দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৫৮)
পর্ব – ১৫৮
মা দরজায় ঠকঠক করলেন। মেয়ে দোর খুলল। কিরে, ঘুমোবি না? কার সাথে এতরাতে কথা বলছিস?
শ্যামলী চুপ করে রইল। বাসন্তীবালা বললেন, আয়, তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিই।
মা মেয়ে শুল পাশাপাশি। মা কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, ঘুমিয়ে পড়্, ঘুমিয়ে পড়্।
মেয়ে বলল, আমাকে নিয়ে সবাই এত ব্যতিব্যস্ত কেন মা? আমি তো কোথাও জায়গা জুড়তে যাই নি, কারো কাছে কিচ্ছুটি দাবি নেই আমার। শুধু নিজেকে নিয়ে এই পৃথিবীর সামান্য একটি কোণে বেঁচে থাকতে চাই। তাতে সবাই আমার ওপর হামলে পড়ে কেন?
বাসন্তীবালার মুখে উত্তর যোগায় না। সত্যিই তো বড় অকিঞ্চিৎকর দাবি দাওয়া ওর। কদিন আগে জন্মদিন গেল, মনে করিয়ে দেয়নি পর্যন্ত। তলিয়ে যেতে থাকা কারবারটাকে খেটে খুটে একটা জায়গায় টেনে তুলছে। তার মধ্যে পড়াশুনা করছে মুখ বুজে। নিশুত রাতে অন্ধকার ঘরে মেয়ের পাশে শুয়ে কোনো উত্তর খুঁজে পান না বাসন্তীবালা। মৃদু স্বরে বলেন ঘুমিয়ে পড়্, ঘুমিয়ে পড়্।
মেয়ে আবার বলে, মা সবাই আমায় এমন করে কেন?
মা বলে, দেখবি, একদিন তুই যা চাইছিস, তাই পাবি।
মেয়ে বলে, মা আমি যে কিচ্ছু চাই না, আমি সম্পত্তি চাই না, আমি প্রশংসা চাই না, আমি ক্ষমতা চাই না। আমি শুধু নীরবে নিজের কাজটুকু করে যেতে চাই। আমি তো কারোর ওপর কিছু চাপিয়ে দিই না। কিন্তু আমার ওপর তারা তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছে চাপিয়ে দিতে চায় কেন?
বাসন্তীবালা করুণ মিনতি করেন মেয়েকে। ঘুমিয়ে পড়্ মা। গুমরে গুমরে কাঁদলে যে শরীর খারাপ করবে। জানলার বাইরে থেকে শনিগ্রহ মা মেয়েকে দ্যাখে।
মৃদু চাপড়ে চাপড়ে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দেন মা। তাঁর নিজের ঘুম আসে না। চুপ করে শুয়ে থাকেন। রাতের আকাশে একটা আধটা তারা খসা দেখে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। এতবড় এই পৃথিবী। লক্ষ লক্ষ মানুষ। আর ওই কত বড় আকাশে আকাশগঙ্গা। কতো হীরের মতো চিকিমিকি তারা। ছোট্ট দুধের শিশু মেয়ে, টেপফ্রক পরা, বলে, আমি তো কোথাও জায়গা জুড়তে যাই নি, তবু সবাই আমার ওপর হামলে পড়ে কেন? ঠোঁট টিপে হাসেন বাসন্তীবালা। আয়, মোয়া দেব। জয়নগর থেকে মোয়া এনেছে তোর বাবা। আয়, খাবি আয়। ছোট্ট মেয়ে ঠোঁট উলটে বলে, আমি মোয়া চাই না। শুধু নিজেকে নিয়ে এই পৃথিবীর সামান্য একটি কোণে বেঁচে থাকতে চাই। বাসন্তীবালা বলেন, আয়, কোলে আয়, ছাতের পাঁচিল নেই, পড়ে যাবি রে!
ছোট্ট মেয়ে, টেপফ্রক পরা, ব্যথার হাসি হেসে আরো ধারে চলে যায়। ভয়ে চোখ বুজে ফেলেন মা। বুকের মধ্যে দপদপ করে ঢেঁকির পাড় পড়তে থাকে।
একি, শ্যামলী ঘুমের মধ্যে কাঁদছে কেন? কি একটা বলছে। কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। ওমা, চাদরের ভিতরে কুল কুল করে ঘেমে গিয়েছে মেয়ে। ওরে মা, স্বপ্ন দেখছিস্, কতবার বলেছি বুকে হাত চাপা দিয়ে শুবি না। মা ঠেলে তোলেন মেয়েকে। অবাক হয়ে মেয়ে বলল, এত ঘেমে গেলাম কি করে মা? কাঁদো কাঁদো হয়ে বাসন্তীবালা মেয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, হে মা জগদ্ধাত্রী, রক্ষা করো।
শ্যামলী ধড়মড় করে উঠে বসে।
কি হল, কি হল, বলে বাসন্তীবালাও উঠে বসেন। জিজ্ঞাসা করেন, কুস্বপ্ন দেখছিলি তো? ওইজন্য বলি, শোবার সময় একটু ঠাকুর স্মরণ করবি। দেখিস্ না, তোর বাবা শোবার আগে বজ্রাসন করেন। আর শোবার সময় বলেন, শয়নে পদ্মনাভঞ্চ। তুই তো কানে নিস্ না।
মেয়ে বলল, অ আজার বালথাজার।
মা ভয় পেয়ে অবাক হয়ে বলেন সে কিরে? কিসব বলছিস? মেয়ে অদ্ভুত হেসে বলে, ও কিছু না, একটা গাধা। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।
ক্রমশ…