• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৭)

পর্ব – ৭

৭১
একটা মানুষ বলতে কি বুঝি? তার হাত দুটো , আর দুটো পা আছে I আছে নাক,কান, চোখ আর মুখ I খিদে পায় ঘুম পায় কান্না পায় হাসি পায় , আরো কি কি যেন পায়I তাই সবাই বলে নারী পুরুষ সমান I বলে মেয়েকে্ও পুরুষের সমান কাজে সমান বেতন দাও I মেয়েকেও ভোটে দাঁড়াতে দাও I মেয়েকেও পেশায় দাঁড়াতে দাও I এই হল গড় পড়তা নারী পুরুষের সমানাধিকার I
আপনারা শুনুন , সমবেত ভদ্রমণ্ডলী ও মাননীয় বিচারক মণ্ডলী , আপনারা সকলে শুনুন আমি এইটুকু সমানাধিকারের বিপক্ষে I
আচ্ছা, যদি আপনার কাছে একশ টাকা থাকে, আর আমার কাছে একটা মোটে টাকা, তাহলে কি আপনি আর আমি সমান? আমার ওই একটা টাকার বিনিময়ে আপনার একশো টা টাকা আমাকে দেবেন? কেউ কখনো দেয়? কেউ ভাবতে পারে? পারে না তাই না? একশো টাকা আর এক টাকা সমান নয়!
তাহলে, মা হতে গিয়ে মেয়েরা যেভাবে যন্ত্রণা সহ্য করে, যে ধৈর্য দিয়ে সন্তানকে বড়ো করে , জ্বর জ্বালা হলে যে দরদ দিয়ে বাচ্চাকে সামলায় , ভূভারতে তার কোনো তুলনা আছে?
আমার দেশে, আফ্রিকার অনেক দেশে , অনেক গরিব দেশে মা হলে গিয়ে মেয়েরা প্রাণ দেয় I রোজ দেয় I বাচ্চা হতে গিয়ে পুরুষের মৃত্যু হয় নাI হতে পারে নাI ঝুঁকি নেয় কেবল মেয়েটি I এর পরেও বলবেন নারী পুরুষ সমান সমান ? একশো টাকা আর এক টাকা সমান সমান?
গর্ভে একটি শিশু আর মৃদঙ্গের মতো পেট নিয়ে আরো একটি বছর খানেকের বাচ্চাকে পালন করে আমার দেশের অনেক মেয়ে I গর্ভের শিশু মায়ের রক্তে শ্বাস নিচ্ছে, পুষ্টি নিচ্ছে, বেড়ে উঠছে I গর্ভ জলে শিশুর সাঁতার I আর সেই অবস্থায় মা হয়ে দু এক বছরের দুরন্ত বাচ্চার ঝক্কি সামলানো , কাঁথা কানি পালটানো , ছড়া বলে ভুলিয়ে রাখা I আর এত কিছুর পরে সেই বাচ্চার বাবাকেও সামলানো I আমার দেশের একটা মেয়ে একসাথে গর্ভিণী মা, স্তন্যদায়িনী মা, সেবিকা মা, আর বাচ্চার বাবার শয্যাসঙ্গিনী , হ্লাদিনী কামিনী সুখদায়িনী I এর পরেও বলবেন নারী পুরুষ সমান সমান ? একশো টাকা আর এক টাকা সমান সমান?
