দরকারি কাগজপত্র পরীক্ষা করতে ব্যস্ত অরুণ ফাইল থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ইয়েস, কাম ইন।
শ্যামলী ঘরে ঢুকে একেবারে ম্যানেজার সাহেবের চেয়ারের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
অরুণ চমকে উঠে তাকিয়ে শ্যামলীকে দেখেই হেসে ফেলল।
কি ব্যাপার শ্যামলী, মনে হচ্ছে কাল রাতে তুমি ঘুমোতে পার নি। আজ তাই কলেজের ক্লাস শেষ করেই চলে এসেছ?
অরুণদা, একটা জরুরি দরকারে এসেছি। অল্প একটু হলেও সময় দিন।
অরুণ ঘন্টি বাজিয়ে আর্দালিকে ডেকে বললেন, এখন যেন কেউ আমার চেম্বারে না ঢোকে। তারপর শ্যামলীর দিকে চেয়ে বললেন, কি খাবে বলো শ্যামলী?
শ্যামলী বলল, এটা অফিস। ব্যবসা গাড়িতে, বন্ধুত্ব বাড়িতে। বাড়িতে গেলে অনেক কিছু খাওয়াবেন অরুণদা। এখন থাক।
অরুণ ম্লান মুখে বললেন, তোমার দিদির আজ বিয়ে হয়েছে তিন বছরের ওপর। এর মধ্যে কয়বার দিদির বাড়ি গিয়েছ, গুণেছ?
শ্যামলী বলল, আচ্ছা অরুণদা, যাব যাব, ঠিক যাব একদিন।
অরুণ বললেন, বাজে বোকো না শ্যামলী, আমাদের বিয়ের ফুলশয্যার রাতে পর্যন্ত তুমি যাও নি।
শ্যামলী বলল, কি আশ্চর্য, সে সময় যে আমার ঘাড়ের উপর পরীক্ষা এসে পড়েছিল। বিয়ে বাড়ি খেতে গেলে যদি ফেল মেরে বসতাম?
অরুণ বললেন, তুমি জেলার মধ্যে ভাল নম্বর করেছিলে বলে আমার খুব গর্ব হয়েছিল।
শ্যামলী বলল, তবে? কষ্ট করলে তবে না কেষ্ট মেলে?
অরুণ বললেন, কয়েকটা ঘণ্টা বই মুখে না বসে থাকলে তোমার মতো মেয়ে ফেল করত, এটা আমায় বিশ্বাস করতে বোলো না শ্যামলী।
শ্যামলী বলল, না অরুণদা, আসলে সবাই তো গিয়েছিল। শুধুমাত্র পিসি যায় নি। বাবা, মা কত করে তাকে যেতে বলেছিলেন, তবুও সে রাজি হয় নি। কেঁদে ফেলে পিসি বলেছিল, ওগো আমি অলুক্ষুণে। আমাকে যেতে নেই। আমি পিসিকে বলেছিলাম, পিসি, তুমি যদি অলুক্ষুণে হও, তাহলে আমিও অলুক্ষুণে। আমাকেও যেতে নেই। গ্যাঁট হয়ে রইলাম বসে। মা পিঠে চাপড় মেরে আমাকে কাঁদাতে পেরেছে, কিন্তু নড়াতে পারে নি।
সবাই ঘিনঘিৎ কেটেছিল, কি রকম দজ্জাল মেয়েছেলে রে বাবা! নিজের দিদি বলে কথা, তবু একটুও টান নেই। আমাদের বাবা বোনে বোনে শরীরটুকুই যা আলাদা। সব কথা গলগল করে না বললে আমাদের হয় না।
শ্যামলী উদাস স্ববরে বলল, না যাবার আর একটা কারণ ছিল অরুণদা।
অরুণ বললেন, যথা?
