চিবুক তুলে ধরে।
ওমা, তোর চোখে জল কেন? কি হয়েছে সোনা আমার ? বিয়ে হলে বাপ মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে কষ্ট হচ্ছে?

২৬

খেতে বসে মাছের বাটিটা সরিয়ে রাখল মেয়ে। মা বলল ওটা কি হচ্ছে? উত্তর করলো না সে। চটপট ডাল দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে উঠে পড়ল। নিজের ঘরে ঢুকে নিজেকে ঢুকিয়ে নিল অঙ্কের খাতায়। আর্কিমিডিস সাগরকূলে বালির উপর অঙ্ক কষছেন। কারা সব কি কথা তাঁকে জিজ্ঞাসা করছে। গণিতে মগ্ন বিজ্ঞানী চার দিকের পরিবর্তে ডুব দিয়েছেন চিন্তার গভীরে। তুচ্ছ সৈনিক সে কথা জানে না। সৈনিক জানে না গণিত। শেখে না গভীর করে ভাবতে বা ভাবাতে। সে শুধু জানে মারতে আর মরতে। গণিত সাধক তাকে হাত দেখিয়ে চুপ করতে বললেন। অঙ্কের মাঝ দরিয়ায় তিনি। সৈনিক জানে না তাঁর পরিচয়। সে শুধু জানে মারতে আর মরতে। রাজশক্তি তার কাছে সব সেরা শক্তি। বৃদ্ধ কেন বালিতে মাথা ঝুঁকিয়ে কি করছেন, কেন করছেন, সে সব জানার কোনও দায় নেই সৈনিকের। বৃদ্ধের তন্ময়তা ও তদগত ভাবটাকে সে রাজশক্তির প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা বলে মনে করে। রাজশক্তিকে অবহেলা রাজদ্রোহের সামিল। এর একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সৈনিক মুহূর্তে বুঝে নেয় রাজদ্রোহকে কিভাবে মোকাবিলা করবে। মুহূর্তে খসে যায় বৃদ্ধের মস্তক। শ্যামলীর মন খারাপ লাগে ছিন্নশির আর্কিমিডিসের জন্য। সভ্যতার কাছে এই কি প্রাপ্য ছিল মনীষীর ?

