• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৩৩)

পর্ব – ৩৩

৩২

নিজের ঘরে অরিন্দম দাশগুপ্তকে ডেকে এনে তার সামনে বসে জাপানি টি পটে চা বানাতে লাগল শ্যামলী ।
“জানেন মিস্টার দাশগুপ্ত, এই টি পটটা যে আমি প্রাইজ পেয়েছিলাম, আমি সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। মা আজ বিকেলে চা করে খাবার সময়ে আমায় মনে করিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি পুরস্কার হিসেবে যে বইগুলি পেয়েছি, তা সব আমার ভাল রকম মনে আছে।“
“তুমি আবার আমায় মিস্টার দাশগুপ্ত বলতে শুরু করলে কেন? অরিন্দম বাবু বলতে সেই তো ছিল বেশ।“
শ্যামলী বললো “আসলে কি জানেন, একটা ছক ভাঙছে দেখলে আমরা অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারি না। এই দেখুন না, লুচি বানাতে গিয়েছি, অমনি সবিতা পিসি শুরু করলো – ‘তুই লুচির কি জানিস?’ তার পর যখন কড়ায় লুচি ছেড়ে দিয়েছি তখন বলছে – ‘তোর হাতে লুচি ফুলবে না।‘ আবার জানতে চাইছে আলুর তরকারিতে কি ফোড়ন দেব। আসলে পিসি বুঝতে চাইছে না যে শ্যামলীও অল্প স্বল্প বুদ্ধি রাখে। কেবলি সে আমাকে সে পনেরো ষোলো বছর আগেকার অপদার্থ অশক্ত অক্ষম অযোগ্য কচি খুকি ভেবে স্নেহচ্ছায়ায় ঢেকে রাখতে ভালবাসে। কিন্তু তাতে আমাকে উপকৃত করা হয় না। আমাকে ছেড়ে দিলেই ভাল। আমি ঠিক রাস্তা দেখে চলতে পারবো।“
“হ্যাঁ শ্যামলী, তুমি বলছো পিসির কথা, আসলে ঠেস দিচ্ছ আমাকে।“ অরিন্দম দাশগুপ্ত যে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন, তা বেশ বোঝা যায়।
ভদ্রতা করে শ্যামলী বলে “না, আপনাকে আমি সত্যই শ্রদ্ধা করি। আপনি আমার বিপদের দিনে যেভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, শুধু আপনিও তো নয়, মিস্টার প্রবাল সেনও যে ভাবে সময় দিয়েছেন, তাতে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।“
অরিন্দম বলেন “তুমি বার বার ওই কথাটা মনে করাও কেন শ্যামলী? বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানো তো মানুষের কাজ। এটার জন্যে কৃতজ্ঞতার কথা আসে কেন?”
শ্যামলী মনে করিয়ে দিতে লজ্জা পায় যে, ঘণ্টা খানেক আগে এই মানুষই তার কারখানায় দাঁড়িয়ে এই কৃতজ্ঞতাই দাবি করছিলেন। বরং বলে “কি জানেন, ওই যে মানুষের বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সেই যে সহজ মানবিক প্রবৃত্তি, ওটা আমরা উদারতার সূত্রে মনে করি , কিন্তু ওটাই তো স্বাভাবিক মানবিক ধর্ম। মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমি যে সত্যি একটা মানুষ, সেটাই বোঝাতে পারি। তেমনি বিপদ পথ রোধ করে দাঁড়ালে মানবিক স্পর্ধাতেই যে মানুষ রুখে দাঁড়াতে জানে, বিপদের চোখে চোখ রেখে মোকাবিলা করতে জানে, সেটাও একটা চমৎকার মানুষী অভিজ্ঞান । প্রকৃতি মানুষের ভেতরে এইসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে রেখেছেন। সে মানুষ লড়াই করে মাথা খাটিয়ে বাঁচবে। প্রকৃতি সাধারণ প্রাণীকে দিয়েছে ইন্সটিঙ্কট বা প্রবৃত্তি, আর মানুষকে বিকশিত হবার জন্যে দিয়েছে বিবেচনা বোধ।“
হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে অরিন্দম বলেন “তুমি ব্যাপারটাকে ফিলজফির লেভেলে নিয়ে গেলে দেখছি।“
