দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৪)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ২৪
১২৩
খাবার ঘরে মা আর পিসি মাটিতেই বসে খান। এজন্যে তাঁদের পিঁড়ি আছে। ছেলেদের বসার ব্যবস্থা টেবিল চেয়ারে। আগে কখনো কখনো মা আর পিসিকে টেবিল চেয়ারে বসে খেতে অনুরোধ করেছিল শ্যামলী। হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে পিসি প্রতিবাদ করেছিল। “ওরে বাবা, চেয়ারে বসে খেলে ভাতের গরাস আমার মুখেই ঢুকবে না।” বলেছিল, “তোর সব তাতে নাক গলানো। কে কি খাবে, কেমন করে খাবে, তাই নিয়ে তুই যদি এত বলিস তো শ্বশুর বাড়িতে তিষ্ঠতে পারবি না বলে দিলুম।” মা তখন মেয়েকে বলেছিল “ছাড় না মা, ওর যেভাবে খেয়ে পেট ভরে, তা করতে দে।” সেই থেকে শ্যামলী মুখ বুজে খেয়ে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসত। আজ মাকে বললো “মা, আজ তোমাদের সঙ্গেই বসে খাব।” সবিতা পিসি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো “না, না, তোকে আমাদের সাথে বসতে হবে না। তোকে টেবিল চেয়ার ছাড়া মানায় না।” মা সবিতার কথা কানে নিলেন না। মাটিতে তিনজনে গোল হয়ে বসে ভাত খেতে লাগল। খানিকক্ষণ বাদে মা বলল, “হ্যাঁ রে শ্যামলিমা, তোর ভোর বেলার কলেজ। বেলা হলে ছুটি হয়ে যায়, তো বাড়ি আসিস না কেন ? কত দিন একসাথে ভাত খাই না বলতো?”
সবিতা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো “বৌমণি, আজকাল তোমার মেয়ে রাতেও বাইরে খেয়ে নিশুতি রাতে বাড়ি ফেরে, সেটা তো কই বললে না?”
মা বললেন, “হ্যাঁ শ্যামলিমা, কি শুরু করেছিস আজকাল! এই যে সংসার চলছে, সব তোর একার খাটুনিতে। ভাইদুটো তো কুটোটি নাড়বে না। কিন্তু তুই বাড়ির ভাত খেতে চাস না কেন?”
“মা, ভাত বাড়ির, না বাইরের, সে নিয়ে কোনো সেন্টিমেন্ট আমার নেই। দুটো পরিষ্কার খাবার হলেই আমি খুশি। আর খাওয়া পরা নিয়ে বেশি মাথা ব্যথা আমার নেই। হলেই হল।”
“শুধু খাওয়া পরা কেন, আজকাল লেখাপড়া নিয়েও তোমার মাথা ব্যথা নেই। এতদিন পাশ করে মেডেল পেয়ে সবার হাততালি পেয়ে তুমি উচ্ছন্নে চলে গেছ। লোকেরা বলবে ‘পালেদের অমন মেয়েটা ফেল করেছে’ – এই কথা শোনার জন্যে তুমি বসে আছ।”
শ্যামলী দেখল মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। বলল “ছিঃ মা, ভাত খেতে খেতে কাঁদতে নেই।”
সবিতা পিসি বলল “সে বোধ বুদ্ধি তোমার এখনো আছে? দু বেলা এমন দেবতুল্য বাপ মাকে কাঁদাচ্ছো। আমি তো ভাবি, বুকটা তোমার বুঝি পাষাণ হয়ে গেছে।” মা তার হয়ে বলল “আহা, সবিতা, ওকে অমন করে বিঁধিস না। কলেজের পর ও লাইব্রেরিতে যায়। সেখানেই পড়ে নেয়। ছেলেদের কলেজের ক্যান্টিনে ভাত শস্তা। ও সেখানে খেয়ে নিয়ে বিকেলে কারখানায় গিয়ে বসে। রাতে অফিস থেকে কারবারের হিসেব মিলিয়ে তবে ফিরতে পায়। কারবারটা চোখে চোখে না রাখলে কি হয়, চোখের ওপর দেখলি তো।”
শ্যামলী অবাক হয়ে ভাবলো মা তাকে এত বোঝে !