• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১২)

পর্ব – ১

১০৮
বাবার ঘরে গিয়ে শ্যামলী দেখলো তিনি ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে আছেন । দূরে কাদের বাড়ি থেকে রেডিও শোনা যাচ্ছে।
“ শ্যামলিমা এলি ?”
“ হ্যাঁ বাবা।“
‘ সারা দিন দেখা নেই মেয়ের । কলেজ থেকে ফিরে গ্যারেজে সেই ঢুকলি । আর খেতে এলি না ।“
“ কাজ ছিল বাবা ।“
“ আমি বাপ হয়ে শুয়ে আছি। আর তুই মেয়ে হয়ে প্রাণপাত করছিস।“
বেতের একটা মোড়া এনে মেয়ে বসে বাবার কাছে। বলে “ বাবা, চেকটা সই করে দাও ।“
“ সই তো করতে বলছিস । টাকা পয়সা কি আছে তা তো কিছু জানি না।“
“ ভয় নেই বাবা । চেক বাউন্স হবে না। আমি কালই ব্যাঙ্কে টাকা ভরে দেব ।“
শশাঙ্ক পাল অশক্ত হাতে চেকে সই করে দেন। বলেন “ ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া না করলে শরীর ভেঙ্গে পড়বে তোর।“
মেয়ে বলতে পারে না সারা দিনের অভিজ্ঞতার কথা। গ্যারাজে হামলা, মিস্ত্রীর আহত হওয়া, তার থানায় যাওয়া , তার পর বস্তিতে … এসব বাবাকে বলা চলবে না।নিচের তলা থেকে দিদি জামাইবাবু আর তার ভায়েদের হইচই এর শব্দ শোনা যাচ্ছে ।
শশাঙ্ক পাল বলেন “শ্যামলিমা, এবার তুই একটু নিচে যা মা। সবার সাথে আনন্দ কর । আলাদা হয়ে থাকিস না ।“
“ বাবা, আমি একটু পড়তে বসবো। কাল আমার ক্লাস টেস্ট। সারা দিনের ঝামেলায় খেয়াল ছিল না।“
“ আলোটা নিবিয়ে দিয়ে যা তাহলে ।”
আলো নিবিয়ে দিলে কোন একটা ফাঁক থেকে এক টুকরো চাঁদের আলো ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো । শ্যামলী ভাবলো একটা আলো নিবে গেলে কখনো অন্য একটা আলো জ্বলে ওঠে ।
নিজের ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে নিয়ে পড়তে বসতে যাবে এমন সময়ে ফোন বেজে উঠলো ।
“ হ্যালো , আমি রমানাথ বলছি ।“
বুকের ভেতরটা সহসা ধ্বক করে ওঠে তার। আবার কেন এই লোকটা ফোন করছেন?
শান্ত গলায় শ্যামলী বললো “ হ্যাঁ , বলুন ।“
“ তুমি ভাল আছো তো ?”
ছোট করে জবাব দিল মেয়ে । “ চলে যাচ্ছে।“
“ আজ তুমি থানায় গিয়েছিলে।“
শ্যামলী সতর্ক হয়। তার সকল গতিবিধি কি কেউ কেউ নজর রাখছে !
“ হ্যাঁ কাজ ছিল।“
“ কি হয়েছিল?”
“ তেমন কিছু না। এমনি …”
“ এমনি এমনি কেউ থানায় যায় না শ্যামলী । কি হয়েছিল, আমায় বলতে পারো ।“
“ একটা পেটি ক্রিমিন্যাল ব্যাপার । জিডি করে আসতে হল।“
“ কি হয়েছিল?”
