• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৩৬)

পর্ব – ৩৬

৩৫
ক্লাস টেস্ট এর প্রশ্ন পত্র হাতে নিয়ে কিছু মেয়ে রাগ করছিল। প্রশ্ন নাকি শক্ত এসেছে।
ওরা তার কাছে এল। বলল , প্রশ্ন শক্ত হয়েছে সে কথা তাদের তরফে শ্যামলীকেই প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কাছে বলতে হবে। শ্যামলী হেসে বলল আমায় গিয়ে বলতে হবে কেন?
মেয়েরা বললো তুই ছাড়া আমাদের কথা কে বলবে?
শ্যামলী বললো আমি কিছুঈ বুঝতে পারছি না, তোমরা যা, আমিও তাই। বরং আমি একটু অভাগা। আমায় গতরে খেটে পেটের ভাত যোগাড় করতে হয়।
মেয়েরা রাগ করলো। তারা জানে শ্যামলী একটা কারখানার মালিক। তারা বললো “বানিয়ে বলতে লজ্জা করে না তোমার?”
“তা যা বলেছ। বানিয়ে বলতে পারবো না বলেই আপাতত তোমাদের মামলাটা হাতে নিচ্ছি না। আমি পরীক্ষা দেব ।“
মেয়েরা জিদ করলো আমরা পরীক্ষা দেব না। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের ঘরের বাইরে গিয়ে তারা জটলা শুরু করলো। ঘেরাও শুরু হল বুঝি।
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম তাকে ডেকে পাঠালেন । নিজের হাতব্যাগটা সামলে নিয়ে শ্যামলী ঢুকল প্রিন্সিপ্যালের ঘরে।
কড়া স্বরে তিনি তার কাছে জানতে চাইলেন “কি ব্যাপার, মেয়েরা গোলমাল করছে কেন?”
পাশ থেকে একজন কলেজ শিক্ষিকা খেঁকিয়ে উঠলেন “এই মেয়েটা যেখানে থাকে সেখানেই গোলমাল পাকায়। গতকালই দেখেছি রাস্তায় কি একটা মিছিল করছিল। অ্যাই, তুই কাল কলেজে আসিস নি কেন রে?”
প্রিন্সিপ্যালের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে শ্যামলী বললো “ কার প্রশ্নের জবাবটা আগে দেব, আপনারটা, না ওঁরটা।“
কলেজ শিক্ষিকা দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন “ এটা তোর বিতর্ক সভা নয়। সোজা কথা সোজাভাবে বল।“
ওঁকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে শ্যামলী বললো – “প্রশ্ন পত্র সহজ হোক, কঠিন হোক, ছাত্রীর দায়িত্ব পরীক্ষা দেওয়া।“
প্রিন্সিপ্যাল জানতে চাইলেন – তাহলে এত গুঞ্জন গোলমাল কিসের?
“ম্যাম, আমি শান্তভাবে পরীক্ষা দেবার পক্ষে।“
সব শিক্ষিকা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন। প্রিন্সিপ্যাল ধমক দিয়ে বললেন “এতই যদি ভালমানুষ তুমি, তাহলে বাইরে ওদের গিয়ে বলো গোলমাল না পাকিয়ে সুড়সুড় করে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি চলে যাক।“
শ্যামলী বুঝতে পারলো যে মামলা সে পকেটে পুরে ফেলেছে। সে বিনীত স্বরে বললো “ ওই টি পারবো না ম্যাম। আমার বাবা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল, হাতে পায়ে ধরে কেঁদে ককিয়ে পড়ার চান্স পেয়েছি। আমায় নিজের পড়ার খরচ নিজে রোজগার করতে হয়।“
একজন শিক্ষিকা বললেন “তবে যে সবাই বলে তোরা একটা কারখানার মালিক?”
“ম্যাম, আমি বাসে করে হাতে গোণা পয়সা নিয়ে কলেজে আসি, আর ছেলেদের কলেজের ক্যান্টিনে খাই। তার পর লাইব্রেরিতে একটু বই পরে নিয়ে সারাদিন কারখানায় খাতা লিখি। অন্য ছাত্রীরা আমার কথা শুনবে, এমন জোরালো গলা ভারালো মেজাজ আমার কই?”
“কথার ভটচাজ্যি এক খানা।“ একটা মন্তব্য উড়ে এল এক কোণ থেকে।
“তাহলে তুমি আমার হয়ে কাজ করতে পারছ না ?“ শ্যামলী টের পেল প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম নিজের স্ট্যান্ড ঠিক করে উঠতে পারছেন না।
“ম্যাডাম, ওরা ছাত্রী , আমিও একজন অতি সাধারণ ছাত্রী। ওদের কাছে আমার কিছু বলা না বলার কোনো মানেই নেই। ওরা আমার কথা শুনতে দায়বদ্ধ নয়।“
