দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৫৯)

পর্ব – ১৫৯

তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল শ‍্যামলীর। মা আগেই উঠে পড়েছেন। গায়ে জড়িয়ে দিয়েছেন একটা মোটা চাদর। কিন্তু এই চাদর জড়িয়ে দেওয়াটা টের পেল না কেন সে? অবিবাহিতা মেয়েরা ঘুমন্ত অবস্থায় কোনো স্পর্শ পেলে, সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে ওঠে। এটা প্রকৃতির দেওয়া অপার রহস্যময় সুরক্ষা কৌশল। তাহলে মা তার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিয়েছেন, সে টের পেল না কেন? তাহলে কি তার মগজের ভিতরে এই খবরটি ছিল যে, তার মা পাশেই আছেন, আর তিনি লক্ষ্য রাখছেন। তাই কি সে নিশ্চিন্তে নির্ভার মনে ঘুমাতে পারছিল? অথবা সে পুরোপুরি ঘুমোচ্ছিল না, তার‌ই ভিতরে কেউ একটা জেগেছিল, যে বলেছিল, গায়ে চাদর জড়িয়ে দিচ্ছেন মা। এতে তোমার উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। এটা
মনে হতেই তার হাসি পেল। ভাবল, তাকে অ আজার বালথাজার সিনেমার কথাটা মনে করালো কে? আস্তে আস্তে মৃত‍্যুর কোলে ঢলে পড়ছে গাধাটা। আর ভেড়াগুলো যেন বুঝতে পারছে গাধাটা মরছে, গাধাটাকে নেহাত অসময়ে মরে যেতে হচ্ছে। তাদের গলার ঘণ্টিতে বাজছে বিষাদের সুর।
 মুখ চোখ ধুয়ে দাঁত মেজে পড়তে বসল শ‍্যামলী। আজ কলেজ যাবে সে। বালথাজার নামের অর্থটা মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলার ধর্মপালের মতো। রাজার নাম‌ও হয়, মঠাধীশের নাম‌ও হয়, সম্পন্ন কৃষকের নাম‌ও হয়। হাতির নাম আদরিণী, বলদের নাম মহেশ, গাভীর নাম ধবলী, মহিষের নাম কালাপাহাড়, কুকুরের নাম ভুলু, মাছের নাম কার্তিক গণেশ। এই সিনেমায় গাধাটার নাম বালথাজার।
বাচ্চারা খুব ভালবেসে পুষেছিল বাচ্চা গাধাটাকে। গাধাকে ব‍্যাপটাইজ় করছে ওরা। বাচ্চারা বড়দের কাজের অনুকরণ করে। আসলে সামাজিক সম্পর্ক বিন‍্যাসগুলো মগজে ছাপ ফেলতে থাকে। অপ্সুদীক্ষা কথাটা মনে এল শ‍্যামলীর। বাচ্চাদের নিয়ে কত কিছু যে হয়! ছোট মামিমা গল্প করেছিলেন। তিনি শ‍্যামলীর মায়ের কাছে এসেছিলেন কচি ব‌উ। তেরো বছরের মেয়ে। বালিকা বললেই হয় ভাল। সদ‍্যোজাত শিশু শান্তনুকে বাসন্তীবালার কোলে দেখে বালিকাসুলভ আগ্রহে বয়সে খানিকটা বড় ননদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, দিদিমণি, এর বয়স কত? সাতদিন বয়সী শান্তনুর বয়স বাসন্তীবালা উচ্চারণ করেছিলেন সাত বছর! ঘাবড়ে গিয়েছিল তেরো বছরের বালিকা। বালিকা বধূ ছোট মামিমাকে কেউ সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলেছিল বাচ্চাদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই। “কিন্তু কেন?” একথা বলার অধিকার যে তার নেই মামিমা জেনে ফেলেছিল। তাকে বলা হয়েছিল, বিধাতা পুরুষ নাকি আঁতুড় ঘরে এসে বাচ্চার কপালে বিধিলিপি লিখে দিয়ে যান। বিধির সেই বিধান কেউ নাকি খণ্ডাতে পারে না।