২৭

বাবার পায়ের শব্দ। বাবা আসছেন তার ঘরে। শ্যামলী জানে না বাবা কি বলবেন। অঙ্কের খাতায় জোর করে মুখ গুঁজে বসে থাকে সে। বাবা এলেন। হ্যাঁ রে মা, তোর প্রাইজের ঘড়িটা কোথায় ফেলে এসেছিলি ? এই নে, পরে নে।
বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো তার। তার মানে সেদিন দোকানে যে ঘড়িটা সে বিক্রি করে টাকা নিয়ে এসেছিল আর কোনও কারণ জিজ্ঞাসা না করেই শশাঙ্ক পালের মেয়েকে টাকাটা ধরিয়ে দিয়েছে বলে দোকানির প্রফেশনালিজমকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল , সেটা বড়ো নড়বড়ে ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। তার আরও মানে , সে এখনও লোক চিনতে শেখেনি। সে স্থির করলো বাবার কাছে নিজের মনোভাব কিছুই লুকোবে না। যা সত্য বলে অনুভব করছে, সেটা স্পষ্ট করেই বলবে।
বাবা, ওটা আমার ঘড়ি নয়।
কার ঘড়ি সেটা আমি ভালো করে জানি শ্যামলী। তুমি এটা প্রাইজ পেয়েছিলে। পল্লীর মধ্যে সব সেরা রেজাল্ট করা মেয়েটাকে সুজন সংঘ থেকে সংবর্ধিত করেছিল। আর ওটা পেয়ে তুমি আমায় দেখিয়েছিলে। গর্বে আমার বুকটা সেদিন ভরে গিয়েছিল।
বাবা, ওটা এখন আর আমার ঘড়ি নয়। আমি ওটা আর নিতে পারি না।
হ্যাঁ পারো। খুব পারো। নাও মা, তোমার প্রাইজ পাওয়া জিনিস, তুমি সাথে রাখো।
শ্যামলী গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে বলে – বাবা, আমার টাকার দরকার ছিল, তোমার থেকে আর টাকা পয়সা নেবো না ঠিক করেছিলাম। অথচ আমার নিজের কোনও সংগতি নেই। কলেজ যাবার টাকা ছিল না বলে ঘড়ি বেচেছি বাবা। ও ঘড়ি আর আমি নেবো না।
কি ব্যাপার বল তো ? কি হয়েছে তোর ?
আমি তোমার থেকে আর টাকা নেবো না। আমি টিউশনি করে পড়বো। টিউশনির খোঁজ করবো। ততো দিন যা হোক করে চালানর জন্যে ঘড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি। আমি অ্যাডাল্ট হয়ে বাঁচতে চাই বাবা।
আমার অপরাধটা কি মা? বাবা শ্যামলীর পিঠে হাত রাখেন। মেয়ে বেশ বুঝতে পারে বাবার চোখে জল চিক চিক করছে। দোকানদার তো টাকা না বুঝে নিয়ে বাবার হাতে ঘড়িটা তুলে দিয়ে যায় নি। বাবা এলাকায় সম্মানিত ব্যবসায়ী। টাকা গচ্চা দিয়ে অপমানটা হজম করে শশাঙ্ক পাল মেয়ের কাছে এসেছেন সংবর্ধনায় পাওয়া ঘড়ি মেধাবী ছাত্রীর হাতে ফিরিয়ে দিতে। শ্যামলী বাবার দিকে তাকায় না। বাবার চোখে জল দেখলে সে নিজেকে শক্ত রাখতে পারবে না।
অপরাধ কিসের ? আমি বড়ো হয়েছি। আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা দিয়েছি। এখন আমি অ্যাডাল্ট হয়ে বাঁচতে চাই বাবা।
হ্যাঁ, খুব অ্যাডাল্ট হয়েছিস। এবার ঘড়িটা পর তো মা। বাবার ওপর এতো রাগ করেছো যে সংবর্ধনায় পাওয়া জিনিস বেচে দিয়েছ। খুব অ্যাডাল্ট –এর মতো কাজ।
গলাটা আর একবার পরিস্কার করে নিয়ে শ্যামলী বলে – বাবা , আমি সত্যি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমায় পড়তে হবে। কলেজ যেতে হবে। আমি টিউশনি করে হলেও পড়বো। কিন্তু তুমি আমায় জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ। দিন নেই , রাত নেই , লোকে আমায় দেখতে আসছে। তাদের সামনে আমায় বসে থাকতে হচ্ছে। তাদের সাথে ভাল লাগুক না লাগুক, অনর্গল কথা বলে যেতে হচ্ছে। আমার এ রকম হবার কথা ছিল না বাবা।
বাবা, আমার গায়ে তোমাদের দেওয়া যে গয়না গুলো ছিল, সেগুলো জমা নাও।
শশাঙ্ক পাল মেয়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখেন। শ্যামলী তাঁর হাতের মধ্যে রুমালের ভিতরে করে কয়েকটা অলঙ্কার গুঁজে দেয়।