শ্যামলী বলল, আপনাদের বাড়ি থেকে ফাইন্যাল কথা হয়ে যাবার পর, আপনি মাঝে মধ্যে দিদির সাথে দেখা করতে আসতেন। এ রকম একটা দিনে পড়ন্ত বিকেলে আপনি এসেছেন। ছাতে দিদি আর আপনি গল্প করবেন। দিদি জোর করে আমাকে তার সাথে ছাতে নিয়ে গিয়েছে। আমি আপত্তি করলে আমাকে রামচিমটি দিয়েছিল।
তার পর গল্প করতে করতে মা আমাকে জলখাবার নিচ থেকে উপরে নিয়ে আসতে বললে, আমাকে আপনার কাছে রেখে দিদি নিচ থেকে খাবার আনতে গিয়েছিল। দিদি ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গিয়েছে, তখন চিলেকোঠার ঘরে আপনি আমাকে একটু আদর করেছিলেন।
অরুণ অস্বস্তিতে ভুগতে থাকেন। বলেন, হঠাৎ আমার যে কি হল, আমি ও রকম করে ফেলেছিলাম। তুমি প্লিজ এসব মনে রেখো না।
শ্যামলী বলল, না না, মোটেও মনে রাখি নি। বলে ঠোঁট টিপে হাসল। বলল, জাম্বু, সেদিন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিলাম। না, আপনি ছুঁয়ে দিয়েছেন বলে নয়, আমার দিদিকে যাতে আপনি পরিপূর্ণ করে ভালবাসতে পারেন, সেই ইচ্ছে আমার মনে ছিল। ফুলশয্যায় আমি সেজে গুজে আপনাদের বাড়ি গেলে আবার যদি আপনার মনটা দুলে ওঠে, যদি আমার দিদির দিকে আপনি অখণ্ড মনোযোগ দিতে না পারেন, সেই আতঙ্ক আমার ছিল।
অরুণ খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে বললেন, প্লিজ তুমি এসব কিচ্ছু মনে রেখো না।
শ্যামলী বলল, জাম্বু, জানেন, সেদিন আপনার স্পর্শে আমি হঠাৎ করেই একরাতে বড়ো হয়ে গিয়েছিলাম। নরনারীর শরীরী বিন্যাস আর মনের গড়ন নিয়ে পড়াশুনার টান তৈরি হয়ে গেল। তারপর মনে হল, রাম লক্ষ্মণ ওভার রিয়্যাক্ট করেছিলেন।
অরুণ বললেন, ওভার রিয়্যাক্ট কি ব্যাপারে?
শ্যামলী বলল, শূর্পনখার ব্যাপারে।
অরুণ বললেন, কি রকম?
শ্যামলী বলল, দেখুন জাম্বু, শূর্পনখার তখন সদ্য সদ্য বর মারা গিয়েছে। অথচ তার যৌনকামনার নিবৃত্তি হয় নি। কামনানিবৃত্তির জন্য বয়সের একটা ভূমিকা থাকা সম্ভব। হরমোনের একটা ব্যাপারও। তো সুদেহী দীর্ঘবাহু রামকে দেখে শূর্পনখার ভাল লেগেছিল। তাই যৌনকাতর মেয়েটা রামকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। রাম বলেছিলেন দ্যাখো আমার বৌ আছে, তোমাকে বিয়ে করি কি করে বলো?
শূর্পনখা বলেছিল, এই ব্যাপার? আমি সীতাকে খেয়ে ফেলছি। তা হলে তো তোমার আমাকে বিয়ে করতে আর কোনো বাধা থাকে না। এই বলে শূর্পনখা সীতার দিকে তেড়ে গেলেন। তখন দুই বীরপুরুষ সেই অজুহাতে শূর্পনখা মেয়েটির নাক কান কেটে দিলেন।
আপনাকে মানতেই হবে যে একটি সুন্দরী তরুণী মেয়ের নাক কান কেটে দেওয়া মানে আইপিসির
অরুণ বিরক্ত হয়ে বললেন, কি হচ্ছেটা কী? এটা ব্যাঙ্ক, আর তার ম্যানেজারের চেম্বার। একটু সামলে সুমলে বলো!
শ্যামলী বলল, মহিলার বয়স এখন ত্রিশ।
অরুণ বললেন, না না, আমি জানি না।
শ্যামলী বলল, অরুণদা, আপনি উমরাও জান, আর অগর তুম না হোতে এই ফিল্মগুলো দেখেছেন?
অরুণ হেসে বললেন, তা দেখব না কেন? রেখার অতো চমৎকার সিনেমা!
খিলখিল করে হেসে উঠে শ্যামলী বলল, ওই ভানুরেখা গণেশনই রেখা। ১৯৫৪ সালের দশ অক্টোবরে জন্মেছিলেন। দ্রাবিড় মেয়ে ভানুরেখা। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কেমন যেন অন্যরকম একটা সম্পর্ক, তাই না?