শ্যামলী চিন্তায় পড়লো । বাবা মায়ের কানে গেলে ওরা দুশ্চিন্তায় পড়বেন । তাই বললো “ কারবার চালাতে গেলে কতো রকম খুচখাচ লেগে থাকে । সে নিয়ে অতো উদ্বেগ বোধ করি না।“
রমানাথ বললেন “ আমি করি শ্যামলী । তোমার ব্যাপারে আমার উদ্বেগ থাকে ।“
শ্যামলী বিরক্ত হয় “ কেন বলুন তো রমানাথ বাবু ? আমার মতো অনাত্মীয় একটা মেয়ের ব্যাপারে আপনার উদ্বেগের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ তো আমি দেখি না। আর নিজের ঝামেলা আমি নিজেই সামলাতে অভ্যস্ত। আমার ব্যাপারে আপনি উদ্বেগ না করলেই ভাল ।“
রমানাথ বললেন” আমার ওপর এত রাগ কেন তোমার শ্যামলিমা ?”
“ আপনি অনুগ্রহ করে আমায় শ্যামলিমা বলে ডাকবেন না। আমার নাম শ্যামলী । আমার বাড়ির নামটা শুধু বাবা মায়ের মুখেই থাক। “ শ্যামলী শীতল শুকনো গলায় বলে।
“ আমি কি কোনোভাবে তোমায় আঘাত করেছি শ্যামলী ?”
“ কি যে বলি আপনাকে ? আমি কেমন, আমার চরিত্র কেমন, সে নিয়ে আপনার বাবার চিঠি আমাদের বাড়িতে আসার পরে আমি আহত হয়েছি কি না সে নিয়ে আর কোনো দোলাচল তো আপনাদের থাকার কথা নয়। “
রমানাথ বলেন “ তোমার এটা ভুল হচ্ছে শ্যামলী । আমার কিছু কথা বলার আছে । আমাকে একদিন সময় দাও না ? “
শ্যামলী বলে “ সারাদিন গ্যারেজে সাত ঝামেলায় কাটিয়েছি। আর কি কি করেছি আপনি খবর রেখেছেন । আগামী কাল আমার ক্লাস টেস্ট । এবার একটু পড়াশুনা না করলে গরিব বেচারি ক্লাসে ফেল মেরে বসে থাকবো।“
রমানাথ তবু বলেন “ আমায় একটা দিন কথা বলার সুযোগ দাও।“
“ বেশ, আমি আপনাকে সময় মতো বলে দেব। এবার রাখছি।“ ঝপ করে ফোনটা নামিয়ে রাখে শ্যামলী ।
এমন সময় তার দিদি তনুশ্রী ঘরে ঢোকে ।
“কার সাথে কথা বলছিলি?”
“ রমানাথ নন্দী । বাবার গুরুভাইয়ের ছেলে।“
“ কি চায় সে?”
“ কি জানি কি চায় …”
“ তুই কথা বলছিলি কেন?”
“ দিদি, আমি কারবারী মানুষ । সারাদিন লোক চরিয়ে খাই । আমার তো কথা বলতে চিন্তা হয় না।“
“ বাজে বকিস না। তুই খুব ইমোশনালি কথা বলছিলি। আমার চোখকে ভাঁওতা দিতে পারবি না।“
“ দিদি, লোকটার নাম আমি তোমাকে বলেছি। আর বাবার কে হয় তাও বলেছি। আর দরজার বাইরে থেকে তুমি অনেকটা শুনেছও । তাহলে আর কি জানতে চাও বলো ?”
“ আচ্ছা, তুই আমায় তুমি তুমি করে কথা বলছিস কেন?”
শ্যামলী গম্ভীর হয়ে জবাব দিল “ বড়োদেরকে তুই করে বলা ঠিক না । আমি ভুল শুধরে নিচ্ছি ।“
“আচ্ছা, সে না হয় হলো, কিন্তু রমানাথের সাথে তোর সম্পর্ক টা কি?”
শীতল গলায় শ্যামলী বললো “ সেটাই আমি ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইলাম ।“
তনুশ্রী অবাক হয়ে বললো “ সে কি রে? তুই জানতে চাইলি?”
