দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৪৭)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ৪৭
১৪৬
কারখানায় ঢুকে শ্যামলী দেখল তার চেয়ারে শান্তু, তার দাদা, বসে আছে। ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল তার। সকালে বাবাকে দিয়ে চেকে সই করার ব্যাপারটা কি শান্তু লক্ষ করেছে?
শ্যামলী ধরেই নিল যে শান্তু টাকার খোঁজে এসেছে। পুজোর ফূর্তি করার জন্য টাকা চাই ওর। তাই কারখানার অফিসে বসে আছে। মিস্ত্রিরা যে যার কাজ করে চলেছে। শুধু বড় মিস্ত্রিকে দেখতে পেল না শ্যামলী। কি কি গাড়ির কি কি কাজ হয়েছে, তার জন্য কি কি মোটর পার্টস লেগেছে, তার দাম, আর মজুরি বাবদ কতটা লেগেছে লিখে রাখে সে। তার খসড়া দেখে মোটর পার্টসের স্টকের রেজিস্টার হালনাগাদ করে শ্যামলী নিজের হাতে। প্রতি তিনদিনে খাতার সাথে স্টক যাচাই। পার্টসের বিক্রি বাবদে গ্যারাজের কিছু লাভ থাকে। মজুরি বাবদ যা কাস্টমার দেয়, তার সবটুকু মজুর পায় না। ইলেকট্রিক বিল, গ্যারাজের মেইনটেন্যান্স, মেশিনের অবচয়, নানা রকম সাজ সরঞ্জামের আয়োজন বাবদে কিছু রেখে, বাকিটা মজুর হাতে পায়। কে কতটা কাজ করল, তারও হিসেব রাখে হেড মিস্ত্রি। তাই তাকে কারখানায় না দেখে একটু চিন্তাগ্রস্ত হল শ্যামলী। কিন্তু শান্তুর সামনে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করল না।
কি যে বলিস তুই? সাড়ে তিনটে বাজে। দুটোর সময় ভাত খেয়ে আধঘণ্টা বসে তারপর বেরিয়েছি। এক্ষুণি মুড়ি খাব কি করে?
ম্লান হাসল শ্যামলী। তার মনে পড়ল আজ তার খাওয়া হয় নি। কলেজে দুটো ক্লাস করেই ব্যাঙ্কের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিল। মহাজনের গদিতে কিছু টাকা জমা করে, আজ বোনাস দেবার জন্যে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে আনার ফাঁকে নিজের পেটে আর কিছু দেবার সময় করতে পারে নি। কিন্তু সে কথা শান্তুর কাছে বলার প্রবৃত্তি হল না ওর।
তোর কাছে টাকা নেব। খুব দরকার। গুরুদেবের জন্যে কালেকশন করছি।
শান্তুর কথার উত্তরে কী বলবে প্রথমটা ভেবে পেল না শ্যামলী। বাবা অসুস্থ হলে শ্যামলী কিভাবে টাকা যোগাড় করে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল ও কোনোদিন জানতে চায় নি। সেদিনও ওরা দুইভাই ফুটবল খেলা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তারপর দেনা শোধ করার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে কড়া আইনি চিঠি এলেও ও সে নিয়ে মাথা ঘামায় নি। বোনকে আদালত থেকে সমন পাঠিয়ে ডেকে পাঠালেও কেন, কী বৃত্তান্ত জানার কোনো আগ্রহ প্রকাশ করে নি শান্তু। কিন্তু গুরুদেব নারীধর্ষণের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে শান্তু টাকা কালেকশন করতে বেরিয়েছে। আশ্চর্য মানুষ এরা! খুব শান্ত হয়ে থাকার চেষ্টা করছিল শ্যামলী। নিজেকে বোঝাচ্ছিল যে, সবদিক সামলে চলতে হবে। তার হাতব্যাগের ভিতর, পার্সে টাকা আছে। যাতে ব্লেড চালিয়ে কেউ তুলে না পারে, তাই পার্স একটা স্টিলের টিফিন কৌটার মধ্যে রাখে সে। দেখতেই অনেকগুলো টাকা। কিন্তু এ টাকা থেকে একপয়সাও অন্যখাতে দেওয়া যাবে না। ইলেকট্রিক বিল পেমেন্ট করতে হবে। টেলিফোন বিলও। সময়ে পেমেন্ট না করলে সমস্যা। কিন্তু শান্তুকে তো সে কথা বোঝানো যাবে না। ও হয়তো বা হাতব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়েই চলে যাবে।
টাকাটা কিভাবে নিজের দাদার চোখ থেকে আড়াল করবে ভেবে পাচ্ছিল না শ্যামলী। দাদাকে বললো, আমি আজ কিছু খাই নি, একটু খাবার আনিয়ে খেয়ে নিই। তুমি তো খাবে না বলছো।
শ্যামলী বলল, আমি একটু পেটে কিছু না দিলে আর থাকতে পারছি না। এই বলে সে বেল বাজাল। ঘরে ঢুকল বাচ্চা শ্রমিকটা। ও শ্যামলীকে ছোড়দি বলে ডাকে। কখনো কখনো তুইও বলে ফেলে। শ্যামলী ওকে তখন ধমক দেয়। ও ছেলে মুখ গোঁজ করে থাকে বলে শ্যামলী মজা পায়। বলে খবরদার, বাইরের কারো সামনে তুই করে আমায় ডাকবি না।
ছেলেটা পরদা সরিয়ে মুখটুকু বাড়ালো। ও জানতো ঘরে শান্তু বসে আছে। শ্যামলী ছেলেটাকে ডেকে বলল, এই টিফিন কৌটো নিয়ে যা। ওতে করে রুটি আলুরদম আনবি। খবরদার, কৌটো খুলে ভিতরে হাত দিবি না। যে নোংরা হাত তোদের!
