দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৬৯)

পর্ব – ১৬৯

শ‍্যামলী কারবারের মহাজনের সঙ্গে দেখা করবে বলে তাঁর বাড়ি পৌঁছাল। টুকটুকে বৃদ্ধ। ফিনফিনে শাদা ধুতি আর ফতুয়া পরে আধশোয়া হয়েছিলেন। এঁরা অফিসকে গদি বলেন। ছেলেরা ও নাতিরা আধুনিক হয়ে উঠে আধুনিক অফিস করেছে। তাদের সব আলাদা আলাদা কারবার দেখার দায়িত্ব। বৃদ্ধ রয়ে গিয়েছেন পুরোনো যুগে। শাদা চাদরে ঢাকা ঢালা বিছানা। তাকিয়া রয়েছে। রয়েছে ক‍্যাশ বাক্স, টেলিফোন রিসিভার আর পিকদানি। বৃদ্ধ সদাহাস‍্যময়। দেখলে কে বলবে তুখোড় ব‍্যবসাবুদ্ধি আছে তাঁর।
শ‍্যামলীকে বসতে বলে বৃদ্ধ বললেন, আজ তোমাদের লোক এসে চেক দিয়ে গেছে। কাল ব‍্যাঙ্কে পাঠাব। এখন ফোন করে কি কি মোটরপার্টস লাগবে বলে দিলে এদের লোক মালপত্র পৌঁছে দিয়ে আসে। সময়মতো কারবারের লোক এসে অ্যাকাউন্ট পেয়ী চেকে বিল মেটায়। শ‍্যামলী এই সমস্ত ব‍্যবস্থা দাঁড় করিয়েছিল। বৃদ্ধ বললেন, শোনো ছোটোখুকি, জিনিসের দাম বাড়ছে। আমার পুরোনো স্টক থেকে দিয়েছি বলে আজ বাড়তি দাম ধরি নি। কিন্তু, এর পর থেকে বাজারে যে দাম চলছে, তাই নেব। তুমিও গাড়িওলাদের থেকে আদায় বাড়াও। শ‍্যামলী যে ঠিক কেন এসেছে এখানে, তা সে নিজেই ঠিক মতো জানে না। বৃদ্ধ বললেন, ইন্দিরা গান্ধী খুন হয়ে যেতে কারবারের যতটা বিপদ হবে ভেবেছিলাম, ততটা হয় নি। ওরা ইন্দিরা গান্ধীর ছেলেকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ভাল কাজ করেছে। কেউ ট‍্যাঁ ফোঁ করতে পারবে না। ভারতের লোক চিরকাল মাথার উপর রাজা রাজড়া চেয়েছে। ছেলেটা শুনেছি পাইলট ছিল। বিদেশের মেয়েকে বিয়ে করেছে। ওটা কিছু নয়। ছোটোঘর থেকে মেয়ে আনলেও সে মেয়ে যদি ভদ্র হয়, সে নিজেকে খাপ খাইয়ে ভাল বাড়ির উপযুক্ত করে নিতে পারে। ইন্দিরার ছোট ছেলেটা সুবিধার ছিল না। তার শাস্তি সে পেয়েছে।
শ‍্যামলী বলল আপনি এখনো রাজনীতির এত খবর রাখেন?
বৃদ্ধ বললেন, শোনো, রাজনীতির খবর না রাখতে শিখলে ব‍্যবসা চালাতে পারবে না। বৃদ্ধ হাসেন। কারবার চালাতে গেলে তোমাকে অনেকগুলো লোককে হাতে রাখতে হবে। অথচ সবাইকে একধারসে পয়সা বিলিয়ে গেলে তোমার কিছু থাকবে না। ঠিক কাকে পয়সা দেবে, আর কতটা দেবে মাথায় রাখবে।
শ‍্যামলী বলল, আপনি কার পয়সা কাকে দেবেন?
বৃদ্ধ মুখে একটুকরো আমলকি ফেলে চিবাতে চিবাতে বললেন, জ‍্যোতি বসু ওই কথা বলেছিল। আর তার পার্টি ট্রাম পুড়িয়েছিল। ট্রাম পুড়িয়ে প্রাইভেট বাসের সুবিধা করে দিল ওর পার্টি।  তখনই টের পেয়েছি, এখন বাসমালিকের সাপোর্টে বাসে বাসে সংগঠন করবে জ‍্যোতি বসু। এখন দ‍্যাখো ক্ষমতায় এসে পার্টির শক্তি বাড়ানোর নাম করে কারখানা গুলোকে মেরে ফেলছে। শ্রমিক লিডাররা আগেও কাজ করত না। কলার উঁচিয়ে ঘুরত। এখন সেই সংখ‍্যাটা বেড়ে গেছে। কত নেতা এখন! আর ইংরেজি তুলে দিল। পাশফেল তুলে দিচ্ছে। বোকারা ভাবছে, যাক্, পড়তে হবে না, এমনি এমনি পাশ করে যাব। আরে বাজারে নতুন কারখানা ক‌ই? পুরোনো কারখানা সব তুলে দেবে। মালিকদের সাথে সব তলে তলে আঁতাত। ছোটোখুকি, তুমি কলেজে ইনকিলাব জিন্দাবাদ করো তাই না?
শ‍্যামলী বলল, না, আমি ওসব করি না।
বৃদ্ধ বললেন, যাক্, বাঁচালে। একবার শুনেছি তুমি একদঙ্গল লোক নিয়ে ওই মাফিয়া রামনারায়ণের বাড়ি ঘেরাও করেছিলে। তখন পুলিশ একটা ভাল কাজ করেছিল। তোমাকে কালো গাড়িতে করে তুলে নিয়ে এসেছিল।
শ‍্যামলী বলল, আমাকে পুলিশ তুলে এনেছিল, সেটা খুব ভাল কাজ হয়েছিল?
বৃদ্ধ বললেন, ভাল মন্দ সব সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। যা ওপর ওপর মন্দ বলে মনে হয়, তা আসলে সবটা তত মন্দ নয়। আর যা মনে হয় ভাল, আসলে তা তত ভাল নয়। হয়তো অনেকটা মন্দ‌ই মিশে আছে তার ভিতর।
শ‍্যামলী বলল, একটু বুঝিয়ে বলুন।
বৃদ্ধ বললেন, এই যে ইন্দিরাজি মারা গেল, এটা না হলে বলা নেই ক‌ওয়া নেই, যাকে কেউ চেনে না পর্যন্ত, তাকে কুর্সিতে বসিয়ে দেওয়া যেত না। জরুরি অবস্থা আর স্বর্ণমন্দিরে পুলিশ পাঠিয়ে ইন্দিরাজি কাঁচা কাজ করেছে। তার জন্য ইন্দিরাজির বাজার খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন রাজীবের হাত ধরে নতুন ইমেজ নিয়ে আসবে কংগ্রেস। ভোট এলে লোকজন উপচে উঠে ভোট দেবে। তারপর কংগ্রেস আরেকটা চেহারা নেবে।
শ‍্যামলী বলল, আপনি কি ভবিষ্যৎ বাণী করছেন?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।