সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দেবব্রত রায় (পর্ব – ৫)
ভুলভুলাইয়া-র হাট
( আগে যা ঘটেছিল )
নন্দাই মিস্তিরি উঠে গিয়ে দোকানের একপাশে রাখা কুঁরির পরিস্কার জলে হাত ধুয়ে এসে শুকনো গামছায় ভালো করে মুছে নিল তারপর , পাশের দাওয়ায় গিয়ে পেতলের পাইয়ে করে মেপে মেপে লোকটাকে চাল দিয়ে এসে আবারও আগের জায়গায় বসে পড়লো। মাঝখানে শুধু একটা শব্দ কানে ভেসে এলো , খুটুস ! দেখলাম, চালের পুঁটুলিটা ভালো করে বেঁধে নিয়ে কাঁধে ফেলে লোকটা এই পড়ন্ত বিকেলে হনহন করে গাছের সারির ভিতর দিয়ে হাঁটা দিল।
(৫ম তথা, শেষপর্ব )
কতক্ষন হবে কে জানে , আমি বোধহয় ,শিমুল গাছের তলায় বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ! হটাৎ , নন্দাই মিস্তিরির গলার আওয়াজ যেন বহু দূর থেকে আমার কানে এসে পৌঁছালো , ” আসেন গো লোতোন বাবু । “
আমি একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়ালাম। সাইকেলটা নন্দাই মিস্তিরির হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফিরে এসে আবার শিমুলগাছের তলায় বসলাম। দেখলাম , নন্দাই মিস্তিরি ততক্ষণে তার দোকানে একটা কুপি লণ্ঠন জ্বালিয়ে নিয়েছে। কখন যে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে আমার খেয়াল-ই হয়নি । ঘোর লাগা চোখে আমি সেই বিশাল হাটটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম , ঘন কুয়াশার পর্দা ভেদ করে চারদিকে যেন হাজার হাজার জোনাকি একসাথে জ্বলে উঠেছে ! হাট তখন প্রায় ফাঁকা । নন্দাই মিস্তিরি হাতের কাজ সারতে সারতেই বললো , ” দুকানের ভিতরে এসে বইস্যান গো লোতোন বাবু! বাইরে হিম পড়ছে , ঠান্ডা লেগে যাব্যাক! “
আমি দোকানের চালার তলায় ঢুকতে ঢুকতে বললাম , ” এই আলোয় পাংচার সারাতে পারবেন , দেখতে পাচ্ছেন তো ? ” নন্দাই মিস্তিরি বললো ,” ইতো দেখার জিনিস
লয় বাবু , ই হলো অনুভব্যার কাজ! ” তারপর, মৃদু হেসে বললো ,” শত আঁধারেও ব্যাতের গরাস কী কখনো নাকের খোঁদলে ঢুকে যায় ! “
এ কথা-র কোনো উওর হয় না! আমি চুপচাপ বসে নন্দাই মিস্তিরির কাজ দেখতে লাগলাম। কুপিলণ্ঠনের দোঁয়াসা আলোয় প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে আসা সেই বিশাল হাটটাকে যেন কোনও এক রহস্যময় মায়াজগৎ বলে মনে হলো আমার আর, নন্দাই মিস্তিরিকে মনে হলো সেই মায়াজগতের মূল কারিগর ! আমি ভুলভুলুনির অপার্থিব সেই রূপ দেখতে দেখতে বোধহয় , আবারও তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম! নন্দাই মিস্তিরির গলার আওয়াজে আমার চটকা ভাঙল। কখন যে তার হাতের কাজ সারা হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি !নন্দাইমিস্তিরি বললো , ” লেনগো লোতন বাবু, আপনের সাইকিলঠাকুর সুস্থ হইয়ে গিছেন। ” নন্দাইমিস্তিরি-র মুখে “সাইকিলঠাকুর “কথাটা শুনে আমি মনে মনে হাসলাম! তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ” কত দিতে হবে? ” নন্দাইমিস্তিরি তার সেই মাটির কুরির জলে তার হাত পা ধুয়ে এসে গামছায় মুছতে মুছতে বললো , ” এক পুটুলি লবণ। “
আমি আমতাআমতা করে বললাম , ” আমার কাছে নুন মানে , লবণ তো নেই তবে , জালকাঠি আছে ! “
নন্দাইমিস্তিরি বললো , ” তবে , তাই দেন। ” আমি পকেটের থেকে পুঁটলিটা বের করে সেখান থেকে একটা জালকাঠি তার হাতে দিলাম! নন্দাইমিস্তিরি জালকাঠিটা আমার হাত থেকে নিয়ে তার সেই নক্সা করা বাক্সের মধ্যে রেখে ” আইসছি , ইকটুক দাঁড়ান ! ” বলেই সে তার দোকান ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা চোঙামুখো কাঁচ-লণ্ঠন হাতে করে নিয়ে এসে তাতে কেরোসিনতেল ভরে আমার সাইকেলের সামনে বেঁধে দিতে দিতে নন্দাইমিস্তিরি বললো , ” আপনি লোতোন মানুষ, এই চাঁদনে-আলোয় পথ চিনে যেতে আপনার ভুল হয়ে যাবেক। তাই , ….” তারপর ,লণ্ঠনটায় আলো জ্বেলে দেবার মুহূর্তে হটাৎ-ই, তার কী-যেন মনে পড়ে যাওয়াতে আফসোসের সুরেই সে বলে উঠলো , ” বাবু , আপনি তো অনেক্ষণ এয়েচেন , আপনার খিদা পায়নাই ? “