আমি শ্যামলী পাল, গণিত অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী; আমি নারী পুরুষের এই গড়পড়তা সমানাধিকার – এর বিরুদ্ধে I
আমি বলবো, বিয়ে কবে হবে, বিয়ে হলে বাচ্চা কবে নেওয়া হবে সেই প্রশ্নে, বাচ্চা আদৌ নেওয়া হবে কি না, বাচ্চা একবার হয়ে গেলে দ্বিতীয় বাচ্চা আবার নেওয়া হবে কি না, নিলে কতো দিনের ফারাকে নেবে, সে বিষয়ে কথা বলবার এক্তিয়ার শুধু মেয়েটির থাকা উচিত I নিজের জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা সইতে সইতে যে মেয়ে মা হয়ে ওঠে, নিজের প্রয়োজন, শখ আহ্লাদকে চাপা দিয়ে যে মেয়ে শিশুর জন্যে রাত জাগে, পুরুষের সাথে সমান করে তাকে দেখানো মানে একশো টাকাকে একটাকার সমান বলার অপচেষ্টা I ভদ্রমণ্ডলী ও মাননীয় বিচারক মণ্ডলী , আপনারা আপনার নিজের নিজের মা ঠাকুমা দিদিমায়ের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেবেন I
হাত তালির একটা ঝড় উঠলো নাI সমস্ত হল চুপ I কেবল করবী মিত্র ছুটে এসে শ্যামলীকে জড়িয়ে ধরলেনI কপালে এঁকে দিলেন একটা চুমো I
৭২
যখন বিতর্কের পুরস্কার প্রাপকদের নাম ঘোষণা হল , তখন শ্যামলীর নাম উচ্চারণ করা হল না। করবী মিত্র ফুঁসে উঠলেন । নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলেন শ্যামলী কোন স্থান পেয়েছে । প্রধান বিচারক জানতে চাইলেন তাঁর পরিচয়। করবী মিত্র নিজের পরিচয় দিলে বিচারক বললেন শ্যামলী পাল বিতর্কের বিষয়টাই বুঝতে পারে নি। ওর আলোচনা ধর্তব্যের মধ্যে আসে নি । করবী মিত্র হাঁ হয়ে গেলেন । তাকিয়ে দেখলেন – শ্যামলী হলে নেই । সে কি, কোথায় গেল মেয়েটা !
বাইরে গিয়ে দেখলেন সে মেয়ে কোথাও নেই ।
৭৩
বাবা, এখানে কাঠ চাঁপা কে রেখে গেল?
ওহো, তোকে বলা হয় নি, আজ বিকেলে যে তোর বন্ধুদুটো এসেছিল ।
তাই বাবা। তুমি বলেছো আমি কোথায় গিয়েছিলাম ?
বলেছি বৈকি মা। আরো কি বলেছি জানিস?
কি বলেছো বাবা?
বলেছি, তোমাদের বন্ধু ঠিক ফার্স্ট হবে । কই রে মা, কি প্রাইজ পেলি দেখা?
প্রাইজ পাই নি বাবা।
কি মিছে কথা বলছিস? বিতর্ক সভায় শ্যামলিমা প্রাইজ পায় নি, এমন তো কোনোদিন হয় নি।
বাবা, আজ আমি প্রাইজ পাই নি।
এটা কি রকম ব্যাপার হল , বুঝলাম না তো!
বাবা, হারতে শেখাও একরকম শেখা। হেরে যেতে পারাও একটা পারা। হার মেনে নিতে পারা একটা শিক্ষা ।
শ্যামলিমা, আমি তোর মনের তল পাই না।
৭৪
গা ধুয়ে বইখাতা নিয়ে বসলো মেয়ে । শরীরে ক্লান্তি নামছে । কাঠ চাঁপা ফুলের গন্ধ মাঝে মাঝে আনমনা করে দিচ্ছে। কেন কে জানে!
মুড়ি মেখে নিয়ে এল সবিতা পিসি । শশা , নারকেল, ধনেপাতা, পেঁয়াজ আর লঙ্কা কুচি দিয়ে চমৎকার মাখতে জানে সবিতা পিসি । কানে কানে বললো – শ্যামলিমা, আজ তোমার তারা এসেছিল।
হুম, বাবা বলেছে।
এর মধ্যেই শুনে ফেলেছিস?
হাসলো সে।
হ্যাঁ রে, ওদের মধ্যে কাকে ভালোবাসিস ?
মুহূর্তে মন খারাপ হয়ে গেল শ্যামলিমার। একটি উপোসী নারী তার সামনে দাঁড়িয়ে । বাল বিধবা এই নারীর পুনর্বাসন হল না কেন?