কাজল তৈরি করতে হত মায়েদের। মনসা গাছের পাতায় ঘিয়ের কাজল দিত বাচ্চার চোখে। কপালে দিত কাজলের টিপ। মাথায় একটা কাজলের ফোঁটা দিত। পায়ের তেলোতেও কাজল চিহ্ন দেখেছে সে। কাজলের ছোঁয়া দিয়ে যাবতীয় ডার্ক এনার্জির আক্রমণ থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করতে চাইত সেকেলে মায়েরা।
বাচ্চার নামকরণ হত গুরু পুরুতের হাতে। সভ‍্য ভব‍্য শিক্ষিত সম্পন্ন গৃহস্থের বাচ্চাদের নাম একরকম হত। নিরক্ষর, সম্বৎসর অন্নকষ্টে ভুগতে থাকা মানুষের বাচ্চার নাম আরেক রকম হত। আর সন্তান হলে রীতিমতো অন্নকষ্ট হবে, এই পরিস্থিতিতে শিশুকন্যার নাম দিত আন্নাকালী, থাকমণি, ক্ষ‍্যান্তমণি। শিশুমৃত্যুর প্রকোপ ছিল খুব। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির দেবেন ঠাকুরের একটা বাচ্চা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরেও। নাম তার বুধেন্দ্রনাথ। সে অতি অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল। দেবতার রোষদৃষ্টি এড়াতে বাচ্চার নাম হত এককড়ি, দুকড়ি, তিনকড়ি পাঁচকড়ি সাতকড়ি, আরে এগুলো সব মৌলিক সংখ‍্যা যে! তারপর‌ই মনে হল, না না, এক তো মৌলিক সংখ‍্যা নয়! মনে পড়ল ক্ষুদিরামের কথা। একমুঠো খুদ, চাল পর্যন্ত নয়, খুদ দিয়ে কিনে নিয়ে ছিল দিদি। যমকে ঠকাতে বাচ্চার মালিকানা বদল। পেঁচোয় পেত বাচ্চাদের। পঞ্চানন শিব ছিলেন বাচ্চাদের রক্ষাকর্তা। তাঁর কৃপায় রক্ষা পাবে বলে বাচ্চার নাম দিত পাঁচুগোপাল। জঘন্য পদার্থের নাম পর্যন্ত দিত, যার প্রতি ঘৃণায় যমরাজের দূতেরা বাচ্চার দিকে নজর দেবে না। এভাবেই গুইরাম, ফেলারাম।  শিক্ষিত বাপ মা হলে নিমাই। নিম যে তেতো। তেতো জিনিসের প্রতি যমরাজের লোভ হবে না হয়তো। বালথাজার নামটা কি বাচ্চা গাধাটাকে দুর্ভাগ্য থেকে বাঁচাতে পেরেছিল?
বাসন্তীবালা ঘরে ঢুকলেন। ও মা, গালে হাত দিয়ে বসে কি ভাবছিস! কাল আমি কি ভয়টাই পেয়ে গেছিলাম রে! কী বাণরাজা বাণরাজা বলছিলি তুই ঘুমের ঘোরে। আর কাঁদছিলি। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে। তুই কেমন করে যেন হেসে বললি, একটা গাধা। তারপর ঘুমিয়ে পড়লি। আমি কেবল শীতলা মাকে ডেকে গিয়েছি। মা যে গাধায় চড়ে জগৎ শাসন করেন। হাতের ঝাঁটায় সব অনাছিষ্টি দূর করে দেন।
শ‍্যামলী মাকে বলল, মা আমার মাথায় কী সব ঠেকাচ্ছ?
বাসন্তীবালা বললেন,  গুরুদেবের প্রসাদী ফুল মা। আর এই সর্বসিদ্ধি কবচ। তোর মামাবাড়ির কাছে শীতলামায়ের মন্দির আছে, মা সেখানে খুব জাগ্রত। আমি মানত করেছি। বাছাকে আমার ভাল রাখো সুবুদ্ধি দাও। কি বলতে কি বলে ফেলেছে, ওকে ক্ষমা করে দাও!
শ‍্যামলী বলল, আশ্চর্য তো! এটা একটা সিনেমার গল্প। রবার্ট ব্রেসঁর জগৎবিখ‍্যাত ফিল্ম। ছেষট্টি সালের মে মাসে রিলিজ হয়েছিল। দস্তয়েভস্কির দি ইডিয়ট গল্প থেকে প্লটটা নেওয়া। শীতলা টিতলা কিচ্ছু না। বালথাজার বলেছিলাম। বাণরাজা নয়। বালথাজার একটা গাধার নাম। সেই গাধাটাকে নিয়ে সিনেমা। শেষে গাধাটা মরে গেল। আর তুমি শীতলার মানত করে বসে র‌ইলে?