২৮

গয়নাগুলো হাতে নিয়ে থম মেরে গেলেন শশাঙ্ক পাল। মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন – আমি এগুলো নিয়ে কী করব?
আমিই বা কী করবো বাবা, তুমি আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিচ্ছ। আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না বাবা।
আমি তোর লেখাপড়া বন্ধ করে দিচ্ছি ? তুই কি বলছিস ভেবে দেখেছিস?
ওই হল বাবা , তোমার মেয়েকে পরের বাড়ির লোকে কেন পড়াবে? আমার ইচ্ছে ছিল অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বো, নয়ত কমার্স , তুমি চাইলে না। তোমার সাথে কম্প্রোমাইজ করে অঙ্ক নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। তাও তোমার সহ্য হল না। বিয়ের পরে আর পড়া হয়?
কেন অমন বলছিস মা? তোর দিদি তো এম এ পাশ করলো। তোরও হবে।
না হবে না, অঙ্ক অতো সোজা জিনিস না।
হ্যাঁ , সোজা নয় এটা মানছি। কিন্তু আমার শ্যামলী মা ঠিক পারবে। কি পারবি না মা সব সামাল দিতে। গয়নাগুলো নাও পরে নাও। বাবাকে দুঃখ দিতে নেই।
আমি তোমায় দুঃখ দিতে চাই নি। তুমি হঠাৎ করে বিয়ের সম্বন্ধ এনে গোল পাকিয়েছ। আমি এ বিয়েতে নেই।
তুই এ বিয়েতে নেই মানে? পাত্রপক্ষ এসে দেখে গিয়েছে। গুরুদেব যোটক বিচার করেছেন , সকলের খুব পছন্দ , আর তুমি এখন বেঁকে বসলে হবে?
তোমার বীরুভাই সম্পর্ক আনতে পারে, তোমার গুরুদেব যোটক বিচার করতে পারে ; জনা কতক ভদ্রলোক একটা গেরস্ত পরিবারে এসে আলাপ সালাপ করতে পারে। তাতেই বিয়ে ঠিক হয়ে যায় না।
বিয়ে ঠিক হয়ে যায় না ?
না, যায় না। কে লোকটা, কেমন দেখতে, কি করে , কি ভাবে , কতোটা সুস্থ , ভাবনা চিন্তায় আমার সাথে খাপ খায় কি না … বাবা ছেলেমানুষি কোরো না।
আমরা সবাই মিলে ছেলেমানুষি করছি?
পুতুলখেলাও বলতে পারো। তোমার গুরুদেব পুতুল নাচাচ্ছেন।
পুতুল নাচাচ্ছেন?
নইলে ওঁর যোটক বিচারের মানে কি? কে ওঁকে বলেছে যোটক বিচার করতে?
আমি বলেছি। আমি তোর জন্মদাতা বাবা।
হ্যাঁ , জন্মদাতা বলে তুমি আমায় হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিতে পারো না। পৃথিবীর আলো দেখিয়েছ বলে টুঁটি টিপে মারতে পারো না।
ওরে মা, এ যে জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। ঈশ্বরের নিজের হাতে তৈরি। গুরুদেব নিজে বলেছেন – তোর বিয়ে ওইখানে ঠিক হয়ে আছে।
বাবা, তোমার মেয়েকে সায়েন্স পড়িয়েছ। একটু সে কথাটা ভাবো।
ছেলেটা ভালো শুনেছি।
দ্যাখো বাবা , এ বিয়ে আমি করছি না। আমি অ্যাডাল্ট। নিজের ভাল মন্দ বোঝবার শক্তি আমার হয়েছে। আর আমি নিজের জীবনটা তোমার গুরুদেবের হাতে ছেড়ে দিতে চাই না।

২৯

বাবা, তুমি দুঃখ পেতে পারো। এ বিয়ে আমি করছি না। আমার ঘড়ি বিক্রিটা একটা প্রতিবাদ বলতে পারো। তোমার দেওয়া গহনা আমি আর পরব না। মাকে জিজ্ঞাসা করে দ্যাখো , আমি মাছ খাওয়া আজ থেকে ছেড়ে দিয়েছি। আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দাও বাবা। আমি টিউশনি করে পড়বো। আমাকে তুমি এভাবে শেষ করে দিয়ো না।
শশাঙ্ক পাল বললেন – আমি তোকে শেষ করে দেবার জন্যে বিয়ের যোগাড় করছি? শ্যামলী এ কথা তুই বলতে পারলি?
শোনো বাবা, স্পষ্ট কথার কষ্ট নেই। আমার একটাই জীবন। তা আমি মনের মতো করে যাপন করবো। তোমাদের গুরুদেবের পুতুলখেলায় আমায় পাবে না।
ওরে আমি তোর বাবা। এই বুকে ছোটোবেলায় কতো খেলা করেছিস। এই বুকটায় তুই আঘাত দিস না।
বাবা, সেন্টিমেন্টাল হয়ো না। আমার প্রকৃত ভালো চাইলে আমায় পড়তে দাও। আমার চোখ কান খোলা আছে। আমি কোনও জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্কে বিশ্বাস করি না। ওদের বলে দাও – মেয়ে এখন পড়বে। এখন সে বিয়ের কথা ভাবছে না।
মা রে, একটা কথা শোন , তোর বিয়ে না দিয়ে আমার উপায় নেই। হু হু করে কেঁদে ফেলেন শশাঙ্ক পাল।