৭৫
সে একবার ভেবেছিল মেশিনকে ভালোবাসবে। আর একবার ভেবেছিল হিসেবকে ভালোবাসবে। কিন্তু অঙ্ক করতে গিয়ে দেখল অঙ্ক সবার সেরা। অঙ্কের মধ্যে বিশুদ্ধ যুক্তি খেলা করে ।
পায়ের শব্দ শুনে বুঝলো বাবা এসেছেন।
তোকে কতোদিন বলেছি চেয়ার টেবিলে বসে পড়বি । বিছানায় ঝুঁকে ও কি রকমের পড়া ?
বাবা, টেবিল চার পেয়ে হয়, আবার তেপেয়েও হয় । কোন রকমটা ভালো ?
টেবিল ত টেবিল। চার পেয়ে আর তেপেয়ে তে পড়ার কি তফাত হয়? লোকে চারপেয়ে টেবিলেই পড়ে লেখে দেখেছি ।
না বাবা, আমার প্রশ্ন , টেবিল চার পেয়ে বানাতে বেশি সুবিধে, না তে পেয়ে ?
জানি না বাপু । তুমি টেবিলে বসে পড়লে খুশি হই, বুঝেছো ?
বাবা টেবিলে বসবো, না চেয়ারে বসবো ?
তুই খুব ভালো জানিস, তুই বাবার কোনো কথাই শুনবি না, বিছানাতেই বসবি ।
হ্যাঁ বাবা, এই বিছানার চাইতে আরাম আর নেই ।
যা পারিস কর। এই তোর লেবারগুলো বাড়ি বাড়ি ঘুরে টাকা মেগে এনেছে । ওর থেকে আমি ওদের কিছু কিছু দিয়েছি । লিখেও রেখেছি । গুণে গেঁথে রাখ ।
মেগে এনেছে বলছো কেন বাবা? এটা আমাদের পাওনা টাকা। আমাদের দাবী ।
৭৬
রাত্রি ন’টা নাগাদ বাড়িতে পুলিশ এলো । সবিতা পিসি দৌড়ে এসে কানে কানে তাকে লুকিয়ে পড়তে বললো । পুলিশ অফিসার শ্যামলীকে খুঁজছে । শ্যামলী এগিয়ে গেল । সবিতা পিসি দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে ।
“ হ্যাঁ বলুন, কাকে খুঁজছেন আপনি?”
“ অ্যাই , শ্যামলী পাল তোর কে হয় ? বল শিগগির!”
“আমার কেউ আত্মীয় হয় না ।“
“অ্যাই মেয়েটা , একদম বাজে কথা বলবি না। আমার কাছে ডেফিনিট খবর আছে । এ বাড়িতেই থাকে । ইনফরমার বলেছে ।“
“আমার কাছেও ডেফিনিট খবর আছে। শ্যামলী পাল নামটা আমার। তো আপনার জন্যে কি করতে হবে?”
“তুই শ্যামলী পাল ?”
“হ্যাঁ , কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো ?”
“চল তোকে এখনি থানায় যেতে হবে । বাড়িতে আর কে আছে?”
“আমিই আছি । কিন্তু কি সমস্যা আপনার , সেটা তো বলবেন ?”
থানায় গেলেই টের পাবি সব । চল এখনি ।
সে তো যাবো , কিন্তু আপনার মেয়ে পুলিশ কই?
ইয়ারকি হচ্ছে? লোকের থেকে মাল নিয়ে টাকা শোধ করিস না । আবার মেয়ে পুলিশ চাই ?
“অফিসার, ইয়ারকি তো মশাই মারছেন আপনি। রাত বিরেতে ভদ্রঘরের মেয়েকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন, না এনেছেন মহিলা পুলিশ, না এনেছেন ওয়ারেন্ট । কি ভেবেছেন নিজেকে ?”
