দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৮৪)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ৮৪
১৮৩
শ্যামলী বলল, বাবা, দ্যাখো কে এসেছেন। ইনি আজ থেকে আমার বন্ধু হয়েছেন।
শশাঙ্ক পালের কাছেই সোফাটায় বসেন রামনারায়ণ। বলেন, তোমার মেয়েটা দাদা খুব ট্যালেন্টেড। আমরা মাঝে মধ্যে নিজেরা বলাবলি করি।
শশাঙ্ক পাল বলেন, আর কি করব ভাই, তোমরা রইলে। মেয়েটা ছোটো এখনো। একুশ চলছে। দেখতেই ওই রকম। আসলে ছেলেমানুষি যায় নি।
শ্যামলী বলল, বাবা, আমার নিন্দে করলে ভাল হবে না বলছি। তারপর সে রামনারায়ণের দিকে তাকিয়ে বলল, মিস্টার সিংহ, একটু চা হোক, আমার হাতে?
রামনারায়ণ বললেন, সে আর বলতে? আপনি চা করুন। আমি আপনার বাবার সাথে দুটো গল্প করি।
শশাঙ্ক পাল বললেন, ভাই, ওকে আপনি আজ্ঞে কোরো না। ও তোমার হাঁটুর বয়সী।
শ্যামলী বলল, বাবা, বাজে বোকো না তো। একটা লোকের থেকে তার হাঁটুর বয়স মোটেও কম হয় না। বরং হাঁটুকেই মানুষটার শরীরের প্রচুর চাপ নিতে হয়।
রামনারায়ণ বললেন, দাও দাদা, মেয়ের কথার কি উত্তর দেবে দাও!
শশাঙ্ক পাল হাসেন। বলেন, মেয়ে তো নয়, কথার ভটচায্যি।
এমন সময় বাসন্তীবালা ঢোকেন ঘরে। তাঁকে দেখে সোফায় বসেই বুকের কাছে হাত জোড় করে রামনারায়ণ বলেন নমস্কার বউদি।
রামনারায়ণকে দেখেই গায়ের কাপড়টা আর একটু ভাল করে জড়িয়ে নেন বাসন্তীবালা।
রামনারায়ণ তাঁকে বলেন, দাদার শরীর খারাপ সে আমি অনেক দিন আগেই শুনেছি। কিন্তু কখনও এবাড়িতে আসা হয়নি। আজ আপনার মেয়ে হঠাৎ পাকড়াও করে আনল। নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে থাকেন রামনারায়ণ।
বাসন্তীবালা একটু যেন সংকুচিত হয়ে বলেন, ধাড়ি মেয়েটা আমার মান সম্মান সব খেল। শশাঙ্ক পালের মুখ চোখও থমথম করছে। রামনারায়ণ আর নিজের মেয়ের মধ্যে “বন্ধুত্ব” শব্দটি শশাঙ্ক পালকে রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলছে।
রামনারায়ণ হাসিমুখ করে বলেন, বউদি, আজ ইংরেজি সাহেবি কাগজে আপনার মেয়ের ছবি বেরিয়েছে।
বাসন্তীবালা শঙ্কিত হয়ে ভ্রূকুঞ্চিত করে বলেন, কেন কি করেছে সে?
রামনারায়ণ বলেন, আপনি উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন বউদি? সে কলেজের পরীক্ষায় সেরা হয়েছে। তাই সম্মান পেয়েছে। আপনাকে বলেনি সে?
বাসন্তীবালা নিজের মনে বিড়বিড় করে বলেন, মায়ের সাথে দুটো কথা বলার সময় কোথায় তার?
শশাঙ্ক পাল একটু গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন, কাগজে কি বেরিয়েছে রাম?
রামনারায়ণ বলেন, হায় দ্যাখো, তোমরা কত্তা গিন্নি দুশ্চিন্তা করতে শুরু করে দেবে জানলে আমি এসব বলতাম না।
বাসন্তীবালা বললেন, না মেয়ে আমার ধিঙ্গি নয় মোটেও, তবে কি না, মেয়েমানুষ, শাসনে রাখা দরকার।
রামনারায়ণ বলেন, শাসনে রাখবেন? আপনার শ্যামলীকে? নিজের মেয়েকে আপনি চেনেন নি বউদি। ওকে যে শাসনে বাঁধবে সে এখনো মায়ের পেটে আছে।
শশাঙ্ক পাল তীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে রামনারায়ণের প্রতিটি ভঙ্গি লক্ষ্য করতে থাকেন।
রামনারায়ণ বলেন, জানো দাদা, আজ তোমার মেয়ে গিয়ে হাজির আমার বাড়িতে। আমি তখন অফিসে বসে। আমি হেন ভারিক্কি একটা লোক, দেড় কুইণ্টাল ওজন আমার, আমাকে বলে কি, আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই।
বাসন্তীবালা বিড়বিড় করে বলেন, ওরে মা, মাঝে মাঝে মাথায় কি যে ভূত চাপে তোর !