৩০

বাবার চোখে জল শ্যামলী সহ্য করতে পারে না। নিজেকে শক্ত করতে করতে বলে – বাবা অযুক্তির কাছে মাথা নোয়াতে পারবো না। কি হয়েছে তোমার যে আমার বিয়ে না দিলেই নয়?
না দিলেই নয় রে মা। আমি খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। নিজের মুখটা দু হাতের মধ্যে লুকিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকেন শশাঙ্ক পাল।
বাবা, বাবা তোমার কি হয়েছে , আমায় খুলে বলো। কিছু লুকিয়ো না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে মেয়ে। খুব নরম গলায় বলে – বাবা, কি হয়েছে তোমার? আমরা তো আছি !
কারবারে খুব গণ্ডগোল চলছে মা!
সে কি কথা , আমায় তো বলো নি কখনো ? কি হয়েছে কারবারে ?
বাজারে অনেক টাকা দেনা হয়ে গিয়েছে। শুধতে পারছি না। অনেক চুরি হচ্ছে , ঠেকাতে পারছি না।
কি চুরি হচ্ছে? কে চুরি করছে ?
মোটর পারটসের দাম তো জানিস মা। কিনে আনতে হয়। চেনা জানা বলে অনেকে বাকিতে কাজ করে। আমাদেরও করতে হয়। কিন্তু মহাজন আমাদের ছাড়ে না। কারবারে লোকসান চলছে। লোকে দের ঠিকমত মাইনে দিতে পারছি না। তারা অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নিচ্ছে। নিজে হাতে তৈরি সেরা সেরা লোক নিরুপায় হয়ে কাজ ছেড়ে দিলো। অনেক টাকার পারটসের হিসেব নেই। ব্যাংক থেকে লোন শোধের দু দুটো তাগাদা এসেছে।
তার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে শশাঙ্ক পাল বললেন – জানিস মা, বীরু একটা পেল্লাই বাড়ি করেছে – রামনগরে।
রাম নগরে? বীরুকাকা ? কে কে থাকে সেখানে? কোথায় টাকা পেলো ?
আমি শুনেছিলাম। বিশ্বাস করি নি। আজ নিজে চোখে দেখে এসেছি। বীরুকে বড্ড বিশ্বাস করতাম।
মাকে বলেছ বাবা?
মাকে বলে কি হবে?
এই না বলছিলে জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক ? তা হলে মায়ের কাছে চেপে গেছো কেন?
কি হবে তোর মা কে বলে? কাঁদতে বসবে, নয়তো ঠাকুরের কাছে মাথা কুটবে।
আর যে মেয়েটা তোমার ব্যবসার নাড়ি নক্ষত্র বুঝতে চাইছিল, অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কাজের রাশ ধরতে চাইছিল তাকে তুমি পর করে দিলে বাবা। গুরুদেব কি বলছে?
প্রতি মাসে ওনার টাকার চাহিদা। এই করো সেই করো। আর বীরু এক পা তুলেই আছে। গুরুদেব মুখ ফস্কে একটা কথা বললেই হল।
হ্যাঁ বাবা , দুয়ে দুয়ে চার করো। তোমার বীরুভাই পাত্রের খবর আনল। আর গুরুদেব যোটক বিচার করে দিলো।
হ্যাঁ , আমি সব বুঝতে পারছি। আমার কিছু করার নেই। যে কোনও দিন একটা অঘটন হয়ে যাবে। তার আগে তোর বিয়েটা আমি সেরে ফেলতে চাই। তোর গায়ে বিপদের আঁচ লাগতে দেব না।
উফফ কি বলিহারি বুদ্ধি তোমার ? তোমাদের বিপদ হতে দেখলে আমি পরের বাড়িতে সুখে শান্তিতে থাকতে পারব বাবা ? নিজের মেয়েকে খুব চিনেছ তুমি।
আমি যে কি করব, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। দিনের পর দিন রাতে ঘুমাতে পারি না। ছটফট করি।
মা জানে সে কথা?
তোর মাকে আলাদা শোয়াই। ওকে টের পেতে দিই না।
আহা হা , কি অসাধারণ জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। এই নাও কাগজ কলম নাও। এখুনি বীরু কাকার বিরুদ্ধে এফ আই আর করো। বলো কারবারের টাকা আর জিনিস চুরি করে বাড়ি বানিয়েছে। হাফ সন্ন্যাসী লোকে রাজপ্রাসাদ বানাবার টাকা পেলো কি করে? ইনকাম ট্যাক্সওলাদেরও লেখো।
ও বাবা, গুরুদেব বীরু বলতে অজ্ঞান। পুলিশের ওপরমহলে গুরুদেবের অনেক চেনাজানা। বীরুকে কিচ্ছু করা যাবে না।
থর থর করে কাঁপতে থাকেন শশাঙ্ক পাল।
বাবা, তুমি একটু শান্ত হও। এই এখানটায় একটু শুয়ে পড়ো। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। একটু শান্ত হও।
বাবাকে প্রায় জড়িয়ে শুয়ে থাকে মেয়ে।

