• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১২৭)

পর্ব – ১২৭

নিজের ঘরে ফিরে এসে শ‍্যামলী ফোন করল রমানাথকে। বলল, আপনি ফোন করেছিলেন। রমানাথ বললেন, হ‍্যাঁ, কয়েকবার ফোন করেছি। তুমি বাড়িতে ছিলে না। কাল আমার বাবার স্মরণে অনুষ্ঠান। তুমি সকাল সকাল চলে আসবে।
শ‍্যামলী বলল, আমার বাবা আর মা আপনাদের বাড়ি যাবেন শুনেছি।
রমানাথ বললেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আসবেন। কিন্তু তুমি একেবারে ঘুম ভেঙে ভোরবেলা চলে আসবে।
শ‍্যামলী বলল, দেখুন, আমি ঠিক কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আস্থা রাখি না। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করি না। আমার যাওয়াটা ঠিক হবে না।
রমানাথ বলল, তোমাকে তো কোনো অনুষ্ঠান করতে হবে না। যা করব, আমি করব। তুমি শুধু আমার কাছে থেকো।
শ‍্যামলী বলল, আপনার বাবা মারা গিয়েছেন। অবশ্যই সেটা শোকের ব‍্যাপার। কিন্তু শোকপ্রকাশ করার যার যার নিজস্ব পদ্ধতি থাকতে পারে। আমি ঠিক এই পদ্ধতিতে আস্থা রাখি না। নাস্তিক ও ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী একটা লোককে আপনার অনুষ্ঠানে ডাকার যুক্তি কি?
রমানাথ বললেন, ওসব কোনো কথাই আমি শুনব না। বন্ধুর পাশে তোমাকে থাকতেই হবে। সকালে গাড়ি ঠিক ছয়টায় তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে।
শ‍্যামলী বলল, আপনি তাহলে আমার কোনো যুক্তিই শুনবেন না?
রমানাথ বলল, আমি যখন শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়ব, তখন জানব তুমি ঠিক পিছনেই আছো।
এই বলে রমানাথ ফোন রেখে দিল।
আর একবার ফোন করবে ভেবে রিসিভার তুলে ডায়াল করতে গিয়েও শ‍্যামলী রেখে দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল পিছনে মা দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
মা শ‍্যামলীর ফ‍্যাকাশে মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, হ‍্যাঁ রে, কি বলল সে?
শ‍্যামলী বলল, তিনি কোনো কথাই শুনতে চাইছেন না। কেবল আবদার করছেন।
বাসন্তীবালা বললেন, কেন আবদার করবে না বল্ তো? জোর খাটানোরই যে সম্পর্কে তোদের শ‍্যামলিমা!
জোর খাটানো শব্দটা কানে লাগল শ‍্যামলীর। মা এই জোর খাটানো শব্দটা ব‍্যবহার করলেন কেন? তার পর‌ই তার মনে হল, সে নিজেই বা জোর খাটানো শব্দটা কদর্থে নিচ্ছে কেন? মনে পড়ল, রমানাথকে দেখে প্রথম পরিচয়েই ভাল লেগেছিল তার। হাসিখুশি সহজ ব‍্যবহারের মানুষ। কিন্তু শ‍্যামলীর মনে পড়ল, রমানাথ বলেছিলেন আশ্রমের লোকেরা‌ই প্রয়াত নকুড় নন্দী মশায়ের শ্রাদ্ধের সব আয়োজন পরিচালনা করছেন। রমানাথ এও বলেছেন, তাঁর মা পর্যন্ত আশ্রমের লোকদের পক্ষে। সব মিলিয়ে কি নিজের বাড়িতে রমানাথ কোণঠাসা? তাহলে তো এই সময়েই তাঁর পাশে দাঁড়ানো দরকার।
বাসন্তীবালা মেয়ের বিছানায় বসে বললেন, এই সেদিন মানুষটা এবাড়িতে এসেছিলেন। আর আগামীকাল তাঁর শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে আমাদের যেতে হবে। রমার মায়ের কথা ভেবে খুবই খারাপ লাগছে।
শ‍্যামলী বলল, মা, তুমি যে গীতা পড়ো, অনেকবার শুনে শুনে কয়েকটা লাইন আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। বাসন্তীবালা বললেন, গীতার কোন্  শ্লোকের  কথা বলছিস্?
মেয়ে বলল, দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা। তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ‍্যতি।। মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদা। আগমাপায়িনোহনিত‍্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।।
মা বললেন, এর মানে কি রে?
মেয়ে বলল, সে কি, তুমি যে রোজ রোজ পড়ো!
মা বললেন, তবু তুই বল্, তোর কাছেই শুনি।
মেয়ে বলল, এতে বলেছে, যার দেহ আছে, তার‌ই শরীরে শৈশব, যৌবন ও জরা ক্রমে ক্রমে আসে। এটাই নিয়ম। একসময় মৃত্যুও আসে। সেটাও স্বাভাবিক। বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব‍্যক্তি তাতে শোকে আকুল বা মুহ‍্যমান হয়ে পড়েন না। হে অর্জুন, শীত গ্রীষ্ম সুখ দুঃখ কোনোটাই স্থায়ী নয়, আসে যায়, তার মানে এসব চিরকাল থাকে না, হে অর্জুন, তুমি জীবনের এই নানা পরিস্থিতি সহ‍্য করো। কৌন্তেয় আর ভারত, অর্জুনের‌ই দুটো নাম মা।
বাসন্তীবালা বললেন, তুই এতসব কি করে জানলি রে!
উৎসাহ পেয়ে শ‍্যামলী বলল, আরেকটা শ্লোক খুব বিখ্যাত। বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি। তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান‍্যন‍্যানি সংযাতি নবানি দেহী।।
এর মানে হল, কাপড় চোপড় পুরোনো হয়ে গেলে, ছিঁড়ে ফেটে গেলে, মানুষ আর সে রকম পোশাক পরে না। নতুন ভাল জামাকাপড় পড়ে । তেমনি পুরোনো শরীর ত‍্যাগ করে নতুন শরীর গ্রহণ করে।
নৈনং ছিন্দতি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত‍্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।। অচ্ছেদ‍্যোহয়মদাহ‍্যোহয়মক্লেদ‍্যোহশোষ‍্য এব চ। নিত্যঃ সর্বগতং স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ।।
এর মানে হল এই ভিতরের মানুষকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা যায় না, আগুন দিয়ে পোড়ানো যায় না, জলে সে ভেজে না, বাতাসে শুকিয়ে যায় না। ভিতরের মানুষকে কেটে ছেঁটে পুড়িয়ে মারা যায় না, তার গায়ে কাদা ছিটোনো যায় না। শুকিয়ে দেওয়া যায় না। ভিতরের মানুষ চিরকাল সব জায়গায় আছেন। তিনি নিত‍্য, সর্বব‍্যাপী, স্থির ও সনাতন।
মা, তাহলে তোমার কি মনে হয় জেঠুর মৃত্যুতে রমানাথবাবুর মায়ের কান্নাকাটি করা উচিত?
বাসন্তীবালা ভারি অবাক হয়ে চেয়ে র‌ইলেন মেয়ের মুখের দিকে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।