প্রতিরোধের মুখে পুলিশ অফিসার একটু থমকে যায় । বলে – “ওয়ারেন্ট দেওয়া হবে কাল ।“
“না, ওটা নিয়ম নয়। তা ছাড়া সন্ধ্যের পর মেয়েদের অ্যারেস্ট করা যায় না। কোন স্কুলে পড়েছেন আপনি?”
পুলিশ অফিসার ঘাবড়ে যায় ।
“একজন ভদ্রমহিলার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, সেই শিক্ষা হয় নি দেখছি! কি হল, কোন স্কুলে পড়েছেন আপনি? নাগরিকের করের টাকায় দেশ চলে । সরকার চলে। সেই করদাতাকে তুই তোকারি ? কোন স্কুলে এসব অভদ্রতা শেখায় বলতেই হবে আপনাকে !”
অফিসার পিছোতে শুরু করে ।
“এর পরে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলে ভদ্রভাবে কথা বলা অভ্যেস করবেন।“
পুলিশ অফিসার মাথা নিচু করে পালাতে পথ পায় না।
দরজার আড়াল থেকে সবিতা পিসি বেরিয়ে আসে । হাতে তার দরজার খিল। বামুন মা এসে বলে আঁশ বঁটিটা আনবো ?
শ্যামলী পিসিকে ধমক লাগায় “ এ কি, তোমরা এগুলো কি করছো ? এভাবে হয় না। তুমি হাতে লাঠি তুললে ও পিস্তল বাগাবার মওকা পেয়ে যাবে । ওই সুযোগ দিও না। লড়াই হবে চোখে চোখ রেখে, যুক্তির ভাষায় ।“
৭৭
চেনা নম্বরটায় ডায়াল করলো শ্যামলী । অচেনা একটা মহিলা কণ্ঠ ফোন ধরলো । শ্যামলী বললো আমি অরিন্দম দাশগুপ্তের সাথে কথা বলতে চাই । মহিলা কণ্ঠ জানতে চাইলো “ অরিন্দম দাশগুপ্ত ?”
“ হ্যাঁ মাদাম, আপনি ঠিক শুনেছেন , আমি অরিন্দম দাশগুপ্তের সাথে একটু কথা বলবো।“
“ কিন্তু এখন কতো রাত হয়েছে জানেন ? আপনাদের জ্বালায় কি অরিন্দম একটু বিশ্রাম নিতেও পারবে না?”
“ মাদাম, আমি নিতান্ত দরকারে পড়ে ফোন করছি । অরিন্দম বাবুকে কাইণ্ডলি একটু…।“
“ হ্যালো , অরিন্দম বলছি ।“
“ স্যরি, অসময়ে ফোন করেছি। না করে উপায় নেই বলে ।“
“ রাগ কোরো না শ্যামলী, শিঞ্জিনী আমার কাজিন সিস্টার। নিজেকে ও আমার গার্জিয়ান মনে করে । বলো কি হয়েছে।“
“ উনি তো কিছু ভুল বলেন নি। রাত তো সত্যি অনেক বেশি হয়েছে । কিন্তু আপনাকে না জ্বালিয়ে তো পারছি না।“
“বাজে বোকো না শ্যামলী। তোমার একটা ফোন পেলে সেদিনটা সার্থক হয়ে যায়। বলো কি করতে হবে। ওর কথায় কিছু মনে কোরো না।“
“আমাদের বাড়িতে আজ পুলিশ এসেছিল ।“
কেন ? কি হয়েছে?
আমায় ধরে নিয়ে যেতে চাইছিল ।
একথা সে কথা বলে কোনোমতে রাতটুকুর জন্যে ভাগিয়েছি। মনে হয় কাল সকালে এসে হাতে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবে ।
ইশশ, বললেই হল? কি করেছো তুমি, যে হাতে দড়ি পরবে?
পুলিশটা যে সে কথাটা বলতেই পারলো না। কি অদ্ভুত দেশ আমাদের । রাত বিরেতে একটা মেয়েকে থানায় যেতে বলছে, মহিলাকে অ্যারেস্ট করতে মহিলা পুলিশ আনার কথা মাথায় আনে নি । সন্ধ্যের পর আর ভোর হবার আগে মেয়েদের অ্যারেস্ট করা যায় না সেটুকু অবধি জানে না।
ওয়ারেন্ট দেখিয়েছে ?