৩১

বাবা কি একটু একটু ঘামছে ? প্রেশার নিয়ে সমস্যা আছে বাবার? হার্টের অবস্থা কেমন? বাবা কি কখনো চেক আপ করিয়েছে ? মনে করতে পারলো না মেয়ে। লজ্জা হল। নিজের ওপর বেশ একটু রাগও হল। এক বাড়িতে, এক ছাতের নিচে থাকে। তবু মেয়ে হয়ে বাবার সমস্যা সে কিছুই জানে না। বাবা সকলকে নিয়ে হই হই করছে , বাবা গুরুদেবের আরতির তালে তালে ঘণ্টা বাজাচ্ছে, আত্মীয় স্বজন এলে তিন চার রকম শৌখিন মাছ এনে সবিতা পিসির কাছে বকুনি খাচ্ছে , পুরীর সমুদ্রে ঢেউ এর সাথে দোল খেতে শেখাচ্ছে – বাবা মানে এ রকম। সেই বাবা যে দু হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠতে পারে , সেটা কোনোদিন শ্যামলীর মাথায় আসে নি। বাবার রাতে ঘুম আসে না উদ্বেগে – আর মা সেটা জানে না , মাকে বাবা জানতে দেয় না, কিংবা মায়ের জেনে ওঠার যোগ্যতাটাই নেই। শ্যামলী এখন কী করবে ? ডাক্তার ডাকবে? না কি কারখানার চাবি তালা বদলে দেবে?
দিদিকে ফোন করলো প্রথমে। চলে আয়। দরকার আছে। সে বলল আজ তার বরের বন্ধুরা রাতে তাদের বাড়িতে খাবে। তার এখন নড়ার উপায় নেই। ভাইয়েরা নৈহাটি গিয়েছে টুর্নামেন্ট খেলতে। তাদের পাওয়া যাবে না। বীরুকাকাকে খুঁজল না শ্যামলী। মনে মনে প্রচণ্ড রেগেছে বীরু কাকার উপর। মাকে ডাকল সে , কাছে গিয়ে।
বাবার শরীরটা একটু খারাপ। আমি ভাবছি ডাক্তার ডাকবো না কি।
কেন, কি হয়েছে?
না, একটু প্রেশারের গোলমাল মনে হচ্ছে।
সে কি, কি হবে এখন?
হ্যাঁ, বাবা জানে যে তুমি হাউ মাউ শুরু করবে। ওই জন্যে তোমায় বলতে বারণ করছিল ? ও, আমায় বলতে বারণ করেছে ? তা আমায় বলবে কেন? আমি যে শত্তুর! যা পারিস তোরা বাপ বেটিতে কর! আমি কোনও কিছুতে নেই !
হ্যাঁ , তাই ভাল। তুমি টেনশন কোরো না। আমি একটু কারখানাটা দেখে আসছি।
সাইকেলটা টেনে নিয়ে রাস্তায় নামার পর মনে পড়লো অনেকদিন সাইকেল চালায় নি। যাক , সাইকেল চালানো আর সাঁতার একবার শিখলে কেউ ভোলে না।
আর যুক্তি দিয়ে ভাবতে শিখলেও আর সে ছন্দ ভোলা যায় না।
ভাবতে গিয়ে এত সমস্যার মধ্যেও ভাল লাগল তার।