বাসন্তীবালা বললেন, বললেই হল? আমাদের স্বপ্নের সব মানে আছে। ওর ভেতর দিয়ে দেবতাদের নির্দেশ আসে। জানিস্ না, অন্নদাঠাকুর আদ‍্যামায়ের স্বপ্ন পেয়েছিল, মা বলছেন, আমি জলের তলায় শুয়ে আছি, আমায় তুলে এনে মন্দির পিতিষ্ঠে কর্। আদ‍্যাপীঠে  বড্ড ভাল ভোগ হয় রে। কতবার তোকে নিয়ে গিয়ে খাওয়াব ভেবেছিলাম। তা তুই যা গোঁয়ার!
শ‍্যামলী হেসে ফেলল, এইসব বুজরুকি কারবার আমি কোনোভাবেই মানব না। স্বপ্ন হল অবচেতন মনের ক্রিয়া। তোমার ভেতরের মন যা ভাবে, তাই তুমি স্বপ্ন দ‍্যাখো। গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখা যায় না। হালকা ঘুমে বন্ধ চোখের পাতার নিচে মণি এদিক ওদিক করতে থাকে। তখন লোকে স্বপ্ন দ‍্যাখে।
বাসন্তীবালা মেয়েকে ধমকে বললেন, বললেই হল? আমি পাঁজির শেষের পাতাগুলোয় স্বপ্ন ফল নিয়ে পড়েছি। স্বপ্নের বিশাল সব মানে আছে। ভোররাতের স্বপ্ন মিথ‍্যা হয় না।
শ‍্যামলী হেসে বলল, যত্তো গাঁজাখুরি কারবার!
শশাঙ্ক পাল শ‍্যামলীর ঘরে এলেন।  বললেন, হ‍্যাঁ রে, কাল রাতে কি করেছিলি? তোর মা ভয়ে অস্থির! আর রাত অবধি অত বকবক কিসের?
এমন সময় সবিতা নিচে রান্না ঘর থেকে শ‍্যামলীকে ডাকলেন, ওরে, তোর বাবার জন‍্যে চা নিয়ে যা। বলে বটে বাবার জন‍্য চা। আসলে চা থাকে তিনজনের জন‍্য। টি পট থেকে চা ঢেলে বাবার দিকে কাপ প্লেট এগিয়ে দেয় শ‍্যামলী। মাকেও। এই চায়ের কাপ প্লেটের সেটটা শ‍্যামলীর প্রাইজ পাওয়া। তাতে করে চা খেতে খেতে সকালটা বাবার ভাল লাগে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শশাঙ্ক জিজ্ঞাসা করলেন, কি রে, কাল তোর মাকে ভয় দেখিয়েছিলি কেন?
শ‍্যামলী বলল, আরে ওটা একটা সিনেমা। ফরাসি ভাষার সিনেমা। ফিওদর দস্তয়েভস্কির দি ইডিয়ট গল্পের থেকে একটুখানি নিয়ে রবার্ট ব্রেসঁ’র ফিল্ম। দুনিয়ার সবসেরা ফিল্মগুলোর একটা ওই অ আজার বালথাজার। ঊনিশ শো ছেষট্টি সালে ফিল্মটা রিলিজ হয়েছিল। দস্তয়েভস্কি দি ইডিয়ট উপন‍্যাসটা লিখেছিলেন আরো একশো বছর আগে।
শশাঙ্ক জানতে চাইলেন গল্পটা কি?
শ‍্যামলী বলল, একটা গাধাকে নিয়ে। অবশ‍্য একটা গাধার জীবনের আদলে আসলে তাবৎ সভ‍্যতার ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন রবার্ট ব্রেসঁ। দেড়টা ঘণ্টার মধ‍্যে এভাবে এতখানি মুন্সিয়ানায় মানুষের জীবনকে তুলে ধরা যার তার কম্ম নয়। এভাবেই অ আজার বালথাজার এর পরিচালকের প্রশংসা করেছেন জাঁ লুক গোদার। তিনি আবার আরেক বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রকার।
শশাঙ্ক পাল বললেন, গাধার গল্প নিয়ে ব‌ইটা?
