দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৪০)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ৪০
১৩৯
মুখে চোখে জল দিয়ে চুলে একটু চিরুণি চালিয়ে ঘরোয়া পোশাকের উপর একটা অ্যাপ্রন জড়িয়ে শ্যামলী গিয়ে দাঁড়ালো অভ্যাগতদের সামনে।
“এসো মা, এসো, তোমাকে দু চোখ ভরে দেখবো বলেই বুড়ো ছেলে ছুটে এসেছি।“
শ্যামলী কিছু না বলে স্মিতমুখে চেয়ে রইলো নকুড় নন্দী ও তার স্ত্রীর দিকে।
“মা, সেদিন তোমায় প্রথম দেখে সরস্বতী ঠাকুর মনে হয়েছিল, আজ একেবারে ইন্দিরা গান্ধী মনে হচ্ছে।“
দরজার ফাঁক থেকে মুখ বাড়িয়ে সবিতা পিসি বললো “ উঁহু দাদাবাবু, ওনাকে সরস্বতী, বিদ্যেবতী, যা খুশি বলুন, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী কদাচ বলবেন না।“
শশাঙ্ক পাল চোখ পাকালেন সবিতাকে। বললেন “ কি জানেন দাদা, আজ আমরা বাপ বেটিতে খুব গল্প করছিলাম কি না, মেয়ে আমার শাড়ি পরার সময় পায় নি। অন্যদিন এ সময় তো ও গ্যারাজে মুখ বুজে খাটে।“
“তাই তো শুনেছি ভায়া, তোমার মেয়ে যেন একখানা ছেলের সামিল। ওই জন্যেই তো ওকে দেখে আমার ইন্দিরা গান্ধীর কথা মনে এল। যেমন মার্জিত তেমনি বুদ্ধিমতী মেয়ে তোমার।“
“না দাদা, ইন্দিরা গান্ধীর কথা থাক। অন্য কথা হোক।“ শশাঙ্ক পাল নিজের অস্বস্তি চাপতে পারেন না।
“আচ্ছা, বাদ দাও, রাজনীতির কথা না বলাই ভাল। তা মা জননী, তোমাকে কবে আমাদের বাড়ির বউ হিসেবে দেখতে পাচ্ছি?”
“জ্যেঠূ, আপনাকে জ্যেঠু বলছি কেমন? আমি কিন্তু রাজনীতির চক্করে পড়ে গিয়েছি। জানেন হয়তো।”
নকুড় নন্দীর স্ত্রী আঁতকে উঠে বললেন, “সে কি তুমি ভদ্রঘরের মেয়ে, রাজনীতির চক্করে জড়ালে কেন?”
“জ্যেঠিমা, আপনার কথা কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না। ভদ্রঘরের মেয়ের রাজনীতি চর্চা করতে আপত্তি কিসের? বরং ভদ্রলোকেই তো রাজনীতি করলে নোংরা লোক দূরে যাবে !”
নকুড় নন্দী উচ্চকণ্ঠে হেসে বললেন “মা রে, তোর জ্যেঠিমা তোর সঙ্গে ডিবেটে ডাহা ফেল মেরে যাবে । সেদিন তোর ডিবেট তো শুনে গেলাম। অতগুলো সা জোয়ান ছেলে, রমানাথের ইয়াং ফ্রেন্ড সব, ওদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছ তুমি।“
“জ্যেঠু, আমি কিন্তু ডিবেট করছি না। আমি সত্যিই চাই রাজনীতি দিয়ে দেশ বদলাতে।”
শশাঙ্ক পাল মাথা নিচু করে থাকেন। বাসন্তীবালা মেয়েকে ধমকে ওঠেন, “হ্যাঁ , রাজনীতি করতে চাইলেই তোমাকে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে আর কি?”
মাকে পাত্তা না দিয়ে মেয়ে বলে, “কি জানেন জ্যেঠু, একটা মেয়ে কি করবে না করবে, আমাদের দেশ ও সমাজ তার সেই স্বাধীন সত্ত্বাটাকেই স্বীকার করে না। জন্মানোর পর সে পিতার অধীন, বিবাহের পর সে স্বামীর অধীন, আর বার্ধক্যে সে পুত্রের অধীন। আমাদের সনাতনী রীতি মেয়েদের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন করে রেখেছে।“
“কি বলছিস মা? স্বামী পুত্র এদেরকে নিয়েই তো একটা মেয়ের সব!”
“না জ্যেঠু, ওইখানে আমার আপত্তি আছে। স্বামী পুত্র এরা অত্যন্ত আপনজন। কিন্তু একটা মেয়েও একটা মানুষ । তার একটা নিজস্বতা থাকবে। সে খানিকটা জল নয়, যে তাকে যে পাত্রে রাখবে তার আকার ধারণ করবে!”
“ওরে মা, আমাদের সনাতন সমাজে মেয়ের বিয়েকে যে পাত্রস্থ করাই বলে। জানো তো ছেলেরা হল পাত্র; আর পাত্রী সেই মেয়ে যার বিয়ে হয়।”
“হ্যাঁ, জ্যেঠু, আপনাদের সনাতনী পদ্ধতিতে ছেলেরা বিয়ে করে, আর মেয়েদের বিয়ে হয়।”
“যুগ যুগ ধরে তো তাই হয়ে আসছে মা। এটা যে আমাদের নমস্য মহাপুরুষেরা সৃষ্টি করে গিয়েছেন।” নকুড় নন্দী সোজা হয়ে বসেন ।
“জ্যেঠু, আমার রাজনীতিটা ঠিক ওইখানে। আমার পৃথিবীটা ঈশ্বরের বা মহাপুরুষের হাতে তৈরি নয়। এক অগ্নিগোলক বহুদিনের অপেক্ষায় সবুজে নীলে পৃথিবী হয়ে গড়ে উঠেছে। আমি সেই জীবন নিজের মতো করে উপভোগ করবো।”
“তা কোরো। কিন্তু যুগ যুগ ধরে যাকে মানুষ মেনে চলেছে, তাকে তো তুমি বদলাতে পারো না।”