শিক্ষকেরা তখনো কেউ কেউ টিচার্স রুমে বসেছিলেন। । করবী মিত্র ছাত্রীদের খাতা দেখছিলেন। শিক্ষকের পিছন পিছন শ‍্যামলী টিচার্স রুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে র‌ইল।
শিক্ষক বললেন, কি রে, বোস্। শ‍্যামলী বসল না। করবী চোখ তুলে শ‍্যামলীকে দেখে বললেন, হাঁ করে ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয়।
করবীকে তাঁর সহকর্মী শিক্ষক বললেন, দাঁড়াও, তোমার কাছে ও যাবে পরে, এখন আমি ওর কাছে গল্প শুনব। এই বলে শিক্ষক শ‍্যামলীকে বললেন, কি রে, দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বোস্। শ‍্যামলী মৃদু হেসে বলল, না, এগুলো শিক্ষকদের বসার চেয়ার। আমি বসতে পারি না।
করবী মিত্র তাঁর সহকর্মীকে বললেন, শ‍্যামলী তোমাকে এখন গল্প বলবে? কী গল্প?
শ‍্যামলী বলল, গল্পটা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ আর শ্রীনিবাস রামানুজনকে নিয়ে।
করবী বললেন, আমি কেন বাদ যাব, আমিও শুনব। অন‍্য জনা তিনেক শিক্ষক ছিলেন, তাঁরা শ‍্যামলীর দিকে তাকালেন।
শ‍্যামলী বলল, প্রশান্ত মহলানবীশ আর রামানুজন এক‌ই সময়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। আমাদের গল্পটা ১৯১৪ সালের একেবারে শেষের দিকে। ডিসেম্বর মাসে। রামানুজন জন্মেছিলেন ১৮৮৭ তে, বাইশে ডিসেম্বরে। তাহলে তখন তাঁর বয়স সাতাশ বছর। আর মহলানবীশ জন্মেছিলেন ১৮৯৩ এর জুন মাসের শেষে ঊনত্রিশ তারিখে। তাহলে তাঁর বয়স একুশ বছর।
করবী বললেন, হ‍্যাঁ বুঝলাম, ১৯১৪তে দুজনেই ইয়ং। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শ‍্যামলী, তুই আসল গল্পে ঢোক্।
শ‍্যামলী বলল, না ম‍্যাম, এই গল্পটা বলতে গেলে রামানুজনের বয়সটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাতাশ বছর বয়সের রামানুজনের সাথে যখন বছর একুশের মহলানবীশের গণিত নিয়ে আড্ডা হচ্ছে, তার অল্প কয়েকটি মাস আগে এপ্রিলের ১৪ তারিখে রামানুজন সবে বিদেশের মাটিতে পা রেখেছেন।
দেশে স্কুল পর্যায়ে রামানুজন চমৎকার ছাত্র। কিন্তু কলেজে গিয়ে তাঁর গণিত ছাড়া কোনোকিছু পড়তে জানতে বুঝতে ভাল লাগে না। গণিত ছাড়া সব সাবজেক্টে ফেল। তাই কলেজের ডিগ্রি মেলে নি। আর প্রশান্ত শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান। রামানুজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান, আবার সে পরিবার অত‍্যন্ত প্রাচীনপন্থী গোঁড়া হিন্দু।
এদিকে ১৯১৪ সালের জুলাই মাসের শেষে আঠাশ তারিখে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার বেধে গিয়েছে। অস্ট্রো হাঙ্গারিয়ান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আর্চ ডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ আর তার ব‌উ সোফিকে গুলি করে মেরে দিয়েছে সার্বিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদী খুনে গ‍্যাভরিলো প্রিনসিপ। তারিখটা ছিল আঠাশে জুন, ১৯১৪।
করবী মিত্র বললেন, শ‍্যামলী, তুই অঙ্কের গল্প বলছিস, না ইতিহাসের ?
 শ‍্যামলী বলল, অঙ্কের গল্প ম‍্যাম। কিন্তু রসটা পেতে গেলে ইতিহাসের প্রেক্ষিতটা মনে রাখছি।
তো ওই খুনের ঘটনায় দেশে দেশে স্বার্থের সংঘর্ষ চরমে উঠল। জুলাই ক্রাইসিস এর মধ‍্য দিয়ে জুলাইয়ের আঠাশে বেধে গেল যুদ্ধ।
দূর থেকে একজন শিক্ষক ফুট কাটলেন, হ‍্যাঁরে শ‍্যামলী জোড়া খুনের ঘটনায় যদি বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে, তাহলে ইন্দিরার খুনে কি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হবে?