নন্দাই মিস্তিরি খিদের কথা জিজ্ঞাসা করতেই , আমার পেটের ভিতরে যেন পৃথিবীর সমস্ত খিদে একসাথে নড়েচড়ে উঠলো। আমি বললাম , ” হ্যাঁ , মানে, তা পেয়েছে ! ” নন্দাইমিস্তিরি বললো , ” তালে , আর ইকটুক বস্যান! “
কিছুক্ষণ পর নন্দাই মিস্তিরি একটা শালপাতার বড়ো খালায় করে চিড়ে, বাতাসা, পাকা আম আর, অন্য একটা খালায় করে বট-আঠার মতো ঘন দুধ এনে আমার সামনে নামিয়ে রাখলো । বললো, ” পেট ভরে খেইয়ে ল্যান , এই রাত্তিরে আপনেকে ইখন অনেকট পথ যেতে হব্যাক । “আমি তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলাম। সেই অপূর্ব ফলাহার মুখে দিতেই মনে হলো , এমন খাবারের স্বাদ ইতিপূর্বে আমি যেন কোনও দিন পাইনি! ভাবলাম , অমৃত বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে তাহলে, সেও বোধহয় , এর কাছে হার মানবে ! আমি খেতেখেতেই লক্ষ্য করলাম , নন্দাইমিস্তিরি তার দোকানের জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। হাট প্রায় নিস্তব্ধ। দু-দশজন যারা ভাঙা হাটে সস্তায় জিনিসপত্র কেনাকাটা করার জন্য একটু আগেও এদিকওদিক ঘোরাঘুরি করছিল তারাও এখন যে-যার বাড়ির পথে রওনা দিচ্ছে। নন্দাইমিস্তিরির দোকানের দাওয়ায় বসেই দেখলাম , ভরা কোটালের বাধভাঙ্গা আলোয় ভুলভুলাইয়ার হাট, রাস্তা -ঘাট, জঙ্গল সবকিছুই যেন হো-হো শব্দে ভেসে যাচ্ছে । বহুদূর থেকে শুনতে পেলাম , হাট-ফিরতি মানুষেরা চাঁদের সেই মায়াময় জ্যোৎস্নায় গান গায়তে গায়তে, বাঁশিতে সুর তুলতে তুলতে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে, পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথ পেরিয়ে যে-যার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে !
ওদের দলবেঁধে বাড়ি ফেরার দৃশ্য নিজের কল্পনার আয়নায় দেখতে দেখতে হটাৎ যেন আমারও বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে গেল! ফুল্লরার কথা মনে পড়লো! বৃদ্ধ রামদীনের ভরসায় তাকে একা রেখে এই বিভূঁই জায়গায় সেই কখন রবিউলদের বাড়িটার থেকে বেরিয়েছি ! কথাগুলো ভাবতেই, মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলো ! এতক্ষণে নিশ্চয় ওরা আমার চিন্তায় ব্যাস্ত হয়ে উঠেছে! ফুল্লরার স্বভাব আমি জানি। সে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ রামদীনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সামনের মাঠটায় এসে দাঁড়িয়ে আছে । আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে হাতমুখ ধুয়ে এসে নন্দাই মিস্তিরির সামনে দাঁড়ালাম । বললাম, ” এবার তাহলে আসি ! ” নন্দাই মিস্তিরি আমাকে আবারও , ” ইকটুক দাঁড়ান! ” বলেই কুপি লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে তার দোকানঘরের ভিতরে ঢুকে গেল । খানিক বাদেই দুটো বাজার-ভর্তি থলি নিয়ে এসে আমার সাইকেলের হ্যান্ডেলে খুব যত্ন করে বেঁধে দিল। থলিগুলোর ভেতরে যে চিড়া, খৈ, মুড়ি, মুড়কি, ঢেকিছাটা চাল আনাজপাতিতে ভর্তি আছে সেটা আমি না দেখেও যেন বেশ বুঝতে পারলাম! কিন্তু, তারপর -ই , নন্দাইমিস্তিরির একটা অদ্ভুত আচরণে আমি যারপরনাই ঘাবড়ে গেলাম! হটাৎ-ই , সে আমার সাইকেলেটার হ্যান্ডেলের উপর প্রণাম করার ভঙ্গিতে মাথাটা ছুঁইয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মতো করে বলে উঠলো , ” সাইকিল- ঠাকুর , সওয়ারীকে লিয়ে যে পথে এইচেন সেই পথেই ফিরে যান। জোছনার পীরিতি-আলোয় পথ হারায়েননি বাবা! ভুলভুলাইয়ার ই-পথ বড় ভয়ঙ্কর পথ! ই-পথে কেউ অ্যাকবার হারায়ে গেলে সারা জেবন ধরে তাকে নিষ্কেরান্তের পথ খুঁজে মরতে হব্যাক ! ” তারপর , অদ্ভুতভাবে তার সেই ঝাকড়া চুলভর্তি মাথাটা দুপাশে ঘনঘন নাড়াতে নাড়াতে এক মায়াবী সুরে আবারও সে বিড়বিড় করে উঠলো! বললো, ” যাও বাবা , যাও, নন্দাইমিস্তিরির হাতযশের অবমান করনি। যে পথে এইচো সেই পথেই ফিরে যাও । লোতোন বাবুর পরিবার তার লেগে পথ চেয়ে বসে আছেন! “