অরুণ বললেন, হ্যাঁ, রেখা আর বচ্চন দারুণ জুটি। ভারতীয় সিনেমায় এত জনপ্রিয় জুটি উত্তম সুচিত্রা, আর উত্তম সুপ্রিয়া।
শ্যামলী বলল, আরো আছে। দক্ষিণী ফিল্মগুলো আপনি বোধহয় দ্যাখেন না। দক্ষিণী মেয়েদের ফিগার আর মুখশ্রী ভারি চমৎকার। রেখা একজন দক্ষিণী সুন্দরী । শূর্পনখা আসলে একটা ভারি সুন্দর মেয়ে। তার নাক কান কেটে নিয়ে রাম আইপিসির ৩৪১, ৩২৪, আর ৩২৬ ধারায় অপরাধ করেছেন। অথচ রাম মিষ্টি কথায় মেয়েটাকে বোঝাতে পারতেন। যাই হোক, একটা রাজকন্যার নাক কান কেটে দিলে, মেয়ে হিসেবে তার বেঁচে থাকাটাকেই বিপন্ন করে দেওয়া হয়। পরে আমি ভেবে দেখেছি, রাম আসলে নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্য শূর্পনখার উপর ওভার রিয়্যাক্ট করেছেন। সীতার কাছে নিজেকে পলিটিক্যালি কারেক্ট দেখাতে গিয়ে তিনি এই নিন্দনীয় কাজ করেছেন।
অনেক পুরুষ মানুষই বিবাহিত সম্পর্কের বাইরে আরো কিছু খোঁজে। জোর গলায় বলতে লজ্জা পায়। মেয়েরাও অপোজিট সেক্সের নানাবিধ সম্পর্কের কাছে নানা রকম চায়। কিন্তু ভাবনাটাকে দাবিয়ে রাখে। আমার তো মনে হয়, বহুগামিতা মানব যৌনচাহিদার একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
নইলে আমি কৃষ্ণের সঙ্গে দ্রৌপদীর সম্পর্কটাকে ব্যাখ্যা করতে পারি না।
অরুণ বললেন, তোমার এইসব কথা আমি মানছি না।
শ্যামলী বলল, কিন্তু আপনি মানছেন যে কোনো কোনো পুরুষ যে মেয়েটাকে বিয়ে করতে চলেছে, তারই আঠারো পূরণ না হওয়া কিশোরী বোনের শরীর স্পর্শ করতে পারে? মনে রাখুন যে আঠারো পূরণ না হলে একটি মেয়ে আসলে একটি শিশু মাত্র, এবং তার যৌনসম্মতি দেবার যোগ্যতাটাই তৈরি হয় নি।
অরুণ বললেন, দ্যাখো শ্যামলী, তোমার বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা চলছে, এই সময় বিয়ের সম্পর্কটাকে লিগালাইজড প্রসটিটিউশন বলাটা তোমার সাংঘাতিক রকম ভুল হচ্ছে।
শ্যামলী বলল, অরুণদা, আপনি প্রসটিটিউশন কথাটাই বড় করে দেখছেন, কিন্তু তার আগে লিগালাইজড কথাটাকে লক্ষ্য করছেন না।
অথচ আপনার জোর দেওয়া উচিত ছিল ওই লিগালাইজড শব্দের উপরে।
অরুণ বলেন, লিগালাইজড কথাটা দিয়ে তুমি কি স্পেশাল কিছু বলতে চাচ্ছ?
শ্যামলী বলল, আচ্ছা জাম্বু,
অরুণ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, জাম্বু জাম্বু বোলো না তো। অরুণদা ডাকো, সেই তো স্বাভাবিক লাগে।
শ্যামলী বলল, আচ্ছা অরুণদা, ডকট্রিন অফ কোভারচার মনে আছে?
অরুণ বললেন, শ্যামলী শর্টে বলো, আমার অনেক কাজ রয়েছে।
শ্যামলী বলল, ডকট্রিন অফ কোভারচার নিয়ে উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোনের লেখা পড়বেন। বলা হয় যে, বিবাহের দ্বারা স্বামী এবং স্ত্রী হয়ে ওঠেন রক্ত মাংসে এক অভিন্ন অবিচ্ছিন্ন সত্ত্বা। তারা তখন আর দুজন আলাদা আলাদা মানুষ নয়, আইনের চোখেও তারা এক অভিন্ন ব্যক্তি।
একজন কুমারী বিবাহের পর পত্নী হিসেবে গৃহীত হন। তখন ওই মহিলার আইনি অধিকার সকল তাঁর পতির আয়ত্ত্বে আসে।
কোভারচার ডকট্রিন অনুযায়ী একজন বিবাহিতা মহিলা কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না। বিবাহিতা মহিলা কোনো দলিল সম্পাদনা করতে পারেন না। তিনি কোনোরকম চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন না। স্বামীর ইচ্ছার বিপরীতে পড়াশুনা পর্যন্ত করতে পারেন না। নিজের নামে বেতন নিতে পারেন না। বিবাহ জারি থাকাকালীন একজন মহিলার ব্যক্তি অস্তিত্ব ও আইনি সত্ত্বা নিষ্ক্রিয় থাকে। বা বলা যায়, মহিলার তেমন অস্তিত্ব ও তেমন সত্ত্বা স্বামীতে অঙ্গীভূত হয়।
সম্পর্কের এমন বিন্যাসকেই সংস্কৃতশাস্ত্রে “ছায়েবানুগতা” বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য নহিলে খরচ বাড়ে।