শ‍্যামলী সে কথায় কান না দিয়ে বলল, তো এই যুদ্ধ চার চারটে বছর, তার উপর তিনটে মাস, আর দু সপ্তাহ ধরে চলে, ১৯১৮ সালের নভেম্বরের এগারো তারিখে শেষ হবে।
করবী বললেন, যুদ্ধের কথাগুলো গল্পটা থেকে বাদ দিয়ে আসল জিনিসটা বল্ না।
শ‍্যামলী বলল, এই ১৯১৪ সালে সবেমাত্র কয়েক মাস কেম্ব্রিজে পৌঁছে হাইলি কম্পোজিট নাম্বার নিয়ে রামানুজন ভাবনা চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন। এই নামটা তিনি দিয়েছেন ১৯১৫তে। এই বিষয়েই কেম্ব্রিজ থেকে উনি  ১৯১৬ সালের মার্চে বি এস সি ডিগ্রি পান। এটাকেই পরে পিএইচডি বলে ধার্য করা হয়।
কম্পোজিট নাম্বার নিয়ে ওঁর সন্দর্ভ লণ্ডন ম‍্যাথমেটিক‍্যাল সোসাইটির প্রসিডিংসে ছাপা হয়। তার সুবাদেই ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে রামানুজন ওই লণ্ডন ম‍্যাথমেটিক‍্যাল সোসাইটির সদস‍্যপদ পান। নম্বর থিওরি নিয়ে কাজ করে ১৯১৮ সালের মে মাসে তিনি রয়‍্যাল সোসাইটির ফেলো হন, আর ওই ১৯১৮ র অক্টোবরে তিনি ট্রিনিটি কলেজের ফেলো হন। ১৯২০র এপ্রিলে রামানুজন মারা যাবেন।
করবী শ‍্যামলীকে ধমক দিলেন, মহলানবীশের সাথে রামানুজন এর ইন্টার অ্যাকশনটুকু বল। ইতিহাসের ব‍্যাখ‍্যান থামা।
শ‍্যামলী মৃদু হেসে বলে চলল, তো এই যুদ্ধের পরিবেশে জার্মান বাহিনী বেলজিয়ামের লুভ‍্যাঁয় একটা ভাল লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেয়। যুদ্ধ বাধলে সব সময়ই ব‍্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। তবুও লুভ‍্যাঁয় অতো সমৃদ্ধশালী লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেওয়ায় সারা পৃথিবীর নানা দেশে শিক্ষিত সমাজ ধিক্কার দিতে থাকে।
এই সময় একটা ম‍্যাগাজিন বের হত। তার নাম স্ট্র‍্যাণ্ড। ওই স্ট্র‍্যাণ্ড ম‍্যাগাজিনে পারপ্লেকসিটি নামে একটা সেকশন থাকত, যাতে বুদ্ধিদীপ্ত ধাঁধা দেওয়া থাকত। ম‍্যাগাজিনটা রামানুজন রাখতেন। মনে রাখতে হবে, ১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে, যে সময়টাতে মহলানবীশের সাথে রামানুজনের ইন্টার অ্যাকশনের কথা বলছি, সে সময়, ওঁর প্রতিভার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে নি।  মহলানবীশ রামানুজনের মেধা ও মনীষার অসাধারণ উচ্চতা নিয়ে সুনিশ্চিত নন। রবিবার দেখে মহলানবীশ রামানুজনের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে যেতেন। একদিন মহলানবীশ অমন গিয়েছেন। রামানুজন পাশের ঘরে নিজের রান্না করছেন।
 পড়ার টেবিলে স্ট্র‍্যাণ্ড ম‍্যাগাজিনের ডিসেম্বর সংখ‍্যাটা রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে সদ‍্য এসেছে ম‍্যাগাজিনটা। রামানুজনের ছুঁয়ে দেখা হয় নি।
মহলানবীশ ওই ডিসেম্বর ১৯১৪র স্ট্র‍্যাণ্ডের পারপ্লেকসিটি সেকশনটি খুলে একটি ধাঁধা দেখতে পেলেন।
লুভ‍্যাঁয় ওই যে লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিয়েছিল জার্মান বাহিনী, তার প্রেক্ষিতে একটা ধাঁধা সেখানে ছিল।