“ হ্যাঁ , আমি ভেবে পাই না, যে মেয়ে পর পুরুষের সাথে হোটেলে রাত কাটায় , তাও একটা নয় , দু দুটো, তাকে নিয়ে ভদ্রলোকেদের এত কৌতূহল কেন?”
“ তুই কি তোর জামাইবাবুর ওপরেও রাগ করে আছিস?”
“ দিদি, আমি তো আর পাঁচ জনের মতো হতে পারতুম? পারতুম না? বালটিতে টানি নি কি জল? কাস্তে হাতে কোনোদিন যাই নি কি মাঠে? তবু আমি কেন এমন একাকী?”
“ কি আবোলতাবোল বকছিস? “
“ বকছি না, বকছি না, জীবনানন্দ দাশের কবিতা বলছি!”
“ হঠাৎ কবিতা বলছিস কেন?”
নিচ থেকে তনুশ্রীর বর ডাকাডাকি শুরু করে দিলে সে নেমে গেল। তাকে ফিরে যেতে হবে ।
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে শ্যামলী বলল “ কেন আমি এমন একাকী?”
১০৯
ক্লাস টেস্ট শেষে কলেজ থেকে বেরিয়ে ব্যাংকে ঢুকল শ্যামলী । টাকা কটা অ্যাকাউন্টে জমা করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হল সে। ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসবে এমন সময় প্রবাল সেনের সাথে দেখা । একগাল হাসিতে কথা কম করে বলার ব্যাপারটা পুষিয়ে দেন প্রবাল ।
হাসিমুখে নরম গলায় বললেন “কি আশ্চর্য আমার হল শুরু, তোমার হল সারা ?”
শ্যামলী বললো “সারা কিসের, দেখা যখন হলই , খানিকক্ষণ তো আড্ডা দিতেই হবে ।“
“তোমার দেরি হয়ে যাবে না ?”
শ্যামলী বললো “ তা হোক, আপনাকে দেখে কিভাবে চলে যেতে পারি? আপনি কি টাকা তুলবেন, না জমা দেবেন ?
স্মিত মুখে প্রবাল জানালেন “কোনোটাই করবো না । পিসির নামে একটা অ্যাকাউন্টে বেশ কিছু টাকা ছিল । নমিনি ছিলাম আমি । পিসি চলে যেতে সে টাকা আমার পাওনা হয়েছে । আমার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করাবো ।“
শ্যামলীর মনে হল প্রবাল সেন কি করেন জানা হয়ে ওঠেনি তার। তার বাড়ি কোনোদিন যাওয়া হয়ে ওঠে নি। আরো জানা হয় নি তার বাড়িতে কে কে আছেন, সে তথ্য নেওয়া। তাহলে প্রবালের কতোটুকু সে জানে? অথচ প্রবালকে দেখে তার ভেতরে সর্বদাই আপনত্ব জেগে ওঠে কেন? সেই দিনের কথা মনে পড়লো তার। সেদিন ফোনে সে রমানাথের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করছিল । এমন সময়ে প্রবাল সেন রিসিভারটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন – তোমাকে এভাবে কারো সাথে রাগারাগি করতে দেবো না। তখন এক বারের জন্যেও মনে হয় নি প্রবাল সেন অনধিকার চর্চা করছেন । মানুষের সম্বন্ধে তথ্য জিনিসটা জরুরি নিশ্চয় । কিন্তু আরো জরুরি আস্থার বোধ । সেই এক ভোর বেলা প্রবাল আর অরিন্দমের সাথে হাতে হাত ধরে হেঁটেছিল সেই কথা মনে পড়ে। কিন্তু প্রবাল পেশাগত জীবনে কি করেন জানতে চাইতে খুব সংকোচ অনুভব করলো শ্যামলী ।