রামনারায়ণ বলেন, আমি তো তোমার মেয়ের কথা শুনে অবাক। আমি ওকে তুমি বলতে গিয়েছিলাম। জানি তোমার মেয়ে। আসা যাওয়া নাই বা থাকল, একই এলাকার লোক তো বটে! তুমি ব্যবসায়ী। আমার ও ব্যবসা করেই খাওয়া। আমি তুমি বলতে গেলাম বলে মুখে কিছুই বলল না, কিন্তু এমনভাবে তাকালো যেন শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত নেমে গেল।
বাসন্তীবালা বললেন, মেয়েটা একটু ওইরকম। কটকটি গোছের। কাকে কি বলতে হয় মানে না। মুখে যা আসে বলে দেয়।
রামনারায়ণ বলেন, বউদি, নিজের মেয়েকে আপনি চেনেন না। আপনি ওর মা তো; তাই। মায়েরা সন্তানকে স্নেহ দিয়েই দেখে। মা যশোদা নন্দলালাকে খেলার মাঠে ছাড়বার আগে ছেলের বন্ধুদের প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতেন যে তারা কৃষ্ণকে দেখবে। অথচ কৃষ্ণ স্বয়ং শ্রীভগবান। তামাম জগৎসংসারকে তিনিই রক্ষা করছেন। তাঁর ইচ্ছা না হলে পাতাটি পর্যন্ত নড়ে না। তিনি কিন্তু মা যশোদার কাছে অবোধ শিশু। আপনার মেয়ের যা আছে তা হল খুব উঁচু দরের পারসোনালিটি।
শশাঙ্ক পালের দিকে চেয়ে রামনারায়ণ বলেন, তুমি ভাবতে পারবে না দাদা, তোমার মেয়ের মনের কি জোর। আমি বলতে গেলাম কাগজে ছবি বেরিয়েছে, তাও হেঁজিপেঁজি কাগজ নয়, সাহেবি কাগজ, ওর ইংরেজি বোঝা খুব উঁচু দরের লোক না হলে অসম্ভব, আর তোমার মেয়ে কাগজটার দিকে ফিরে তাকাল না পর্যন্ত। বলল, আজ যা খবর, কাল তা জঞ্জাল। আসল কাজ হল সত্যিকারের ভাল হওয়া। এতখানি অহঙ্কারশূন্য মন আমি তো দেখি নি।
বাসন্তীবালা বললেন, তা আমার মেয়েটা লেখাপড়া যখন করে, মন দিয়েই করে।
রামনারায়ণ বললেন, সে বউদি জেলার মধ্যে ভাল রেজাল্ট করার জন্য ওর নাম আছে।
শশাঙ্ক পাল বললেন, শ্যামলী জলপানিও পায়।
রামনারায়ণ বললেন, তবু বলব দাদা, পড়াশুনায় ভাল ছেলে তো কম দেখিনি। এসডিও, ডিএসপি কত দেখছি। সব ভাল রেজাল্ট করা ছেলেপুলে। আজ একটু পয়সার মুখ দেখেছি বলে মন্ত্রী সান্ত্রী এদিকে এলে আমায় খোঁজে। সেই দেখে ওরা সম্মান করে। কিন্তু তোমার মেয়ের আছে ব্যাকবোন। যেটা বলবে, করেই ছাড়বে। আমি তাকে বললাম, আমি বিয়েওলা লোকটা, ছেলে মেয়ে দুটোই পড়ছে। আমি কি করে আপনার বয়সী মেয়ের বন্ধু হব? তা তোমাদের মেয়ে বলে কিনা, নিঃস্বার্থ, সরল বন্ধুত্ব চাই, পাব না? এই রকম কথা আমি জীবনে শুনিনি।
গভীর গলায় আত্মমগ্নতার স্বরে রামনারায়ণ বলতে থাকেন, শোনো শশাঙ্ক দা, তুমি আমাকে অনেক দিন চেনো জানো, আমি তো লোকটা ভাল নই। নেশা করি। প্রশাসনকে কিনি, আর মিথ্যে বলব না, মেয়ে মানুষের নেশাও আমার ছিল। বউদি, আমায় মাফ করবেন, পয়সার দাপটে আমি অনেক আকাম কুকাম করেছি। কিন্তু এখন ছেলে মেয়ে হবার পর বুঝতে পারছি বাচ্চার কাছে সম্মান না পেলে ওই জীবন ফালতু। তোমার আসল পরীক্ষা নেবে তোমার বাচ্চা। তুমি কতটা মানুষ আর কতটা জানোয়ার। তোমার কন্যাভাগ্য চমৎকার দাদা।
এমন সময় শ্যামলী ঢোকে। পিছনে সবিতা প্লেটে করে গরম শিঙাড়া নিয়ে।
রামনারায়ণ বলেন, একি ম্যাডাম, শিঙাড়া আনালেন কেন? শুধু চা খাব বলেছিলাম।
সবিতা বলল, না মশায়, শিঙাড়া আনানো হয় নি। উনি নিজের হাতে বানিয়েছেন।
রামনারায়ণ বললেন, তা হলে তো খেতেই হয়, তবে আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। আলু খাওয়া বারণ। আমি একটা খাচ্ছি।
সবিতা বলল, আলু নেই। কড়াইশুঁটির পুর। সবকটাই খেতে হবে। ভাল তেলে ভাজা।
রামনারায়ণ বললেন, তাই? ম্যাডাম আমার ডায়াবেটিস, সে খবর কি আপনি জানেন?
শ্যামলী বলল, আপনার চোখের নিচের ব্যাগ আর ডাবল চিন দেখে একটু আন্দাজ করেছিলাম।
শশাঙ্ক পাল মেয়ের দিকে তাকান। নিজের মেয়ের মুখের প্রতিটি রেখা যেন পড়তে চেষ্টা করেন।