শ্যামলী মৃদু স্বরে বলে “আপনি ফিলজফি বলতে চাইলে বলুন, আমার আপত্তি করার কিছু নেই, কিন্তু, আমার সবিতা পিসি আজ ভাবছিল স্টোভে লুচি ভাজতে গিয়ে আমার হাত পুড়ে যাবে, আমি লুচিটা ঠিক মতো ফোলাতে পারবো না, রান্নায় মশলার গোলমাল করে ফেলবো । পিসি বুঝতে চায় না যে তাদের রান্নাবান্না দেখে দেখে আর ভাবনা চিন্তা দিয়ে আমিও সামান্য আলুর তরকারিটুকু সহজেই রাঁধতে পারি। আর লুচি গোল করে বেলাটা নিটোল বৃত্ত আঁকার মতোই ব্যাপার। লুচি ফোলাতে কাজ করে ফিজিক্সের নিয়ম। পিসি আমায় তার আঁচলের নিচে দেখতে চেয়ে একটা তৃপ্তি খুঁজতে চায়। বোঝে না, এটা তার সম্পত্তিবোধের সাথে জড়িয়ে আছে। আমাকে পিসি সম্পত্তি করে ভাবতে চায়।“
“কিন্তু তোমার কোনো বিপদ হবে ভাবলেই তোমাকে আমরা যারা ভালবাসি, তাদের ভেতরটা কেমন করে ওঠে।“ স্রোতের মুখে খড় কুটোর মতো ভেসে যাবেন ভেবে, চেয়ারের হাতলটাকেই আঁকড়ে ধরেন অরিন্দম।
“ওই একটা বিপজ্জনক কথা বলে ফেললেন মিস্টার দাশগুপ্ত। ভাল যদি বাসবেন, তাহলে তার ভালতে বাস করার অভ্যেস করুন। ‘তুই লুচি ভাজার কি জানিস? তুই আলুর তরকারির কি বুঝিস? আমি থাকতে তোর এসব করার দরকার কি?’ এই কথাগুলো আপনজনের মুখ দিয়ে বেরোয়, এ যেমন একটা সত্য, তেমনি সত্য যে এই কথাগুলো মানুষকে এগিয়ে দেয় না। আত্মসম্ভ্রমে স্থিত করে না। এ কেবল পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে। ভালবাসা যদি বলেন, তা এভাবে বাধা সৃষ্টি করবে কেন? ভালবাসা নয়, এটা একটা সম্পত্তি বোধ।“
“তাহলে শ্যামলী, তোমার ধারণা এই যে, বড়োরা ছোটোদের ভালবাসে না। স্রেফ সম্পত্তি মনে করে।“
আর এক কাপ চা দিই আপনাকে। এই বলে শ্যামলী খানিকটা সময় নিতে চায়। তার পর চা এগিয়ে দিয়ে বলে, “ভালবাসা বড় কঠিন ব্যাপার!”
“ কেন, কঠিন কেন শ্যামলী? “ ছেলেমানুষের জেদ নিয়ে প্রশ্ন করেন অরিন্দম।
একটু ইতস্ততঃ করে শ্যামলী হেসে বলে “আমি আপনাকে ফোন করলেই একটা সময় শিঞ্জিনী ধরতেন। আর আমার ওপর তুলকালাম রাগ করতেন। যেন ভাবতেন আমি তার তুতো দাদাটিকে আঁচলে বেঁধে ফেলেছি। সে যে কি রাগ কি রাগ ! তাও যদি জানতেন আমি ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকেই আপনার কয়েক গোছা প্রেমপত্র পেয়েছিলাম!”
অস্থির হয়ে উঠে অরিন্দম বলেন “শিঞ্জিনীর কথা বাদ দাও।“
“জানেন, অনসূয়া দির কথাও আমার মনে উঁকি মারে। উনি যে আমার মামলাটা ভালভাবে সামলে দিয়েছেন, তা ঠিক । কিন্তু একটা টাকাও ফিজ নেওয়াতে পারলাম না ওঁকে । এ লজ্জা আমার থেকে গেল। বার বার বলতেন, ‘অরিন্দম এত ভালবাসে তোকে। তোর থেকে আমি টাকা নিতে পারি?’ অথচ নিজের উপর নিগ্রহ সমানে করে চলেছেন বুঝতে পারি। অরিন্দমবাবু আপনার মুখে ভালবাসার কথা শুনলে আমার ওই শিঞ্জিনী আর অনসূয়াদি’র কথা ভারি মনে পড়ে। আমার কেমন ভয় ভয় করে ওদের কথা ভেবে।“
ঘাড় নিচু করে কবজিতে ঘড়ি দেখেন অরিন্দম। বলেন, “আজ আর থাক, এবার বাড়ি যাই । তুমি সাবধানে থেকো।“
“হ্যাঁ , চেষ্টা করে যাচ্ছি । আপনিও অহেতুক দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি খুব মাথা ঠাণ্ডা করে চলি। আইন মেনে চলি। আপনি শিঞ্জিনী দেবীকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন। পারলে অনসূয়া দি’র সাথে একটু যোগাযোগ করবেন। খুব অসুস্থ দেখাচ্ছিল ওঁকে।“
গাড়িতে ওঠেন অরিন্দম। শ্যামলী একটা গাঢ় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। গাড়িটা রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে যাওয়া অবধি দরজার ফ্রেম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।