প্রবাল বললেন “ তোমার বাবার খোঁজ আমি নিয়মিত নিই । এই তো আজও ফোন করেছিলাম।“
শ্যামলী অবাক হয়ে বললো “ ওম্মা তাই? কই বাবা তো আমায় বলে নি ? আজ বাড়ি গিয়ে জানতে চাইবো তো কেন বলে নি !” তার পরে কি মনে করে বললো “ কই, আমাকে তো আপনি ফোন করেন না? আমিই তো আপনার বন্ধু …।“
প্রবাল হেসে বললেন “ বাবাকে হিংসে কোরো না শ্যামলী । বিছানায় পড়ে আছেন, কেউ একটু গল্প করলে কি খুশি হন । আমার সাথে তো কথা ফুরোতেই চান না।“
শ্যামলী অবাক হয়ে বললো “ আশ্চর্য !” তার বার বার জানতে ইচ্ছে হল প্রবাল কি করেন। কিন্তু ঠোঁটে সে প্রশ্ন বেধে গেল বার বার। নিজেকে ভারি আশ্চর্য লাগলো তার। যাকে দেখলে গল্প করতে ইচ্ছে করে, তাকেও মন খুলে পেশার কথা, বাড়ির কথা যেচে জানতে চাইতে পারছে না। যদি বন্ধু নিজে থেকে জানান, তবেই সে জানবে, যতোটুকু জানাবেন, ততোটুকুই জানবে । কোনোভাবেই লক্ষ্মণ রেখা পার হবে না।
ব্যাংকের কাজ শেষ হলে প্রবাল সেন তাকে বাসে তুলে দিয়ে কোথাও গেলেন। শ্যামলী জানতে চাইলো না তিনি কোথায় যাচ্ছেন ।
গ্যারাজে পৌঁছে দেখলো মোটর পার্টস পৌঁছে গিয়েছে । কাজ হচ্ছে জোরকদমে । তার অফিসঘরের বাইরে একটা টুলে ঘোমটা মাথায় একটি বউ বসে আছে । কাছে গিয়ে বুঝতে পারলো হেড মিস্ত্রীর বউ ।
“কি, তোমার মিস্ত্রীমশায় কেমন আছে?”
“জ্বর ছাড়ে নি ।“
জিজ্ঞাসাবাদ করে শ্যামলী জানতে পারলো সূচ ফোটানোর ভয়ে মিস্ত্রী হাসপাতালে যেতে চায় নি। পাড়ায় একজন বই ঘেঁটে টুকটাক ওষুধ দেয়, সে জ্বর ঝাড়ানোর মন্ত্র জানে। তার কাছেই চিকিৎসা চলছে ।
মুহূর্তে ভীষণ রেগে গেল শ্যামলী । বউটিকে বললো “দূর হয়ে যাও আমার কারখানা থেকে । পুরুষ মানুষ । লোহা লক্কড় নাড়ে চাড়ে রোজ। তার কি না সূচ ফোটানর ভয়? আমি ডাক্তার দেখাবার টাকা দিয়েছিলাম। ডাক্তার যখন দেখাও নি, দাও, আমার টাকা ফেরত দাও।“
বউটি শ্যামলীর রাগ দেখে ভয়ে বাঁশ পাতার মতো কাঁপতে থাকলো। রাগ খানিক কমলে শ্যামলী একটা অল্পবয়সী মজুরকে হুকুম দিল “মিস্ত্রীকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যাবি। যেতে না চাইলে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাবি । আমি কোনো ওজর আপত্তি শুনবো না। সুস্থ হয়ে কাজে লাগতে হবে। বিনে পরিশ্রমে ওকে বসিয়ে খাওয়ানোর মতো বড়োলোক আমি নই।“ তার পর কুড়িটা টাকা মজুরটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো ওদের চাল ডাল আলু কিনে দিবি। নগদ টাকা দিবি না। নগদ টাকা বেমক্কা পেলে ওদের মাথা ঘুরে যায় । ছেলেটি হুকুম তামিল করতে বেরিয়ে গেলে শ্যামলী বাড়ি পথ ধরলো ।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।