শ‍্যামলী বলল, বাবা, ব‌ই বোলো না। বলো ফিল্ম।
শশাঙ্ক পাল বললেন, সিনেমার কত নাম, মুভিজ, টকিজ, তুই বলছিস ফিল্ম। আমরা বলি ব‌ই। ব‍্যাপারটা একই।
শ‍্যামলী বলল, বাবা সিনেমা একটা ভাষা। ও শুধু একটা গল্প বলা নয়। একটা কাহিনি থাকতে পারে, নাও পারে, মিউজিক থাকতে পারে, নাও পারে। ক‍্যামেরার খুব বড় ভূমিকা থাকে। থিয়েটারের সঙ্গে ওই একটা বড়ো অমিল।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তাহলে গাধা নিয়ে ভাবছিলি?
শ‍্যামলী বলল, একটা বাচ্চা গাধার নাম বালথাজার। কিন্তু গল্পের ভিতর অনেক মোচড় আছে। মারি নামে একটা মেয়ে, তার বাচ্চা বেলার ভালবাসা। অর্থনৈতিক দুর্বিপাক, তার জন‍্য বন্ধুদের মধ‍্যে দূরত্ব। তারপর কিশোরী অবস্থায় ধর্ষণের শিকার। কিন্তু যে ধর্ষণ করেছে, তার কাছে বারবার ফিরে যাওয়া।
শশাঙ্ক পাল বললেন, এই তোর বিশ্ব সেরা ব‌ই, বালথাজার!
শ‍্যামলী বলল, বাবা ফিল্ম বলো। সর্বকালের অন‍্যতম সেরা ফিল্ম।
শশাঙ্ক পাল ধমকে উঠে বললেন, এইসব জিনিস নিয়ে যে ফিল্ম, তা নিয়ে চর্চা করলে যা হয়, কাল রাতে তোর তাই হয়েছে।
বাসন্তীবালা বললেন, আমি ভয়ে কেঁপে মরি। মেয়ে আমার কুলকুল করে ঘেমে গেছে, চোখ দিয়ে জল পড়ছে। আমি কেবল ঠাকুর নাম করে যাচ্ছি, হে মা শীতলা, ভাল করে তোমার পুজো দেবো মা, মেয়েটার উপর কুদৃষ্টি দিও না।
শ‍্যামলী মায়ের দিকে তাকায়। তার মনে পড়ে পোশাকহীনা একটা মেয়ের কথা। অ্যান উইয়াজেমস্কি অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ওই ফিল্মে অভিনয় করেই গোদারের চোখে পড়ে গেলেন। সাতষট্টি সালেই গোদারের সাথে সংসার পাতলেন। কিন্তু বছর তিনেকের বেশি একসাথে থাকা হল না। সত্তর সাল থেকে আলাদা আলাদা হয়ে থাকা। মামলা চলেছিল অনেক দিন। সেভেন্টি নাইনে কাগজে কলমে পাকাপাকি বিচ্ছেদ।
শশাঙ্ক পাল বললেন, ভাল গল্প পড়্, ভাল সিনেমা দ‍্যাখ্, এইসব অখদ্দে জিনিস নিয়ে পড়ে থাকিস না।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, অ আজার বালথাজার সর্বকালের সেরা একটা ফিল্ম। আমাদের চন্দনা হলে নুন শো তে দেখেছি।
বাসন্তীবালা ধমক উঠলেন, নুন শো দেখেছিস! একথাটা বলতে লজ্জা করল না তোর? একটা মানী লোকের মেয়ে হয়ে নোংরা সিনেমা দেখতে যাস্? শেষ অবধি নুন শো! আর কত নিচে নামবি?
শ‍্যামলীর চোখ গলে জল পড়তে থাকে। বলে, মা, তোমরা বুঝতে পারছ না। নুন শো মানেই খারাপ, এটা ভুল ধারণা!
শশাঙ্ক বললেন, আর বুঝে কাজ নেই। সমস্ত দুনিয়ার নোংরামিতে তোর আগ্রহ। যতো যার কুকীর্তি, তাই চটকে তোর মজা। আমার খুব আশা ছিল তোর উপর। আমার সমস্ত ভরসা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তোকে আমার মেয়ে বলে পরিচয় দিতে আমার ঘেন্না করছে।
শ‍্যামলী টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।