“না, না, কোনো কিছু আনে নি। আর কি বিশ্রি তুই তোকারি করে কথাবার্তা।“
“আচ্ছা শ্যামলী, কোন থানা থেকে এসেছিল বলতে পারবে?”
“কি জানি, কোন থানা ।“
“আচ্ছা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো । আমি এখনি থানায় যাচ্ছি ।“
“সে তো আমি জানি, আমি বিপদে পড়েছি আপনি এটা জানলে যতো রাত হোক, না বেরিয়ে পারবেন না। কিন্তু বাড়িতে বকুনি খাবেন না তো?”
“শ্যামলী, অভিমান কোরো না। তোমার অভিমান সাজে না।“
৭৮
টেলিফোনের টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে মেয়ে । শশাঙ্ক পাল এসে শ্যামলীর মাথায় হাত রাখেন । বলেন – “ তোর জন্যে আমার গর্ব হয় শ্যামলিমা।“
দরজার বাইরে থেকে ফুট কাটে শান্তনু – “ হ্যাঁ , মেয়েকে আরো লাই দাও। যতো পারো লাই দাও । কলেজে পড়ছে বলে হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে। যতো রাজ্যের চ্যাংড়া ছেলেকে বাড়িতে বসতে দাও। মেয়ে তোমার উচ্ছন্নে গেছে । পুলিশ আসবে না তো কি?”
মা বললো “ শান্তু, তুই এমন বলছিস, যেন তুই বোনকে ধরিয়ে দেবার জন্যে নিজেই পুলিশ ডেকে এনেছিস। “
“ তাই উচিত ছিল মা, এমন ধিঙ্গি মেয়েকে পুলিশে দেওয়াই উচিত ছিল। দিন নেই রাত নেই বাইরের ছেলেদের সাথে হ্যা হ্যা হি হি করছে । লাজলজ্জার মাথা খেয়ে সবার সামনে হাতে হাত নিয়ে খেলা করছে । তলে তলে আর যে কি কি করছে, আমি কি দেখতে গেছি? “
মা বাবার ওপর ঝাঁজিয়ে ওঠেন “ শুনছো, শান্তুর কথাটা শোনো একবার। সেদিন বীরুর পয়সায় নেশা করে এসে দু ভাই মিলে বোনটাকে পেটালো । সেদিন তুমি কিছু বলো নি। আজ কি বিশ্রি ইঙ্গিত করছে। তুমি শুনেও শুনছো না। ওরা যে মেয়েটাকে মেরে ফেলবে আমাদের চোখের সামনে !”
শশাঙ্ক পাল মাথা নিচু করে থাকেন। তাঁর চোখ থেকে বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা একটা একটা করে লাল মেঝেতে পড়তে থাকে ।
৭৯
খেতে ইচ্ছে করছিল না শ্যামলীর । সবিতা পিসি কাছে এসে দাঁড়ালো ।
“ওরে এই পেটটাই তো আসল শয়তান । আমার বর যখন মরে গেল, শ্বশুরবাড়ির সকলে উঠে পড়ে লাগল যে আমায় তাড়িয়ে দেবে । আমি ছোটো মেয়ে তখন । কড়ে রাঁড়ি । নিজের ভালো বুঝি না। বাপের বাড়ির লোকেরা আসে না। খবর নেয় না। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তার পর হয়ে গেল। তখন তারা মরলো কি বাঁচল সে ভাবনা বাদ দিয়ে দেয় বাপের বাড়ির লোক। আমি সকালে সারাক্ষণ খুড় শাশুড়ি , পিস শাশুড়িদের পায়ে পায়ে ঘুরতুম । আসলে সাথে সাথে থাকতুম। আর রাত হলে দারুণ একটা ভয় চেপে বসতো আমার। যে কেউ আমায় নষ্ট করে দেবে। দোর খুলে বেরোতুম না। রাতে নিশি ডাকে । কতো রকম বাও বাতাস বয় । মেয়েমানুষকে হাতছানি দেয় । জল সরতে গেলে বাইরে যেতে হয় । জল সরে পা না ধুয়ে ঘরে ঢোকো, অমনি হয়ে গেল। তখন তোমার দফা রফা। আমি ভয়ে জল খেতুম না রাতে। ভয়ে ভয়ে থাকতুম। বাড়িতে পুরুষ অনেক । আর পুরুষদের থেকেই ভয় বেশি । পুরুষ মানুষ সোনার আংটি । তার লয় ক্ষয় নেই । কিন্তু মেয়েমানুষ নষ্ট হয়ে গেলে তার আর ঘরে দোরে ঠাই হয় না রে ।“