করবী বললেন, এবার দয়া করে অঙ্কের ধাঁধাটা বলো।
শ‍্যামলী বলল, লুভ‍্যাঁর ঘটনাটা টেনে ধাঁধারু বলছেন, আমাদের পাড়ায় সব বাড়িগুলো রাস্তার একধারে, আর এক থেকে শুরু করে পর পর এন সংখ্যক বাড়ি আমাদের পাড়ায় রয়েছে। বাড়ির নম্বরগুলি পর পর সাজানো। এর মাঝখানে এমন একটা বাড়ি এক্স রয়েছে, যে বাড়িটির বামদিকে থাকা বাড়িগুলোর নম্বরের যোগফল ওই বাড়ির ডানদিকে থাকা বাড়িগুলোর নম্বরের যোগফলের সমান। এখন, আমাদের পাড়ায় বাড়ির সংখ‍্যা বা এন যদি ৫০ থেকে ৫০০  অবধি বিস্তৃত হয়, তাহলে এন এবং এক্স এর মান নির্ণয় করো।
এটা একটা বাইভ‍্যারিয়েট প্রবলেম আর এর অনেকগুলো সমাধান হ‌ওয়া সম্ভব। তুখোড় ছাত্র মহলানবীশ মনে মনে ধাঁধাটির একটি সমাধান করে ফেললেন। তিনি এন এর মান নির্ণয় করলেন ২৮৮ আর এক্স এর মান নির্ণয় করলেন ২০৪।
রামানুজন পাশের ঘরে রান্নার কাজে ব‍্যস্ত ছিলেন। তাঁর বুদ্ধি শুদ্ধি যাচাই করার আগ্রহ নিয়ে মহলানবীশ তাঁকে ধাঁধাটার সমাধান জিজ্ঞাসা করলেন।
রামানুজন রান্না করতে করতেই পাশের ঘর থেকে মহলানবীশকে বললেন, উত্তরটা বলছি, লিখে নাও।
রামানুজন উত্তর হিসেবে একটি কনটিনিউড ফ্র‍্যাকশন উল্লেখ করলেন। অদ্ভুত বিষয়টা হল, রামানুজনের পদ্ধতিটি এধরনের সমস্ত রকম সমস্যার সমাধানে কাজে লাগে। রামানুজনের উত্তর মহলানবীশকে আশ্চর্য করে দিল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এই সমাধানে পৌঁছলে কি করে?
রামানুজন তাঁকে আশ্চর্য করে বললেন, যেই মাত্র আমি ধাঁধাটা শুনেছি, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে গিয়েছি যে ওর উত্তরটা একটা কনটিনিউড ফ্র‍্যাকশন হবে। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কোন্ কনটিনিউড ফ্র‍্যাকশন? সঙ্গে সঙ্গে এই উত্তর আমার মনে ভেসে উঠল। শুনে মহলানবীশ অবাক হয়ে গেলেন।
 করবী জানতে চাইলেন, শ‍্যামলী এ গল্প কি করে জানতে পারল।
শ‍্যামলী বলল, শিয়ালি রামামৃত রঙ্গনাথনের একটি ব‌ই পড়েছি, “রামানুজন: দি ম‍্যান অ্যাণ্ড দি ম‍্যাথেমেটিশিয়ন”। ১৯৬৭ সালে এশিয়া পাবলিশিং হাউস বের করে। এই রঙ্গনাথন‌ও এক বিরাট মাপের লোক। ১৮৯২ এর বারো আগস্ট রঙ্গনাথন জন্মেছিলেন। তাঁর জন্মদিনটা আমরা জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে পালন করি।
 করবী জানতে চাইলেন, শ‍্যামলী তুই কি সত‍্যি সত‍্যি ভাবিস, শুধু একবার মাত্র  শুনেই এমন জটিল অঙ্কের সমাধান সম্ভব?
শ‍্যামলী বলল, জিনিয়াস আর ট‍্যালেন্টেডদের তফাৎ ওইখানে। আপনার ভাবতে ভাল লাগবে যে, ১৯৬৮ সালে মহলানবীশ রামানুজন স্মারক স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
এমন সময় কলেজ প্রিন্সিপাল টিচার্স কমনরুমে এসে চিৎকার করে বললেন, ক্লাস কখন শেষ হয়ে গেছে, তোমরা এখানে শ‍্যামলীকে নিয়ে গজালি করছ? স্টাফেরা কি ছুটি পাবে না? তাঁর ভঙ্গি দেখে শ‍্যামলীর মুখটা ব‍্যথায় ম্লান হয়ে গেল।