ছেলেটা বলল, তুমি সবার নিজের নিজের সাবান দেবার ব্যবস্থা করার পর থেকে, আমি সব সময় সাবান দিয়ে হাত ধুই। এই দ্যাখো, কত্ত পরিষ্কার!
মুখ ভেঙিয়ে শ্যামলী বলল, হ্যাঁ, তুইও বললি, আর আমিও বিশ্বাস করলাম।
ছেলেটা একবগগা ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়।
শ্যামলী আবার বলল, যে ছেলেটা খাবার দেয়, ওকে ভাল করে হাত ধুয়ে নিতে বলবি। একটুও নোংরা লেগে থাকলে আমি খাবো না, বলে দিলাম।
শান্তু বলল, তুই পারিস বটে। ফুটপাতের হোটেলের খাবার আনতে দিচ্ছিস না গ্রাণ্ড হোটেল থেকে খানা আনাচ্ছিস বোঝা যাচ্ছে না।
কি জানো দাদা, খাবারটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলে শরীরটা ভাল থাকে।
ছেলেটা বলল, ছোড়দি, পয়সা?
শ্যামলী ব্যাগ থেকে খুঁজে পেতে দুটো টাকা বের করে দিল। বলল, যা ভাগ্।
শ্যামলীর একবার যেন মুখে এসে গেল, তাই দ্যাখো। নিজেরা দুভাই রোজ দুবেলা মাছ মাংসের দেখনসই পিস সাজিয়ে পরিবেশন না করলে মায়ের উপর চোটপাট করে চোখের জল ফেলাও। কিভাবে যে সবদিক সামলাচ্ছি আমিই জানি।
মুখে বলল, দাদা, ঔরঙ্গজেব শুনেছি রাজকোষ থেকে একটা পয়সা নিতেন না। কোরাণ নকল করে আর টুপি সেলাই করে দু মুঠো পেটের ভাত জোটাতেন। তুমি একটু বসো দাদা, আমি বাথরুমের থেকে আসি।
এই বলে হাতব্যাগটা শান্তুর সামনে ফেলে রেখে চেম্বার লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে পড়ে আয়নায় নিজেকে দেখল শ্যামলী। আর মুচকি হেসে দর্পণকে জিগ্যেস করল, কি ম্যাডাম কেমন দিলাম?
প্রতিচ্ছবি বলল, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে আনা অতোগুলো টাকা টিফিন ক্যারিয়ারে করে ছেলেটার হাতে পাচার করে দিয়ে তুমি সাংঘাতিক রিস্ক নিয়েছ শ্যামলী।
শ্যামলী প্রতিচ্ছবিকে বলল, রিস্ক?
ওই বাচ্চা ছেলেটা মরে গেলেও বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। ও আমাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। দোকানে গিয়ে ও যেই টের পাবে বাক্সের ভিতর নোটগুলো আছে, ও ঠিক সামলে নেবে।
প্রতিচ্ছবি বলল, সে না হয় হল, কিন্তু ও যদি বাক্স না খুলে দেখে দোকানে দিয়ে ফেলে, আর দোকানি যদি লোভ সামলাতে না পারে?
শ্যামলীর মুখ শুকিয়ে গেল।
প্রতিচ্ছবি বলল, একটা বিপদ থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেকটা বিপদে নিজেকে ঠেলে দিলে না তো?