পিসি নিজের মনে বকে যেতে থাকে ।
৮০
ঝন ঝন করে ফোন বেজে উঠলো । যে কোনো সময় ফোন আসবে জেনে পাশেই বসে ছিল শ্যামলী । আগ্রহ ভরে তুলতেই বামা কণ্ঠে একটা ধমক ।
“কে বলুন তো আপনি? আপনার ফোন পেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো অরিন্দম?”
শিঞ্জিনী ফোন করেছেন। অরিন্দমের নির্দেশ মনে আছে শ্যামলীর । শিঞ্জিনী ওদের বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয় । তার কথার উপর অভিমান করতে বারণ করেছেন অরিন্দম।
“কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন না না কি? কে আপনি, কি পরিচয়?”
“ আমি শ্যামলী পাল । আমি একটা খুব সাধারণ মেয়ে।“
“ হ্যাঁ, আপনি সাধারণ না অঘটন ঘটন পটীয়সী , তা খুব ভালো বুঝতে পারছি । আপনি তু করে ডাকলেন আর অমনি অরিন্দম খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেল । আধ ঘণ্টা হয়ে গেল, এখনো ফেরে নি। কি ভেবেছেন কি আপনি?”
কি জবাব দেবে ভেবে পায় না শ্যামলী । রাগ সে কিছুতেই করবে না। তার ফোন পেয়ে অরিন্দম বেরিয়ে পড়েছে – এতে তার যেমন গর্ব হচ্ছে, তেমনি ভয় করছে এ ঘটনার জন্যে শিঞ্জিনী যদি অরিন্দমকে খারাপ কথা শোনায় …
শ্যামলী বলে ‘ স্যরি মাদাম, আমি বড়ো বিপদে পড়ে ফোন করেছি।“
“হ্যাঁ , স্যরি বললেন, আর সাত খুন মাফ হয়ে গেল । রাবিশ কোথাকার!”
ফোনটা নামিয়ে রাখে শ্যামলী । সংস্কৃতিবান মানুষ নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, কিন্তু হেয় প্রতিপন্ন হতে দিতে পারে না। টের পায় রগের শিরা দিয়ে মাথায় রক্ত ছুটছে ।
৮১
ঘুমের মধ্যে দেখা হল অরিন্দমের সঙ্গে । হাসছেন অরিন্দম। “পুলিশ তোমার কিছুই করতে পারবে না । আমি ভালো উকিল যোগাড় করবো ।“ শ্যামলীর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না । শুধু অরিন্দমের বন্ধুত্বভরা দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল। আর সমস্ত রাস্তাটা ম ম করছিল কাঠ চাঁপার গন্ধে ।
সহসা ঘুম ভেঙ্গে দেখলো গা তার জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । এ কি! জ্বর এলো কেন? চোখটাও জ্বালা করছে। সে কি ঘুমের ঘোরে কেঁদেছে ? ভাবলো স্নান করে নেবে । জ্বর এলে স্নান করা ভাল। তাপহরা। ঝাঁঝরি কলের নিচে দাঁড়ালো সে ।
অরিন্দম, বন্ধু আমার, তুমি কি থানায় যেতে পেরেছিলে? আমার জন্যে তোমায় বাড়িতে হেনস্থা হতে হয় নি তো?