“তাহলে তুই কাল কলেজে না এসে রাস্তায় গোলমাল পাকাচ্ছিলি কেন?”
“গোলমাল তো পাকাই নি ম্যাম।“
“তবে রে? গোলমাল পাকাস নি? তোকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় নি?”
“আমায় যদি পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আমি এখানে বসে আছি কি করে?” শ্যামলী তার আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে।
“কি জানি কি করে বসে আছিস, ঘুষ টুস দিয়ে পালিয়ে এসেছিস হয়তো !”
“ম্যাম, তাহলে রইলাম বসে, আমায় আপনি পুলিশে ধরিয়ে দিন।“
“বাজে বোকো না শ্যামলী, কাজের কথায় এসো।“ প্রিন্সিপ্যালের গলায় মধ্যস্থতার সুর। “ তুমি আমার হয়ে ওদের বোঝাও, পরীক্ষা ওরা দিক। আমি পরে ব্যাপারটা দেখে নেব।“
“ম্যাম, আপনি বরং আমায় এইখানে বসে পরীক্ষা দিতে অনুমতি করুন। আর পুলিশের কাছে খোঁজ নিন। আমার বিরুদ্ধে কোনো ক্রিমিনাল কেস থাকলে আমি আত্ম সমর্পণে রাজি।“
“ আচ্ছা যাও তুমি। আমি দেখছি কি করা যায়।“
বেরোতে যাবে এমন সময় চাপা স্বরে কে বললো – ভারি ত্যাঁদড় মেয়ে। খুব কূট কচালে।
এর আগেও এক বার এই ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে পিছন থেকে এমন কটু কথা শুনেছিল শ্যামলী। সেবার ভেবে ছিল উপেক্ষা করবে, নিঃসীম উপেক্ষা। এবারে আর সহ্য হল না। ঘুরে আবার ঘরে ঢুকে প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামকে শ্যামলী বললো – “ম্যাডাম, এখানে উপস্থিত কেউ আমাকে পিছন থেকে কটু মন্তব্য করেছেন। আমি আপনার কাছে প্রতিকার চাইছি ম্যাম।“
শ্যামলী যে দৃঢ় ভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, এবং প্রতিকার দাবি করবে তা প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম বুঝতে পারেন নি। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “সব কথায় কান দাও কেন? যাও বাড়ি চলে যাও।“
“সে কি বলছেন ম্যাম? রীতিমতো পয়সা খরচ করে কলেজে পড়ছি। আমি পরীক্ষা দিয়ে তবে বাড়ি যাব। আপনি আমার পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা করুন।“ শ্যামলী ধপ করে বসে পড়লো একটা ফাঁকা চেয়ারে।
“তোমরা কি সবাই মিলে আমার মাথা খারাপ করে দেবে? কি দরকার ছিল ওকে গালি দেবার?“ এই বলে প্রিন্সিপ্যাল বিশেষ একজন শিক্ষিকার দিকে তাকান।
শ্যামলী প্রিন্সিপ্যালকে বলে “ ম্যাম, আমাদের কিন্তু শিক্ষক সমাজের কাছে একটা আশা থাকে যে, তাঁরা যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন , যে কথা বলবেন, তার একটা ওজন থাকবে, তার দায়িত্ব নেবেন তিনি। আলগা করে এমন কথা তিনি বলবেন না, যা ভদ্র সমাজে প্রকাশ্যে তিনি স্বীকার করতে পারবেন না।“
চুপচাপ কথা গুলি শুনলেন প্রিন্সিপ্যাল। শুধু বললেন, “ তোমার আর কিছু বলার আছে?”
“ আছে ম্যাম, আমি যেচে এখানে আসি নি। আমাকে ডেকে আনা হয়েছে। আমার কোনো দোষ দেখতে পেলে আমার বিচার হোক। কিন্তু, এক তরফা গালি দেবেন না। আমি গালি দিতে শিখি নি। কিন্তু আপনাদের গালি শুনলে লজ্জা পাবার বোধ আমার তৈরি হয়েছে।”
কথা বলতে বলতে শিক্ষিকাদের মধ্যে কে যে কটু কথা বলেছেন, সেটা শ্যামলী টের পেয়ে গেল। তাঁর দিকে সোজা তাকিয়ে বললো “ আপনাকে লজ্জা দিতে চাই না, কিন্তু এই দেশেই একদিন ছাত্র শিক্ষকে সম্মানের সম্পর্ক মানুষ ভাবতে পেরেছিল। আমি বিশ্বাস করি না আপনাদের মতো দু একজনের জন্যে সেই আদর্শ টা গুঁড়িয়ে যাবে। আমি চলি। আমার প্রণাম নেবেন।“

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।