৩২

সন্ধ্যে হতে যায়। কারখানায় একটা লোক বসে কাজ করছে। শ্যামলী তার বাবার চেয়ারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখান থেকে ডাকল লোকটাকে। এলে বলল – সন্ধ্যে দাও নি কেন? লোকটা ভালো করে কথা বলতে পারে না। সুন্দরী মেয়েদের সামনে আরও জিভ জড়িয়ে যায়। লোকটা কি বলবে ভেবেই পেল না। ওকে সন্ধ্যে দিতে বলল মেয়ে। লোকটা অনভ্যস্ত হাতে প্রদীপ বা ধূপ কিছুই খুঁজে পেল না। কি করবে বুঝতে পারছে না লোকটা। নিশ্চয় নতুন। ওকে ধূপ কিনে আনার জন্যে পাঁচটা টাকা দিল মেয়ে। লোকটা হতভম্বের মতো বলল – সব টাকাটা দিয়ে ধূপ কিনে আনবো ? হাসল মেয়ে। তাকে দেখে একটা লোক ভয় পাচ্ছে এমনটা সে কোনও দিন দ্যাখে নি। বাড়ির কাজের লোকেরা তার কাছে কাকা বা পিসি। তারাও শ্যামলীর কাছে গুরুজনের পর্যায়ে পড়ে। আজ হঠাৎ মনে হল সে বড়ো হয়ে গিয়েছে। এখন তাকে নিজের উপযুক্ত জায়গাটা দখল করতে হবে। এমন সময় বাবার টেবিলে কাচের নিচে সে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছবিটা দেখতে পেল। সুন্দরী রাশভারী মহিলা। সিঁথির কাছে শাদা চুলে তাঁর গ্ল্যামার পৃথিবী জোড়া। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাশালী মহিলা। কিন্তু জরুরী অবস্থা জারি করার জন্যে কিছু কিছু মহলে মহিলা নিন্দিত। এত দিন শ্যামলী জরুরী অবস্থা জারির জন্যে ওই মহিলা প্রধানমন্ত্রীকে অপছন্দ করতো। এখন মনে হচ্ছে , কখনো কখনো জরুরী অবস্থা জারি না করে উপায় থাকে না। শ্যামলী কি বাড়িতে এই মুহূর্তে জরুরী অবস্থা জারি করবে?
কারখানায় ঠিক এই মুহূর্তে কেউ নেই। যে ছিল, তাকে ও ধুপ কেনার নাম করে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার শ্যামলী রান্নাঘর আর ভাঁড়ার ঘরের তালা বাবার অফিসে আর স্টোরে লাগিয়ে দিয়ে মায়ের শোবার ঘরের তালাটা গেটে লাগিয়ে দিল। শ্যামলী জানে একটু বাদে সবাই তালা লাগানো দেখে গোলমাল করবে। বিশেষতঃ বীরুকাকা। শ্যামলীর আশংকা কারখানার চাবির সেট বীরুকাকা করিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে নিশ্চয় মায়ের শোবার ঘরের চাবির ডুপ্লিকেট বানিয়ে রাখে নি। আজ গোলমাল হক। গোলমাল না হলে বীরুকাকার মুখোশ খোলা যাবে না। এখন পাল অটোমোবিলস -এ জরুরী অবস্থা জারি। মনে মনে ভারতের সুন্দরী প্রধানমন্ত্রীকে বলে উঠলো – হ্যালো , আমি শ্যামলী পাল বলছি। কাচের তলার সুন্দরী রাশভারী মহিলাটি হাসছেন। তাঁর সিঁথির শাদা চুল দেখতে ভালো লাগছে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।