স্নান সেরে মাথা মুছতে মুছতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো মেয়ে । আকাশে তখন ঝক ঝক করছে অনেক অনেক তারা।
৮২
ভোর থেকেই পড়তে বসে গেল শ্যামলী । কাল কলেজ যাওয়া হয় নি । আজ যেতে হবে । কিন্তু অরিন্দম থানায় গেলেন কি না জানতে না পেরে তার ভেতর উদ্বেগ বাড়ছিল । খানিকবাদে বাবার ঘরে চা পৌঁছেছে কি না উঁকি মেরে দেখতে এসে দেখতে পেল অরিন্দম গল্প করছেন তার বাবার সঙ্গে ।
আরে, আপনি ? এতো সকালে?
রাতে তো তুমি নিশ্চয় ঘুমাতে পারো নি । সকালে না এসে খবর দিলে তুমি আমায় ক্ষমা করতে?
তা যা বলেছেন ! আমার খুব চিন্তা হচ্ছে ।
শশাঙ্ক পাল জানতে চাইলেন – পুলিশের কাছে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগটা কি?
অরিন্দম বললেন – সেই ব্যাপারটা কোর্টে গিয়ে জানতে হবে। আপাততঃ বেল নিতে হবে । আমি ব্যবস্থা করে নিয়েছি।
আমায় বেল নিতে হবে কেন?
কেননা তোমার অপরাধটা জামিনযোগ্য অপরাধ !
কি আশ্চর্য ! কি অপরাধ, সেটা কেউ বলে না, আর সেই না জানা অপরাধের জন্যে বেল নিতে হবে?
বেল নিতে গেলে তো শুনেছি অনেক টাকা দিতে হয় ।
ঠিক শুনেছেন। কিন্তু আদালতকে বিশেষ কিছু দিতে হয় না। নামমাত্র খরচ।
তা হলে কে টাকা নেন ?
আদালত যে নেন না, প্রশাসন যে নেন না, এটা জেনে রাখুন।
তাহলে রইলো বাকি … আচ্ছা, অরিন্দম , তুমি যে জামিনের ব্যবস্থা করেছো, তার জন্যে আমায় কি দিতে হবে?
আপনি দেবেন কেন? যা দেবার শ্যামলী দেবে।
ও ছোটো একটা মেয়ে, ছাত্রী, টাকা ও পাবে কোথায় । ওর বাবাকেই দিতে হবে।
বাবা জানো, জাস্টিস মোল্লা তাঁর একটি রায়ে বলেছিলেন, পুলিশ এদেশের সবচেয়ে সংগঠিত গুণ্ডাবাহিনী ।
শ্যামলী দুরন্ত ক্ষোভে বলে ওঠে ।
তুমি ওই রায়টা পড়েছ?
ন্নাঃ , পড়ি নি। কোথায় যেন ওই কথাটা উদ্ধৃত করেছেন কেউ ।
আর তুমিও সেইটুকুই বলে দিলে ।
বাহ , যেটা নিজে টের পেলাম, সেটা বলবো না?
পুলিশকে গুণ্ডা বলে তুমি রেহাই পাবে শ্যামলী ?
৮৩
কলেজে যাবে ঠিক করলো শ্যামলী। কলেজের কাছেই মহকুমা আদালত । বাসে দুটো স্টপেজ । এগারোটার আগে কোর্ট বসবে না। উকিলের সেরেস্তায় গিয়ে তাকে এক মহিলা উকিলের সাথে কথা বলতে হবে। অরিন্দম বলেছেন শ্যামলীর জন্য টাকা লাগবে না। জামিন নিতে যে টাকা লাগে বলে শোনা যায়, তা আদালতকে দিতে হয় না। তাহলে টাকা কার পকেটে যায়? শ্যামলী স্পষ্ট করে জানতে চেয়েছিল । অরিন্দম সবটা ভাঙ্গেন নি।
প্রথম ক্লাসের পরেই প্রিন্সিপাল মাদাম শ্যামলীকে ডেকে পাঠালেন । শ্যামলী সরাসরি তাঁর চেম্বারে গিয়ে দেখলো আরো কয়েকজন শিক্ষিকা টেবিল ঘিরে বসে আছেন ।
ম্যাম, আমায় ডেকেছিলেন।
হ্যাঁ , কাল বেকাফেস্টে আমাদের কলেজের মেয়েরা নাচে আর আবৃত্তিতে প্রাইজ এনেছে শুনেছ?
শুনেছি ম্যাম।
ওদের আমরা কলেজের মুখ উজ্জ্বল করার জন্যে পুরস্কৃত করবো।
সে তো খুব ভালো কথা ম্যাম।
শোনো, তোমার বলাটাও খুব ভাল হয়েছিল। করবী বাড়ি ফিরেই আমায় ফোন করে ডিটেলে সব বলেছে। তোমার পারফরমেন্সে আমরা গর্বিত । তোমার এই ভালো বলাটাকে আমরা সেলিব্রেট করবো ।
ম্যাম, এটা মনে হয় ঠিক হবে না।
কি ঠিক হবে না?
ম্যাম, আপনি যারা প্রাইজ পেয়েছে, ওদের পুরস্কৃত করুন। যে পায়নি, তাকে আর বিড়ম্বনায় ফেলা কেন?
না, তোমার বলাটা খুব ভালো হয়েছে। আমি চাই ওটা তুমি বক্তৃতা আকারে আমাদের অনুষ্ঠানে আবার বলো।
বিতর্ক সভায় বক্তব্য প্রতি বক্তব্যের ঘাত প্রতিঘাতে স্বতঃ স্ফূর্ত ভাবে যা বলেছি, সেটা আনন্দ অনুষ্ঠানে খামকা বললে ভারি বেমানান লাগবে। কেমন যেন যাত্রাপালার মতো শোনাবে। ওটা বিতর্ক সভায় বলে ফেলেছি। ওখানেই শেষ ।
প্রাইজ পাও নি বলে রাগ কোরো না শ্যামলী ।
না ম্যাম, রাগ করার প্রশ্নই নেই । এখন আমার মনে হচ্ছে , আমার বক্তব্যটা পুরস্কৃত না করে ওঁরা কোনো বেমানান কাজ করেন নি। পৃথিবীতে মা হওয়াটাই তো মেয়েদের একমাত্র পরিচয় নয় । শারীরিক ভাবে মা না হয়েও তো মা হওয়া যায় । আর কোনো ভাবেই মা না হয়েও মাতৃত্বভাবে ভাবিত হয়েছেন অনেক মানবী । আমার বলার মধ্যে সবটা ঠিক ছিল না। মাতৃত্ব ছাড়াও নারীর বহুমাত্রিক অস্তিত্ব আছে।
তাহলে আমার অনুরোধ তুমি রাখছো না?
ম্যাম, অনুরোধ বলছেন কেন? বলুন নির্দেশ।
নামে কি এসে যায় শ্যামলী । কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধের কোনো দাম নেই তোমার অহমিকার কাছে। তাই না?
না মানে, আমার মনে হয়, আমার ব্যাপারটা বাদ দিন।
আচ্ছা তুমি যেতে পারো। আর শোনো …
হ্যাঁ ম্যাম।
ক্লাস করাটা বাদ দিয়ো না। সেটা খুব যুক্তিসংগত কাজ নয়।
মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল মেয়ে। করিডর থেকে শুনতে পেল কেঊ মন্তব্য করলেন “ মেয়েটা বড্ডো পেছন পাকা।“
টয়লেটে ঢুকে ঘাড়ে মুখে অনেকটা জল দিল শ্যামলী।
আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো “ তুমি দীক্ষা দিয়েছিলে, আমি তাই নির্জন রাখাল… “ তার পর নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে ঠোঁট টিপে একটু হাসলো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।